অন্যরকম ভ্রমন অভিজ্ঞতার নাম
চলনবিল
মোছাঃ হালিমা
জীবনের প্রথম ভ্রমনের অভিজ্ঞতা লিখতে বসলাম। আলোআঁধারি স্মৃতি কে আশ্রয় করে লেখা শুরু। কিছু ঘটনা মনে আছে, আর কিছুটা আবছা। পুরোনো স্মৃতি বা ঘটনা লিখতে বসলে এই একটাই সমস্যা। আচ্ছা যাই হোক! বই আর খবরের কাগজ পড়ে চলন বিলের কথা কতদিন আগে যে জানতে পেরেছিলাম সে কথা মনে আসছে না কিন্তু মেঘাচ্ছন্ন হালকা কুসুমের মতো আকাশ ও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চলন বিলের সৌন্দর্য দেখার আগ্রহ ছিল বহু দিনের। সেই আগ্রহ থেকেই ঈদুল আজহার দ্বিতীয় দিন নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলায় কালিনগর গ্রামে একজন আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। আর সেই আত্মীয়র নাম ছিল হৃদয় মোল্লা। তিনি আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন এবং তার স্বজনদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবার ব্যবহার অতি মধুর ছিল। তারপর অল্প সময়ের মধ্যেই একজনের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো আমার। শুনেছিলাম নাটোরের মানুষ আত্মীয়দের সেবা যত্ন করতে খুবই ভালোবাসে। আজ বুঝতে পারলাম সেই কথাটা পুরোপুরি সত্য। তারা আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসার সহিত দুপুরের খাবার খাওয়ালেন। এবং আরাম করার জন্য বিছানা পেতে দিলেন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর সেই বন্ধু এসে আমাকে বলল তাড়াতাড়ি রেডি হন আপনার সেই কাঙ্ক্ষিত আগ্রহের বস্তুর নিকট আমরা এখনি বের হবো। কথাটা শুনতেই আমার মনে অন্য রকম আনন্দ দোলা দিতে লাগল মনে হচ্ছিল আমি যেন পুরো মহাবিশ্বকে জয় করে ফেলেছি। কিন্তু তখনই আকাশের দিকে তাকাতেই দেখলাম গুড়ি গুড়ি কিছু মেঘ আকাশের বুকে জমা হতে শুরু করেছে। যাক মেঘ নিয়ে আর চিন্তা করলাম না। ও একটা কথা লিখতে লিখতে ভুলেই গেলাম সেই বন্ধুর নাম ছিল মিজান। হঠাৎ পিছন থেকে মিজান এসে বলল চলেন? আমিও সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলন বিলের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। একটা কথা বলে রাখি গ্রাম অঞ্চলে এখনো সেই ভাবে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। তাই মানুষের চলাচলের জন্য প্রধান বাহন এখনো ভ্যান রিক্সা ইত্যাদি। তাই আমাদেরও ভ্যানে করে রওনা করতে হলো।
পথে যেতে যেতে মিজান ভ্যান চালকের সাথে বিভিন্ন ধরনের গল্প বলতে শুরু করল । তার মধ্যে একটা ছিলো পাট বেচাকিনা নিয়ে। যেহেতু বর্ষাকাল এই সময় নাটোরে প্রচুর পরিমাণে পাটের ফলন হয়। কিন্তু কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য আগের মত এখন আর পায়না। মিজান তখন আমাকে প্রশ্ন করল কেমন লাগছে? তখন আমি তার প্রশ্নের জবাবে বললাম অসাধারণ লাগছে। চারপাশের প্রকৃতি, রাস্তার দু’পাশের নুইয়ে পড়া পাতাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন এক স্বপ্নপুরী। আর আমি সেই স্বপ্ন পুরীর ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। কালিনগর থেকে সিংড়া যাবার সময় আত্রাই নদীর পাশ দিয়ে যেতে হয়। বর্ষাকাল হওয়ার দরুন নদীর পানি ফুলে ফেঁপে উঠেছে সেই দৃশ্য আমার মন কে বারবার আকৃষ্ট করছে। ২০ থেকে ২৫ মিনিট পর আমরা সিংড়া বাসস্ট্যান্ডে পৌছালাম। সেখানে গিয়ে অসাধারণ একটা বিষয় খেয়াল করলাম। সেটা হচ্ছে মানুষের চলাচলের জন্য ফুটওভার ব্রিজ করে দেওয়া হয়েছে। একটু আমি হেঁটে যেতেই চলন বিল গেট পর্যন্ত ভ্যান পাওয়া গেল । ভ্যানে চড়ে চরনবিল গেটে গিয়ে দেখলাম অসংখ্য দর্শনার্থী উপচে পড়া ভিড়। হঠাৎ ভ্যান চালক বলে উঠলো বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে মানুষের কাছে চলনবিল পর্যটন কেন্দ্র ব্যাপক পরিচিত। আজ ঈদের দ্বিতীয় দিন তাই প্রায় সকলেই পরিবার আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে এসেছে। তার জন্য একটু বেশি ভিড়। যাই হোক চলন বিলের গেটের সামনে যেতেই বড় বড় অক্ষর এ লেখা চলন বিল গেট। কিন্তু তখন মিজান বলে উঠলো এখান থেকে আরও তিন কিলোমিটার ভিতরের দিকে যেতে হবে তাহলেই তুমি চলন বিলের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে। যাই হোক তারপর মিজান আর একটি ভ্যান নিল এবং ভ্যানে চড়ে যেতে যেতেই হঠাৎ বাজ পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম এবং চারদিক থেকে হিমেল হাওয়া শরীরকে ঠান্ডা করে দিয়ে চলে গেল। তারপর দেখলাম চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে একটু ভয় করছিল তখন আমার। ধীরে ধীরে খুব জোরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। বাতাসের সাথে বৃষ্টির ফোটা শরীরে এসে পড়তে লাগলো। তখন আমরা রাস্তার ধারের ছাউনিতে আশ্রয় নিলাম । ১০ মিনিট পর বৃষ্টি থেমে গেল মনটা একটু তখন হালকা লাগছিল। যাক আবার আমরা রওনা হলাম সেই কাঙ্খিত গন্তব্যস্থলে। গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর সময় অনেক গুলো ছোট বড় ব্রিজ দেখতে পেলাম। ব্রিজ এর চারপাশে মানুষ বসে অপরূপ সৌন্দর্যে আভা উপভোগ করছে। আরেকটু সামনে যেতেই নৌকা, শাপলা, ফুল এবং মাছের ভাস্কর্য দেখতে পেলাম। চলন বিলের মাঝে দেখতে অতি সুন্দর লাগছিল। দেখলাম আশেপাশে পিকনিকের নৌকো দিয়ে ভরে রয়েছে। আরেকটু সামনে যেতেই দেখলাম একটি গেট এবং সাইডে টিকিট কাউন্টার। গেটে লেখা ছিল চরনবিল পর্যটন কেন্দ্র ভিতরে ঢোকার জন্য প্রত্যেকের জন্য ৩০ টাকা টিকিট ধার্য করা ছিল।আগ্রহের সহিত টিকিট কাটার পর ভিতরে বিভিন্ন খাবারের দোকান, নাগরদোলা শিশুদের জন্য আলোকসজ্জার অসাধারণ ব্যবস্থা ছিল। সেখান থেকে বের হয় আমরা হাটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে সামনে একটা বাদামের দোকান পরল আমি এবং মিজান বাদাম কিনে খেতে খেতে আবার হাঁটতে শুরু করলাম।
সামনে যেতেই দেখলাম ডিঙ্গি নৌকার বাহার তখন মিজন নৌকা ওয়ালাকে বলল নৌকা কি আপনারা ভাড়া দেন। তখন নৌকা ওয়ালা জবাব দিল হ্যাঁ। আমরা নৌকা ভাড়া দেই। তখন আমি মিজান কে বললাম চলো আমরা একটু চলনবিল পানি উপভোগ করি। তখন দুজনেই নৌকাতে উঠে পড়লাম এবং মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল বাতাস থাকার কারণে মাঝি নৌকার পাল তুলে দিল। কিছুদূর যাওয়ার পরে মাঝি ভাওয়াইয়া গান ধরল গানটা ছিল এইরকমঃ ও মাঝি বাইয়া যাও রে অকুল দরিয়ার মাঝে আমার ভাঙ্গা নাও রে মাঝি বাইয়া যাও রে। অসাধারণ কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আমাদের কিনারায় নামিয়ে দিল। তখন আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম ছোট বড় বৃদ্ধ যুবক সবাই সকল ভেদাভেদ ভুলে এক অন্যরকম আনন্দ উপভোগ করছে সে আনন্দটা বলে বুঝানোর মতো নয়। হঠাৎ আমার আকাশের দিকে চোখ পড়ল চোখ পড়তেই দেখলাম এক ঝাঁক পাখি তাদের নিয়মে আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। সেই দৃশ্যটা ও ভুলার মত নয়। ফেরার সময় আমরা অনেক গল্প করলাম তখন মিজান আমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিল আর সেগুলো হলোঃচলন বিল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি বৃহৎ বিল। চলন ববিললের আয়তন ১০৮৫ বর্গ কিলোমিটার এটি রাজশাহী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ এবং পাবন জেলা জুড়ে বিস্তৃত । চলন বিলের সার্বিক গভীরতা ৪মিটার এবং গড় গভীরতা ২মিটার। চলন বিলের মোহনীয় সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। এই বিলে বালিহাঁস, গাংচিল, পানকৌরি প্রভূতি রংবেরঙের পাখি বাস করে। তাছাড়া চলন বিল হল মাছের ভান্ডার। এখানে শোল, টাকি, টেংরা, চিংড়ি, গজার, চিতল, সিং, বোয়াল, দারকিনা, পুটি, সহ নানা ধরনের নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। তাছাড়া বাংলাদেশের কৃষি খাতের ফলনের বড় একটা অংশ চলন বিলের কৃষকরাই সরবরাহ করে। এখানকার মানুষরা সাবলীল। তারা একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকতে ভালোবাসে।
আমি তথ্য গুলো শুনে খুবই আনন্দ পেলাম চলনবিল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার জীবনের সবগুলো ভ্রমণের অভিজ্ঞতার চাইতে ভিন্ন। চলনবিল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমি আ¤্রত্রু মনে রাখব। কারণ আমি শিহরিত, আমি বিমোহিত চলনবিল তোমার সৌন্দর্যে।