গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ
ম্যাজিক রিয়েলিজমের গুরু
ফুয়াদ আল আবির
“মানুষ নাকি বুড়ো হয়ে যায় তাই স্বপ্ন দেখে না। ডাহা মিথ্যে কথা!
মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায় তাই সে বুড়ো হয়ে যায়।”
ম্যাজিকাল রিয়েলিজম বা জাদু বাস্তবতা, সাহিত্যের এমন এক মোহনীয় ধারার সাথে সারা পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেন এ সময়ের একজন শক্তিশালী লেখক। তাকে সময়ের গন্ডিতে বেঁধে ফেলা অবশ্য ভুল হলো। কেননা, মোটে চল্লিশ বছর বয়েসে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন শতবছরের নিঃসঙ্গতাকে। স্প্যানিশ ভাষায় তার সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্যের সম্পদে পরিণত হয়েছিলো তার জীবদ্দশাতেই, পেয়েছেন তার স্বীকৃতিও। চতুর্থ লাতিন আমেরিকান হিসেবে নোবেল পান তিনি।
তিনি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। ডাকনাম গ্যাবো, জন্ম ১৯২৭ সালের ৬ই মার্চ, উত্তর কলম্বিয়ার এরাকাতাকা শহরে। ফার্মাসিস্ট বাবার কাজের কারণে শৈশবে নানা-নানীর কাছে মানুষ। গ্যাবোর নানী ছিলেন একজন অসাধারণ গল্পবলিয়ে। অদ্ভূতুড়ে জিনিসকে এমনভাবে বর্ণনা করতেন যেন মনে হত তিনি তা চাক্ষুষ দেখেছেন। নানারকম ভূত-প্রেত, আত্মা, অলৌকিক বিষয়াদির বইয়ে ভর্তি ছিলো তাদের বাড়ি। গ্যাবো তার সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাদু বাস্তবতার যে প্রকাশ করেছেন, তার প্রথম পাঠ নেন এভাবেই, নানীর কাছে। নানীর এই গল্প বলার ধরণ তার সবচেয়ে বিখ্যাত বই ঙহব ঐঁহফৎবফ ণবধৎং ড়ভ ঝড়ষরঃঁফব- কে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলো বলে মনে করেন গ্যাবো।
গ্যাবোর নানাও কিন্তু কম যান না! ‘হাজার দিনের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত কলম্বিয়ার গৃহযুদ্ধে তিনি লিবারেল পাট্রি কর্নেলের দায়িত্ব পালন করেন। স্বভাবতই তার শেখানোর পদ্ধতি ছিলো ভিন্ন। তিনি শেখাতেন বিভিন্ন অভিধান থেকে, সার্কাসে নিয়ে যেতেন প্রতি বছর। গ্যাবো তার নানাকে ডাকতেন ‘পাপালেও’ বলে। পাপালেও প্রায়ই একটা কথা বলতেন গ্যাবোকে-
‘তুমি কল্পনা করতে পারবে না, একটা লাশ কতটা ভারি হতে পারে!’
শিশু গ্যাবোর মনে এই কথাটি গভীরভাবে দাগ কাটে। নানার সৈনিক জীবন থেকে পাওয়া এমন আরো অনেক উপলব্ধি পুনরাবৃত্তি হয়েছে মার্কেজের রচনায়।
‘গ্যাবো’ কিংবা পরিণত বয়েসে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বিশ্বসাহিত্যের আরেক কিংবদন্তী ফ্রানৎজ কাফকার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন মার্কেজ। ১৯৪৭ সালে গ্যাবো ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব কলম্বিয়া’য় আইনে ভর্তি হন বাবার ইচ্ছায়। সেখানেই প্রথম পরিচয় হয় কাফকার সাহিত্যের সাথে, ‘লা মেটামরফোসিস’ বা ‘রূপান্তর’-এর মাধ্যমে। বিষয়বস্তু না, কাফকার লেখার ধরণ তাকে আন্দোলিত করে, যেন শৈশবের নানা-নানীর কাছ থেকে শোনা গল্পগুলো ফিরে আসে তার কাছে। পৃথিবীর ইতিহাসে অগণিত পাঠক আর সাহিত্যবোদ্ধাদের মত মার্কেজও আন্দোলিত হয়েছিলেন মেটামরফোসিসের প্রথম বাক্যটি পড়ে:
“ঘুম থেকে উঠে গ্রেগস সামসা দেখলো সে পোঁকা হয়ে গেছে!”
এরপর থেকেই মার্কেজ সিরিয়াস সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন এবং কিছুদিন পর ‘এল এসপেক্তেদোর’ পত্রিকায় ‘তৃতীয় পদত্যাগ’ নামে একটি গল্প প্রকাশিত হয়। স্কুলে থাকতেই লেখালেখির শুরু হলেও গ্যাবোর সাহিত্যিক হয়ে ওঠার শুরুটা তখন থেকে।
আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি মার্কেজ। ভর্তি হওয়ার পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এক নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে কলম্বিয়া। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায় অনির্দিষ্টকালের জন্য এবং তার পেনশনের কার্ডটি পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। পরে তিনি চলে যান ‘ইউনিভার্সিটি অব কার্টেগানা’য়। সেখানে সাংবাদিকতায় লেখাপড়া শুরু করেন এবং ‘এল ইউনিভার্সাল’ পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। পরে সাংবাদিকতায় এতোটাই ঝুঁকে পড়েন যে, পাশ করবার আগেই লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে চলে যান বারাঙ্কুইলিয়া শহরে, ‘এল হেরাল্ডো’ পত্রিকার সাংবাদিক হয়ে।
তার প্রথম বড় কাজ, ঞযব ঝঃড়ৎু ড়ভ ধ ঝযরঢ়ৎিবপশবফ ঝধরষড়ৎ। মূলত ‘এল এসপেক্তেদোর’ পত্রিকার জন্য লেখাটি মোট চৌদ্দ কিস্তিতে প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। কলম্বিয়া নৌবাহিনীর একটি জাহাজ চোরাচালানির পণ্যের অতিরিক্ত ভারে ডুবে গিয়েছিল। সে জাহাজের একজন নাবিক ছিলেন লুইস আলেজান্দ্রো ভ্যালেসকো। সাগরের বুকে তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম লেখাটির মূল উপজীব্য। মার্কেজ পুরো উপাখ্যানটি লিখেছিলেন উত্তম পুরুষে এবং বেনামে! লেখাটি প্রকাশ পেয়েছিলো নাবিক ভ্যালেসকোর সাক্ষর নিয়ে। পরে ১৯৭০ সালে প্রথমবারের মতো বই আকারে লেখাটি প্রকাশিত হলে তাতে গ্যাবোর নাম দেখা যায়। এটি মূলত তার সাংবাদিক জীবনের কাজ, সাহিত্যিক কিংবা ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি তা লেখেননি। তিনি ‘এল এসপেক্তেদোর’ পত্রিকার হয়ে ভ্যালেসকোর সাক্ষাৎকার নেন এবং তার পরবর্তীতে উত্তম পুরুষে পুনর্লিখন করেন। বইটি প্রসঙ্গে গ্যাবো বলেন, ঙহব ঐঁহফৎবফ ণবধৎং ড়ভ ঝড়ষরঃঁফব লেখার পূর্বে কোনো সম্পাদক কিংবা সাহিত্য সমালোচক লেখাটিকে দামই দেননি!
লেখাটি ১৯৫৫-তে প্রথম প্রকাশের পর মার্কেজ তৎকালীন জেনারেল গুস্তাভো রোহাস পিনিয়া সরকারের চক্ষুশূল হন এবং তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। তখন তিনি বেশ কিছু বছর রোম, প্যারিস, বার্সেলোনাসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বিদেশী সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন।
নিঃসঙ্গতার একশ বছর বা ঙহব ঐঁহফৎবফ ণবধৎং ড়ভ ঝড়ষরঃঁফব গার্সিয়া মার্কেজের শ্রেষ্ঠ রচনা। মূলত এ উপন্যাসের জন্যই তিনি ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান। এ বইটি লেখার পেছনের গল্পটি ভারি চমৎকার। আঠারো বছর বয়সে গ্যাবোর ইচ্ছে হয় তার শৈশবের নানা বাড়ি এবং সেই মানুষজন-আসেপাশের অনুসঙ্গ নিয়ে কিছু লিখবেন। কিন্তু কলমে লেখা আসছিলো না ঠিক যেমনটি তিনি চাচ্ছিলেন। তাই তিনি সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে থাকেন। অনেক বছর বাদে, তিনি তার পরিবার নিয়ে আকাপুলকো যাচ্ছিলেন গাড়ি করে। হঠাৎ তাঁর মনে হয় সেই সঠিক সময়টি এসে পড়েছে, তিনি হয়তো পেয়ে গেছেন তার লেখার সকল উপজীব্য আর ঢঙ। তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা বাসায় ফিরে আসেন এবং লিখতে বসেন। তিনি এতোটাই নিরবিচ্ছিন্নভাবে লিখতে চেয়েছিলেন যে সব কাজকর্ম ছেড়ে দেন এবং পরিবারের খরচ মেটাবার জন্য গাড়িটি বিক্রি করে দেন।
যদিও তিনি যেমনটি আশা করেছিলেন, তার চেয়ে ঢের বেশি সময় লেগেছিলো উপন্যাসটি শেষ করতে। টানা আটারো মাস লেখার পর ১৯৬৭ সালে বইটি প্রকাশ পায়। এ পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী বইটি বিক্রির পরিমাণ ৩০ মিলিয়নেরও অধিক কপি এবং অনুবাদিত হয়েছে ৩৭ ভাষায়। গোটা বিশ্বসাহিত্যে এমন আর কোনো বই দেখা যায়নি যা প্রকাশের পরপরই পাঠকপ্রিয়তার এমন তুঙ্গে উঠতে পেরেছিলো, সাথে সাথে অনেক বেশি আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলো ক্রিটিকদের দ্বারা। বাংলায় বইটির অনুবাদ করেন জি এইচ হাবিব, ২০০০ সালে প্রথম বের হয় বইটি।
মার্কেজ তার শৈশবের শহরের আদলে তৈরি করেছিলেন একটি শহর ‘মাকোন্দো’। সেই শহরের বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্ম নিয়ে তৈরি হয় গল্পের কাঠামো। শুরুতে আমাদের সামনে আসে জোসে আর্কেদিও বুয়েন্দিয়া আর তার স্ত্রী উরসুলা ইগোরান। তারা ঠিক করেছিলেন কলম্বিয়া ছেড়ে যাবেন নতুন আবাসের খোঁজে। পথে এক নদীর ধারে রাত্রিযাপনের জন্য অবস্থান করেন তারা এবং জোসে এক অদ্ভূত শহর ‘মাকোন্দো’ স্বপ্নে দেখেন। ঘুম থেকে উঠে তিনি স্থির করেন, নদীর তীরেই তিনি তৈরি করবেন সেই শহরটি। এরপর নানা ঘাত প্রতিঘাতে এগিয়ে যেতে থাকে কাহিনী। ইতিহাস, সংস্কার – কুসংস্কার, বাস্তব – অবাস্তব – কল্পনা, যৌনাতা – অযাচার, ফ্যান্টিসি আর পরাবাস্তব জগতের এমন মিশেল পাঠক এবং সাহিত্যবোদ্ধা দুইকেই নিয়ে যায় উপলব্ধির চূড়ায়।
অনেক সাহিত্যবোদ্ধা মনে করেন, ঙহব ঐঁহফৎবফ ণবধৎং ড়ভ ঝড়ষরঃঁফব এর পর খড়াব রহ ঃযব ঞরসব ড়ভ ঈযড়ষবৎধ বা ‘কলেরার দিনগুলোতে প্রেম’ মার্কেজের সেরা কাজ। বইটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৮৫ সালে স্প্যানিশে এবং ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ পায় তার তিন বছর পর। বইটি থেকে ২০০৭ সালে মুভি অ্যাডাপশান করা হয় একই নামে। মার্কেজ বলেছেন, এ গল্পেরও সূচনা তার ব্যক্তি জীবনে। মূলত তার বাবা-মায়ের জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছিলেন বইটি। এ উপন্যাসটি ছাড়াও মার্কেজের অন্যান্য উপন্যাস এবং ছোটগল্প থেকে থিয়েটার এবং ফিল্মে অ্যাডাপশন হয়েছে বহুবার। এমনকি ঞযব ইষঁব খড়নংঃবৎ এর পরিচালক ছিলেন স্বয়ং মার্কেজ।
তবে গ্যাবো মনে করেন, ঞযব অঁঃঁসহ ড়ভ ঃযব চধঃৎরধৎপয তাঁর সেরা কাজ। ১৯৭৫ সালে প্রকাশ পায় বইটি। এ উপন্যাসে তিনি বর্ণনা করেছেন এক ক্যারিবিয় একনায়কের কথা। সাহিত্যবোদ্ধাদের মত, এ স্বৈরশাসককে কলম্বিয়ার কুখ্যাত স্বৈরশাসক জেনারেল গুস্তাভো রোহাস পিনিয়ার আদলে রূপায়িত করতে চেয়েছিলেন মার্কেজ, যার কারণে বাধ্য হয়ে স্বদেশ ত্যাগ করতে হয় মার্কেজকে।
ঞযব অঁঃঁসহ ড়ভ ঃযব চধঃৎরধৎপয বইয়ের মলাট
ঞযব অঁঃঁসহ ড়ভ ঃযব চধঃৎরধৎপয; ছবিসত্ত্ব: ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্লগ
কিউবার সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রনায়ক ফিদের ক্যাস্ট্রোর ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন গ্যাবো। ছিলেন কলম্বিয়ার বামঘেষা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। এই অভিযোগে বহুবছর যাবৎ তাকে ভিসা দেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শেষে বিল ক্লিনটন প্রশাসন নব্বইয়ের দশকে মার্কেজের উপর থেকে এই অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ক্লিনটন মার্কেজের লেখার একজন একনিষ্ঠ গুণগ্রাহী ছিলেন। কৈশোরের উচ্ছাসপূর্ণ দিনগুলোতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামারও সঙ্গী হতো মার্কেজের বই।
মার্কেজের মার্কেজ হয়ে ওঠার পেছনে একটা বড় নিয়ামক তার ছোটগল্পগুলো। জাদু বাস্তবতার যে বিস্তর প্রয়োগ তিনি উপন্যাসে করেছেন, ছোটগল্পে অতোটা করেননি কিংবা বলা যায়, ছোটগল্পে সেভাবে করার সুযোগ হয়নি। তিনি বলতেন এভাবে,
“ছোটগল্প হলো আর্চার বোর্ডে নিশানা করা আর ঠিক সময় ঠিক জায়গায় আঘাত করা এবং উপন্যাস হলো বিশাল দূর্গম কোনো বনে একটা খরগোশের খোঁজ করতে থাকা।”
১৯৯৯ সালে গার্সিয়া মাকের্জের লিম্ফাটিক ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং ২০১২ সালের দিকে স্মৃতি বিলোপ হতে শুরু করে। তার দুই বছর বাদেই ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন এই কথাশিল্পী। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস তাঁকে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কলম্বিয়ান’ হিসেবে অভিহিত করেন। তার মৃত্যুতে তিনদিনের রাষ্টীয় শোক পালন করেন কলম্বিয়াবাসী। প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই কালোত্তীর্ণ এই কলমশিল্পীকে।
ম্যাজিক রিয়েলিজমের গুরু
ফুয়াদ আল আবির
“মানুষ নাকি বুড়ো হয়ে যায় তাই স্বপ্ন দেখে না। ডাহা মিথ্যে কথা!
মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায় তাই সে বুড়ো হয়ে যায়।”
ম্যাজিকাল রিয়েলিজম বা জাদু বাস্তবতা, সাহিত্যের এমন এক মোহনীয় ধারার সাথে সারা পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেন এ সময়ের একজন শক্তিশালী লেখক। তাকে সময়ের গন্ডিতে বেঁধে ফেলা অবশ্য ভুল হলো। কেননা, মোটে চল্লিশ বছর বয়েসে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন শতবছরের নিঃসঙ্গতাকে। স্প্যানিশ ভাষায় তার সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্যের সম্পদে পরিণত হয়েছিলো তার জীবদ্দশাতেই, পেয়েছেন তার স্বীকৃতিও। চতুর্থ লাতিন আমেরিকান হিসেবে নোবেল পান তিনি।
তিনি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। ডাকনাম গ্যাবো, জন্ম ১৯২৭ সালের ৬ই মার্চ, উত্তর কলম্বিয়ার এরাকাতাকা শহরে। ফার্মাসিস্ট বাবার কাজের কারণে শৈশবে নানা-নানীর কাছে মানুষ। গ্যাবোর নানী ছিলেন একজন অসাধারণ গল্পবলিয়ে। অদ্ভূতুড়ে জিনিসকে এমনভাবে বর্ণনা করতেন যেন মনে হত তিনি তা চাক্ষুষ দেখেছেন। নানারকম ভূত-প্রেত, আত্মা, অলৌকিক বিষয়াদির বইয়ে ভর্তি ছিলো তাদের বাড়ি। গ্যাবো তার সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাদু বাস্তবতার যে প্রকাশ করেছেন, তার প্রথম পাঠ নেন এভাবেই, নানীর কাছে। নানীর এই গল্প বলার ধরণ তার সবচেয়ে বিখ্যাত বই ঙহব ঐঁহফৎবফ ণবধৎং ড়ভ ঝড়ষরঃঁফব- কে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলো বলে মনে করেন গ্যাবো।
গ্যাবোর নানাও কিন্তু কম যান না! ‘হাজার দিনের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত কলম্বিয়ার গৃহযুদ্ধে তিনি লিবারেল পাট্রি কর্নেলের দায়িত্ব পালন করেন। স্বভাবতই তার শেখানোর পদ্ধতি ছিলো ভিন্ন। তিনি শেখাতেন বিভিন্ন অভিধান থেকে, সার্কাসে নিয়ে যেতেন প্রতি বছর। গ্যাবো তার নানাকে ডাকতেন ‘পাপালেও’ বলে। পাপালেও প্রায়ই একটা কথা বলতেন গ্যাবোকে-
‘তুমি কল্পনা করতে পারবে না, একটা লাশ কতটা ভারি হতে পারে!’
শিশু গ্যাবোর মনে এই কথাটি গভীরভাবে দাগ কাটে। নানার সৈনিক জীবন থেকে পাওয়া এমন আরো অনেক উপলব্ধি পুনরাবৃত্তি হয়েছে মার্কেজের রচনায়।
‘গ্যাবো’ কিংবা পরিণত বয়েসে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বিশ্বসাহিত্যের আরেক কিংবদন্তী ফ্রানৎজ কাফকার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন মার্কেজ। ১৯৪৭ সালে গ্যাবো ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব কলম্বিয়া’য় আইনে ভর্তি হন বাবার ইচ্ছায়। সেখানেই প্রথম পরিচয় হয় কাফকার সাহিত্যের সাথে, ‘লা মেটামরফোসিস’ বা ‘রূপান্তর’-এর মাধ্যমে। বিষয়বস্তু না, কাফকার লেখার ধরণ তাকে আন্দোলিত করে, যেন শৈশবের নানা-নানীর কাছ থেকে শোনা গল্পগুলো ফিরে আসে তার কাছে। পৃথিবীর ইতিহাসে অগণিত পাঠক আর সাহিত্যবোদ্ধাদের মত মার্কেজও আন্দোলিত হয়েছিলেন মেটামরফোসিসের প্রথম বাক্যটি পড়ে:
“ঘুম থেকে উঠে গ্রেগস সামসা দেখলো সে পোঁকা হয়ে গেছে!”
এরপর থেকেই মার্কেজ সিরিয়াস সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন এবং কিছুদিন পর ‘এল এসপেক্তেদোর’ পত্রিকায় ‘তৃতীয় পদত্যাগ’ নামে একটি গল্প প্রকাশিত হয়। স্কুলে থাকতেই লেখালেখির শুরু হলেও গ্যাবোর সাহিত্যিক হয়ে ওঠার শুরুটা তখন থেকে।
আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি মার্কেজ। ভর্তি হওয়ার পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এক নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে কলম্বিয়া। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায় অনির্দিষ্টকালের জন্য এবং তার পেনশনের কার্ডটি পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। পরে তিনি চলে যান ‘ইউনিভার্সিটি অব কার্টেগানা’য়। সেখানে সাংবাদিকতায় লেখাপড়া শুরু করেন এবং ‘এল ইউনিভার্সাল’ পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। পরে সাংবাদিকতায় এতোটাই ঝুঁকে পড়েন যে, পাশ করবার আগেই লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে চলে যান বারাঙ্কুইলিয়া শহরে, ‘এল হেরাল্ডো’ পত্রিকার সাংবাদিক হয়ে।
তার প্রথম বড় কাজ, ঞযব ঝঃড়ৎু ড়ভ ধ ঝযরঢ়ৎিবপশবফ ঝধরষড়ৎ। মূলত ‘এল এসপেক্তেদোর’ পত্রিকার জন্য লেখাটি মোট চৌদ্দ কিস্তিতে প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। কলম্বিয়া নৌবাহিনীর একটি জাহাজ চোরাচালানির পণ্যের অতিরিক্ত ভারে ডুবে গিয়েছিল। সে জাহাজের একজন নাবিক ছিলেন লুইস আলেজান্দ্রো ভ্যালেসকো। সাগরের বুকে তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম লেখাটির মূল উপজীব্য। মার্কেজ পুরো উপাখ্যানটি লিখেছিলেন উত্তম পুরুষে এবং বেনামে! লেখাটি প্রকাশ পেয়েছিলো নাবিক ভ্যালেসকোর সাক্ষর নিয়ে। পরে ১৯৭০ সালে প্রথমবারের মতো বই আকারে লেখাটি প্রকাশিত হলে তাতে গ্যাবোর নাম দেখা যায়। এটি মূলত তার সাংবাদিক জীবনের কাজ, সাহিত্যিক কিংবা ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি তা লেখেননি। তিনি ‘এল এসপেক্তেদোর’ পত্রিকার হয়ে ভ্যালেসকোর সাক্ষাৎকার নেন এবং তার পরবর্তীতে উত্তম পুরুষে পুনর্লিখন করেন। বইটি প্রসঙ্গে গ্যাবো বলেন, ঙহব ঐঁহফৎবফ ণবধৎং ড়ভ ঝড়ষরঃঁফব লেখার পূর্বে কোনো সম্পাদক কিংবা সাহিত্য সমালোচক লেখাটিকে দামই দেননি!
লেখাটি ১৯৫৫-তে প্রথম প্রকাশের পর মার্কেজ তৎকালীন জেনারেল গুস্তাভো রোহাস পিনিয়া সরকারের চক্ষুশূল হন এবং তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। তখন তিনি বেশ কিছু বছর রোম, প্যারিস, বার্সেলোনাসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বিদেশী সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন।
নিঃসঙ্গতার একশ বছর বা ঙহব ঐঁহফৎবফ ণবধৎং ড়ভ ঝড়ষরঃঁফব গার্সিয়া মার্কেজের শ্রেষ্ঠ রচনা। মূলত এ উপন্যাসের জন্যই তিনি ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান। এ বইটি লেখার পেছনের গল্পটি ভারি চমৎকার। আঠারো বছর বয়সে গ্যাবোর ইচ্ছে হয় তার শৈশবের নানা বাড়ি এবং সেই মানুষজন-আসেপাশের অনুসঙ্গ নিয়ে কিছু লিখবেন। কিন্তু কলমে লেখা আসছিলো না ঠিক যেমনটি তিনি চাচ্ছিলেন। তাই তিনি সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে থাকেন। অনেক বছর বাদে, তিনি তার পরিবার নিয়ে আকাপুলকো যাচ্ছিলেন গাড়ি করে। হঠাৎ তাঁর মনে হয় সেই সঠিক সময়টি এসে পড়েছে, তিনি হয়তো পেয়ে গেছেন তার লেখার সকল উপজীব্য আর ঢঙ। তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা বাসায় ফিরে আসেন এবং লিখতে বসেন। তিনি এতোটাই নিরবিচ্ছিন্নভাবে লিখতে চেয়েছিলেন যে সব কাজকর্ম ছেড়ে দেন এবং পরিবারের খরচ মেটাবার জন্য গাড়িটি বিক্রি করে দেন।
যদিও তিনি যেমনটি আশা করেছিলেন, তার চেয়ে ঢের বেশি সময় লেগেছিলো উপন্যাসটি শেষ করতে। টানা আটারো মাস লেখার পর ১৯৬৭ সালে বইটি প্রকাশ পায়। এ পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী বইটি বিক্রির পরিমাণ ৩০ মিলিয়নেরও অধিক কপি এবং অনুবাদিত হয়েছে ৩৭ ভাষায়। গোটা বিশ্বসাহিত্যে এমন আর কোনো বই দেখা যায়নি যা প্রকাশের পরপরই পাঠকপ্রিয়তার এমন তুঙ্গে উঠতে পেরেছিলো, সাথে সাথে অনেক বেশি আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলো ক্রিটিকদের দ্বারা। বাংলায় বইটির অনুবাদ করেন জি এইচ হাবিব, ২০০০ সালে প্রথম বের হয় বইটি।
মার্কেজ তার শৈশবের শহরের আদলে তৈরি করেছিলেন একটি শহর ‘মাকোন্দো’। সেই শহরের বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্ম নিয়ে তৈরি হয় গল্পের কাঠামো। শুরুতে আমাদের সামনে আসে জোসে আর্কেদিও বুয়েন্দিয়া আর তার স্ত্রী উরসুলা ইগোরান। তারা ঠিক করেছিলেন কলম্বিয়া ছেড়ে যাবেন নতুন আবাসের খোঁজে। পথে এক নদীর ধারে রাত্রিযাপনের জন্য অবস্থান করেন তারা এবং জোসে এক অদ্ভূত শহর ‘মাকোন্দো’ স্বপ্নে দেখেন। ঘুম থেকে উঠে তিনি স্থির করেন, নদীর তীরেই তিনি তৈরি করবেন সেই শহরটি। এরপর নানা ঘাত প্রতিঘাতে এগিয়ে যেতে থাকে কাহিনী। ইতিহাস, সংস্কার – কুসংস্কার, বাস্তব – অবাস্তব – কল্পনা, যৌনাতা – অযাচার, ফ্যান্টিসি আর পরাবাস্তব জগতের এমন মিশেল পাঠক এবং সাহিত্যবোদ্ধা দুইকেই নিয়ে যায় উপলব্ধির চূড়ায়।
অনেক সাহিত্যবোদ্ধা মনে করেন, ঙহব ঐঁহফৎবফ ণবধৎং ড়ভ ঝড়ষরঃঁফব এর পর খড়াব রহ ঃযব ঞরসব ড়ভ ঈযড়ষবৎধ বা ‘কলেরার দিনগুলোতে প্রেম’ মার্কেজের সেরা কাজ। বইটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৮৫ সালে স্প্যানিশে এবং ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ পায় তার তিন বছর পর। বইটি থেকে ২০০৭ সালে মুভি অ্যাডাপশান করা হয় একই নামে। মার্কেজ বলেছেন, এ গল্পেরও সূচনা তার ব্যক্তি জীবনে। মূলত তার বাবা-মায়ের জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছিলেন বইটি। এ উপন্যাসটি ছাড়াও মার্কেজের অন্যান্য উপন্যাস এবং ছোটগল্প থেকে থিয়েটার এবং ফিল্মে অ্যাডাপশন হয়েছে বহুবার। এমনকি ঞযব ইষঁব খড়নংঃবৎ এর পরিচালক ছিলেন স্বয়ং মার্কেজ।
তবে গ্যাবো মনে করেন, ঞযব অঁঃঁসহ ড়ভ ঃযব চধঃৎরধৎপয তাঁর সেরা কাজ। ১৯৭৫ সালে প্রকাশ পায় বইটি। এ উপন্যাসে তিনি বর্ণনা করেছেন এক ক্যারিবিয় একনায়কের কথা। সাহিত্যবোদ্ধাদের মত, এ স্বৈরশাসককে কলম্বিয়ার কুখ্যাত স্বৈরশাসক জেনারেল গুস্তাভো রোহাস পিনিয়ার আদলে রূপায়িত করতে চেয়েছিলেন মার্কেজ, যার কারণে বাধ্য হয়ে স্বদেশ ত্যাগ করতে হয় মার্কেজকে।
ঞযব অঁঃঁসহ ড়ভ ঃযব চধঃৎরধৎপয বইয়ের মলাট
ঞযব অঁঃঁসহ ড়ভ ঃযব চধঃৎরধৎপয; ছবিসত্ত্ব: ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্লগ
কিউবার সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রনায়ক ফিদের ক্যাস্ট্রোর ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন গ্যাবো। ছিলেন কলম্বিয়ার বামঘেষা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। এই অভিযোগে বহুবছর যাবৎ তাকে ভিসা দেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শেষে বিল ক্লিনটন প্রশাসন নব্বইয়ের দশকে মার্কেজের উপর থেকে এই অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ক্লিনটন মার্কেজের লেখার একজন একনিষ্ঠ গুণগ্রাহী ছিলেন। কৈশোরের উচ্ছাসপূর্ণ দিনগুলোতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামারও সঙ্গী হতো মার্কেজের বই।
মার্কেজের মার্কেজ হয়ে ওঠার পেছনে একটা বড় নিয়ামক তার ছোটগল্পগুলো। জাদু বাস্তবতার যে বিস্তর প্রয়োগ তিনি উপন্যাসে করেছেন, ছোটগল্পে অতোটা করেননি কিংবা বলা যায়, ছোটগল্পে সেভাবে করার সুযোগ হয়নি। তিনি বলতেন এভাবে,
“ছোটগল্প হলো আর্চার বোর্ডে নিশানা করা আর ঠিক সময় ঠিক জায়গায় আঘাত করা এবং উপন্যাস হলো বিশাল দূর্গম কোনো বনে একটা খরগোশের খোঁজ করতে থাকা।”
১৯৯৯ সালে গার্সিয়া মাকের্জের লিম্ফাটিক ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং ২০১২ সালের দিকে স্মৃতি বিলোপ হতে শুরু করে। তার দুই বছর বাদেই ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন এই কথাশিল্পী। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস তাঁকে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কলম্বিয়ান’ হিসেবে অভিহিত করেন। তার মৃত্যুতে তিনদিনের রাষ্টীয় শোক পালন করেন কলম্বিয়াবাসী। প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই কালোত্তীর্ণ এই কলমশিল্পীকে।