এডমিট কার্ড
অনন্ত পৃথ্বীরাজ
পত্রিকা খুললে আজকাল দুঃসংবাদই বেশি চোখে পড়ে। ডেঙ্গুর মহামারি আকার ধারণ, রোহিঙ্গাদের মানবতর জীবন সংগ্রাম, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ক্রয় কেলেংকারিসহ শত শত নেতিবাচক খবরে সংবাপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ভরপুর। সত্তর উর্দ্ধ বয়সে এখন বেঁচে থাকার আশা ম্লান হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দূর-দুরন্ত থেকে দু’একটি চিঠি আসে। পড়ে আনন্দ পাই। পুরনো দিনগুলো তখন হাতছানি দিয়ে ডাকে। নস্টালজিক হয়ে পড়ি। হারোনো দিনগুলো ফেরত পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ফেলে দিন কখনোই ফেরত পাবার নয়। আজ অনেক দিন পর ধূসর খামে ভরে একটি চিঠি এসেছে। চিঠিটি লিখেছে আবির নামের এক পুরনো ছাত্র। এক সময় শিক্ষক ছিলাম। এখন আর নেই। রিটার্মেন্টের প্রায় একযুগ পূর্ণ হয়ে গেল। ছেলেটি এখন মিনিস্ট্রিতে চাকরি করছে। এডিশনাল সেক্রেটারি। সরকারি আমলা। আরও দু’ একজন চিঠি লেখে। মাঝে মাঝে ফোন করে। এই চিঠিগুলো আমাকে খুব আশা জাগায়। যতœ করে রেখে দিয়ে বারবার পড়ি। ভালো লাগে। হারানো সময় কলমের কালো অক্ষরে রাঙা হয়ে ওঠে। বাসায় আমরা দুই বুড়োবুড়ি-ই থাকি। ছেলেমেয়েরা তাদের সংসার করে। ব্যস্ত সময়। যে যার মত আলাদা। সবাই ভালো থাকার চেষ্টা করে। করুক ! এখন আর তেমন কেউ দেখা করতে আসে না। শরীর ভেঙ্গে পড়ছে। মন বিষণœ থাকে। শিক্ষক হিসেবে অনেকেই এখন আমাকে চেনে না। চার দেয়ালে মধ্যেই আমাদের দিন রাত চলে যায়। তারপরও ভালো আছি। তবে মাঝে মাঝে দু’একটা চিঠিপত্র এলে মনে ভরসা পাই। এ যেন আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। অতীতের সাথে বর্তমানকে মেলাতে গিয়ে মোক্তার স্যার নস্টালজিক হয়ে পড়লেন। তিনি হারিয়ে গেলেন ত্রিশ বছর আগের কোনো এক দিনে।
আজ রবিবার। আগামীকাল থেকে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা শুরু হবে। সপ্তম শ্রেণির ক্লাসটিচার মোক্তার স্যার আজ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এডমিট কার্ড বিতরণ করবেন। হেড মাস্টারের কড়া নির্দেশ এডমিট কার্ড ছাড়া কাউকে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এ্যাসেম্বিলির পর প্রথম পিরিয়ডের ক্লাস। হাজিরা খাতা, মার্কার, ডাস্টার, বই, পাঠ উপকরণসহ মোক্তার স্যার এ্যাসেম্বিলি গ্রাউন্ডের দিকে যাচ্ছেন। পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলায় মেইল টিচার্স ডরমেটরি। মোক্তার স্যার সিঁড়ি বয়ে নিচে নামবেনÑ এমন সময় পিয়ন জুলফিকারের সাথে দেখা।
আস্লামুলাইকুম। কেমন আছেন স্যার ?
ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো জুলফিকার ?
জ্বি স্যার, ভালো আছি। হিসাব শাখা থেকে এই কাগজটি আপনার কাছে পাঠিয়েছে।
ঠিক আছে । তোমাকে ধন্যবাদ জুলফিকার।
পিয়ন জুলফিকার চলে গেলে মোক্তার স্যার সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে কাগজটিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বকেয়ার হিসাব। বেশ লম্বা লিস্ট। সব মিলিয়ে অন্তত হাজার পঞ্চাশেক টাকার কেস। কাগজটির এক কোণে পেন্সিল দিয়ে লেখা, ‘বকেয়া পরিশোধ ব্যতীত কাউকে এডমিট কার্ড দেবেন না।’ মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল শিক্ষকদের এই এক জ্বালা। এখানে শিক্ষকদের কেরানি থেকে আদায়কারী পর্যন্ত সব কাজই করতে হয়। মোক্তার স্যার তাই মনে মনে বিরক্তি প্রকাশ করতে গিয়েও পারলেন না। মুখে যতই কঠোর ভাব দেখান না কেন মোক্তার স্যারের মনটা বড্ড নরম। তাছাড়া তিনি কোনোদিন কারও ওপর রাগ করে থাকতে পারেন না। আর কেউ না জানুক তার শিক্ষার্থীরা সবাই এ কথা জানে।
এখন আষাঢ় মাস। বর্ষাকাল। কিন্তু বৃষ্টি নেই। বাইরে রোদের তাপে ভ্যাবসা গরম। বেলা বাড়ার সাথে সাথে শহরের বাতাসে যেন আগুন ঝরে। সকালে সবার অফিসে যাবার তাড়া। কিন্তু এ সময়; হয় কলে পানি থাকে না ; না হয় চুলায় গ্যাস নেই অথবা ঘরের ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। সব সম্ভবের দেশে রাজ্যের সমস্যা ! রাস্তায় বের হলেই নিত্য ট্রাফিক জ্যাম । অফিসে সময়মত পৌঁছানোর তুমুল যুদ্ধ হয় প্রত্যহ। তারপরও অভিভাবকেরা চেষ্টা করেন অফিসে যাবার পথে ছেলেমেয়েকে স্কুলে ড্রপট করে দিতে।
সপ্তাহে তিনদিন স্কুলের মাঠে এ্যাসেম্বিলি বসে। স্কুল ড্রেস পরে ছাত্রছাত্রীরা যখন সারিবদ্ধভাবে এ্যাসেম্বিলিতে দাঁড়ায় তখন দেখতে কী যে ভালো লাগে ! না দেখলে লিখে বুঝানো যাবে না। মনে হয় যেন আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পরীরা নেমে এসে নীরবে প্রার্থনায় দাঁড়িয়েছে। জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও শপথ বাক্য পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শৃঙ্খলা, সততা, দেশপ্রেম ও আদর্শ মানুষ হওয়ার মন্ত্রণা লাভ করে।
এখন সকাল ৮:০০ টা। এসেম্বিলি শেষে মোক্তার স্যার এখন ক্লাসে ঢুকেছেন। তিনি বাংলা শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীদের হাজিরা নেওয়ার পর তিনি এখন এডমিট কার্ড বিতরণ করবেন। তবে তার আগে বকেয়া টাকার হিসেবটা কষে নিলে সুবিধা হয়। অনেকের টিউশন, পরীক্ষার ফি পরিশোধ হয়নি। ক্লিয়ারেন্স দেখে এডমিট কার্ড বিতরণ করতে হবে। নাম, রোল ডেকে মোক্তার স্যার এডমিট কার্ড বিতরণ করছেন। বকেয়া পরিশোধ না করেই এ সময় এডমিট কার্ড পাওয়ার জন্য কেউ কেউ কাকুতি-মিনতি করতে শুরু করল। মোক্তার স্যার খেয়াল করলেন বকেয়া পড়া ছেলেমেয়েদের অনেকের বাবা ব্যবসায়ী, কেউ কেউ বাড়িওয়ালার ছেলে, অন্যদের অভিভাবক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এবার মোক্তার স্যারের কঠোর হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না ! সবাইকে এডমিট কার্ড দিতে না পারায় স্যারের মনটাও ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
মোক্তার স্যার যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সেটি একটি প্রাইভেট স্কুল। শহরের ধনী, টাকা-পয়সাওয়ালা লোকের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়াশোনা করে। আসলে পড়াশোনা নামে মাত্র। নিরাপদে সময় কাটানোর জন্য আসা যাওয়া করেÑ এই আর কী ! চটকদার বিজ্ঞাপন, বাইরের চাকচিক্য আর ভেতরের তকমা দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আদলে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গরিবের ছেলেমেয়েদের পড়ার জায়গা এটা নয়। বাবা মায়ের মন তা বোঝে না। প্রত্যেক বাবা-মা’ই চান তার ছেলেমেয়ে ভালো পরিবেশে, ভালো স্কুলে লেখাপড়া করুক। তাদের জীবন আর ক’দিন। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, খেয়ে না খেয়ে সন্তানের লেখাপড়ার জন্য খরচ জোগান তারা। ভালো রেজাল্ট করে কোনো একদিন এই ছেলেমেয়েরাই তাদের মুখ উজ্জ্বল করবেÑ এই আশায় বুক বেঁধে থাকেন। এ যেন সব থার্ড ক্লাস সেন্টিমেন্ট। সামান্য আয় অথচ সংসারে রাজ্যের খরচ। অল্প রোজগারে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে সংগ্রাম করে আর পেরে ওঠেন না। স্কুলে বকেয়া পড়ে যায়। মাসে মাসে তা ক্রমেই বাড়তে থাকে। নিমিষেই মোক্তার স্যারের চোখের সামনে তখন ভেসে ওঠে এক হতদরিদ্র বাবার মুখচ্ছবি। যিনি ছেলেকে পরীক্ষা দেয়ানোর জন্য হেডমাস্টারের কামড়ার সামনে মাথা ঠুকছেন। হেডমাস্টার সাহেব সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘বকেয়া শোধ করে দিতে না পারলে ছেলেকে পরীক্ষা দেওয়াতে পারবেন না। প্রয়োজন মনে করলে টিসি নিয়ে যান। অন্য কোথাও ফ্রি পড়ান গিয়ে। দাতব্য খুলে বসলে আমাদের চলে না।’
ছেলেদের চিৎকারে মোক্তার স্যার সংবিৎ ফিরে পেলেন। ক্লাসের এককোণে জড়োসড়ো হয়ে চুপচাপ বসে আছে আবির নামের এক ছাত্র। ওর দিকে চোখ পড়তেই মোক্তার স্যার একটু বিব্রত হলেন। আবির মেধাবী ছাত্র। কিন্তু ইদানিং একদম পড়াশোনায় মনোযোগ নেই। গায়ের পোশাক-পরিচ্ছদ তেমন পরিপাটি নয়। চুলে ঠিক মত চিরুনি লাগায় না। কিছু জিজ্ঞাসা করলে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, আর কাঁদে। ওর বাবা ছিলেন একজন দিন মজুর । কিন্তু গত কয়েক মাস তিনি আর স্কুলে আসেন না। কী এক অজ্ঞাত কারণে আবিরের বেশ ক’মাসের টিউশন ফি বাকি। তিনি এ ব্যাপারে আবিরকে কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না। মনে এক ধরনের চাপা কষ্ট নিয়ে মোক্তার স্যার ক্লাস শেষ করে চলে গেলেন।
সন্ধ্যায় মোক্তার স্যার সাধারণত বাসাতেই থাকেন। প্রাইভেট টিউশন প্যাক্টিসে তিনি যান না। যা পড়ানো তিনি তা ক্লাসেই সম্পন্ন করে দেন। ফলে অন্তত তার বিষয়ে ছাত্রছাত্রীরা স্যারদের পিছনে দৌড়ানোর হাত থেকে রক্ষা পায়। তাঁর আরও একটি গুণ আছেÑ তা হলো তিনি শিক্ষার্থীবান্ধব। মোক্তার স্যারের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। তিনি কলটা রিসিভ করলেন। এক ভদ্র মহিলার ফোন। ও পাশ থেকে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথা বলছেন। ‘‘স্যার, আমি আবিরের মা বলছি। আমরা এখন খুব বিপদের মধ্যে আছি। গত দুই মাস আগে আবিরের বাবা মারা গেছেন। আমাদের পরিবারে উপার্জন করার মতো দ্বিতীয় আর কেউ নেই। এদিকে রাজ্যের ধার-দেনা; স্বামীর মৃত্যুর পর সবাই একসাথে চাপ দিয়েছে। আমি এখন সামাল দিয়ে উঠতে পারছি না ! একটু দয়া করুন, আমাকে কিছু দিনের সময় দিন। আমি বিদ্যালয়ের সব পাওনা পরিশোধ করে দেব। রক্ত বিক্রি করে হলেও, স্কুলের সব দেনা পরিশোধ করে দেব, স্যার।’’
পুনশ্চ : আবির পরীক্ষার হলে পরীক্ষা দিচ্ছে। মোক্তার স্যার খাতা সই করতে এসেছেন। স্যারকে দেখে আরিব পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার জন্য নিচু হতেই মোক্তার স্যার ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন বললেন, “পড়াশোনার খরচের টাকার জন্য আর কোনো দিন চিন্তা করবি না। মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবি। বড় হয়ে মাকে দেখিস। তুই ছাড়া তোর মায়ের আর কেউ নেই।’’
লেখক কথাসাহিত্যিক ও এম. ফিল গবেষক ।