একটি মৃত্যুর কিচ্ছা-আশিক বিন রহিম



এক
গল্পের শুরুটা হতে পারতো চাঁদগঞ্জের জেলা কারাগার দিয়ে। স্টেশনের একজন পাগল হত্যার দায়ে সাংবাদিক তারেক মাহমুদ হাজতের নবাগত কয়েদী। কিন্তু ময়না নামের ভবঘুরে পাগলীর জন্ম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে। তাই ঘটনার বাহাত্তর ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও তারেক মাহমুদের হাতে এখনো হাতকড়া পড়েনি। তাছাড়া ময়নার মৃত্যু অনেকটা অনিবার্য ছিলো বলে লোকের ধারণা। স্টেশনে পা ফেলেছে এমন কোনো মানুষ নেই, যে ময়নার মৃত্যু চেয়ে খোদার কাছে অাপিল করেনি। সর্বশেষ পঁচিশটা দিন আর রাত সে প্লাটফর্মের কংক্রিটের উপর পরে ছিলো। তার ওপর এক পলক দৃষ্টি রেখে অনেকেই বলতেন ‘এতো কষ্ট না দিয়া আল্লায় অরে লইয়া যাইতে পারে না?’ একরাতে সত্যি সত্যিই ময়নাকে আল্লাহ্ নিয়ে গেলো। কিন্তু আল্লাহর কাছে ময়নার এই চলে যাওয়াকে ভোলা দা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। স্টেশনের ঝাড়ুদার ভোলা লাশের মুখে চুনের মতো সাদা লালা দেখেছিলো। ফর্সা রংয়ের ময়নার মুখটা ‘মরার পরে নাকি পাতিলের তলার মতো কালো দেখা গছে। পৃথিবী দেখার পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই তার ধারণা ‘ময়নারে কেউ বিষ খাওয়াইয়া মারছে’। কিন্তু ঝাড়ুদার বলে ভোলার কথা কেউ আমলে নেয়নি।

ময়না তদন্ত ছাড়াই ময়নার মৃত শরীরটা বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দুপুরের মধ্যেই মাটি চাপা দেয়া হয়েছিলো। দায়িত্বশীল নগর কর্তৃপক্ষ যানে ‘লাশটা দ্রুত মাটি চাপা না দিলে চাঁদগঞ্জের বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াবে। এতে পরিবেশ দুষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এতোসব ঘটনা তিন দিন আগেই গত হয়েছে। অথচ ভয়ের ভূতটা তারেক মাহমুদকে এখানো তাগাদা দিচ্ছে। গত তিনদিন তার নাওয়া খাওয়া প্রায় বন্ধ। দিনের বেলা ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ আর রাতে বাড়ির ছাদে শুয়ে থেকে সময় কাটছে তারক মাহমুদের। এই খারাপ সময়ে একমাত্র সিগারেট-ই তাকে সঙ্গ দিচ্ছিলো। আজ সিগারেট শেষ। দিনের আলো কিছুটা কমে আসতে দেখে দোতলা বাড়ির সবগুলো সিঁড়ি ভেঙে তারেক মাহমুদ রাস্তায় নেমে আসেন। বাড়ির সামনের বড় রাস্তার পাশে একটা টং দোকান। কাছে যেতেই দোকানি আচমকা প্রশ্ন করে, চাইরোমিহি কি চান তারেক ভাই, কাউরে খুঁজতাছেন? 
উত্তর না আসায় দোকানি আবারো প্রশ্ন করে ‘ভাইরে এমন দেহা যাইতাছে ক্যান ?
কথা না বাড়িয়ে ২ প্যাক সিগারেট অর্ডার করে তারেক। লাল রঙের দু’প্যাক গোল্ডলিফ সিগারেট এগিয়ে দেয় দোকানি। ওখানে দাড়িয়ে প্যাকেট খুলে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে জোরে টান দেয় তারেক। এরপর ভয়টাকে রাস্তায় ফেলে সিগারেটের পায়ে চুমু দিতে দিতে দোতলা বাড়ির সিঁড়ি ভাঙ্গে। ছাদে ওঠে শেওলা জমা কংক্রিটের উপর চিত হয়ে শুয়ে পরে। উঁচু একটা দালানের আড়ালে লুকানো চাঁদটা আবছা দেখা যাচ্ছে। চাঁদের বুকে নিরব দৃষ্টি ফেলে ক্ষণিক চেয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পরে মৃত্যুর চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে যাওয়া সিগারেটের আগুন দিয়ে আরেকটা সিগারেট জ্বালায়। আগুন নিভে গেলে ভয়ের সাপটা দোতলার ছাদ অব্দি পৌছে যাবে; এই ভয়ে একটার পর একটা সিগারেটে আগুন দেয়া চলতে থাকে। আকাশে বিছানো মেঘের গালিচায় চোখ রাখে তারেক। এবার ভাবনার সাঁকোটা আপনা-আপনিই দীর্ঘ থেকে আরো দীর্ঘ হতে থাকে। তিন দিন ধরে মাথার মধ্যে জেঁকে বসা পরিচিত প্রশ্নগুলো আবারো ধানের চারার মতো শিকড় গজায়। নিজেকে নিজে করা প্রশ্নগুলোর কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। সত্যিই কি সে নিজেই ময়নাকে হত্যা করেছিলো? নাকি কি এই হত্যার সাথে অন্য কেউ জড়িত? তবে কে এই হত্যাকারী। সে কি তারেক নিজে, নাকি ওর ভেতরে বাস করা অন্ন কেউ। এই হত্যার জন্য আসলে কে দায়ী? যার কলমের তুলিতে সমাজের সুন্দর আর রুগ্নতার প্রতিচ্ছবি আঁকা হয়। যে হাত অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, সেই হাত কখনোই মানুষের নিঃশ্বাস থামাতে পারে না। তারেক মাহমুদ নিজেও জানে; এই খুনটা সে করেনি। খুনটা তবে কে করেছে?। সিগারেটের আয়ু কমে আসে, চোখে তন্দ্রাদেবী হানা দেয়। একটা সময় শেওলাযুক্ত ছাদের উপর ঘুমিয়ে পরে তারেক মাহমুদ।


দুই
গল্পটার শুরু একটি কাঠগড়া দিয়ে। যেখানে সাংবাদিক তারেক মাহমুদ হাত জোড় করে দাড়িয়ে আছেন। সম্মুখ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে একই অবয়বের একজন হাকিম। তিনি হাত ঘড়িতে ঈষৎ দৃষ্টি রেখে কাঠের হাতুড়িতে টেবিলে কয়েকটা আঘাত করেন। হাকিম সাহেবের অর্ডার, অর্ডার ধ্বনিতে শুরু হয় বিচারকার্য। তারেক মাহমুদ বলতে লাগলো, আমি একজন সংবাদকর্মী। যার মৃত্যুর জন্য আমি অভিযুক্ত হলাম সে ছিলো স্টেশনের একজন ভবঘুরে পাগল। প্রায় আড়াই বছর পূর্বে যৌবনপূর্ন দেহ নিয়ে এই শহরে তার আগম। এখানকার প্রতিটা অলি-গলি আর স্টেশনগুলো সে দাপিয়ে বেড়াতো। কি তার পরিচয়, অথবা কার দেয়া নাম ‘ময়না’ সে কথা এই শহরের মানুষগুলো জানতো না। তবে এখানকার প্রতিটা গোপন গলির কংক্রিট আর ধুলোবালি জানতো নষ্ট রাতে গোপনে অনেক পুরুষই ময়নার শরীর পড়েছে। রাতের ভাজে ভাজে ময়না শরীরময় বহু পুুরষের ওষ্ঠ লালা লেপ্টে গেছে। একটা বাসি পাউরুটির বিনিময়ে তার শরীর যে কেউ খুলতে পারতো। এসব মানুষগুলো অন্ধকারে ময়নার নোংরা পোশাক আর দুর্গন্ধময় শরীর দেখতো না। ওরা দেখতো ময়না কতটা নারী, কতটা নরম তার শরীর। এসব রাতপশুদের পাপজলে একটা সময় ময়নার পেট আগুনে পোড়া রুটির মতো ফুলে ওঠে। পেটের সাথে সখ্য গড়ে শহরের মানুষগুলোও বদলে যায়। ক’মাস আগেও যাদের চোখ সোনার আংটির মতো রাতের ময়নাকে খুঁজে নিতো হঠাৎ করেই তারা বদলে যায়। এরপর কেউ আর ময়নাকে খেতো না, খাবারও দিতো না। এক রাতে গোপনে ময়নার পেট থেকে খসে পরে পাপজল। ময়নার কোলজুড়ে কেঁদে ওঠে ফুটফুটে কন্যা সন্তান। দু’রাত পার না হতেই স্টেশনের আনসার কালু মিয়া হাত ধরে শিশুটি বিক্রি হয় সমাজকর্মী জোহরা চৌধুরীর কাছে। যার ব্যবসায়ী স্বামী লিঙ্গ প্রতিবন্ধী। সন্তানের শোকে পাথর ময়না যেখানে-সেখানে ঘাপটি মেরে বসে থাকেন। এভাবে ছয় মাস পার হয়। একটা সময় ময়নার শরীরে বিভিন্ন অসুখ বাসা বাঁধে। তার পঞ্চান্ন কেজির দেহটা ত্রিশ কেজিতে নেমে আসে। একটা সময় হাজারো পুরুষের দৃষ্টির খোরাক ময়না যেনো চামড়াওয়ালা কঙ্কাল বনে যায়। নিরীহ রেল-লাইনের মতো প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে স্থান হয় তার। ওখানেই শেষবারের মতো শুয়ে পড়ে। ময়নার উপর দিয়ে বয়ে চলে টানা সাতাশ দিনের রোদ-বৃষ্টি। মৃত্যুর প্রার্থনায় সাতাশ দিনের অপেক্ষা। এই দীর্ঘ সময় একই ভঙ্গিতে শুয়ে থাকায় ময়নার শরীরের সিংহভাগ পঁচে যায়। বিষয়টা নিয়ে পত্রিকায় অনেকগুলো রিপোর্ট করেছি; কাজ হয়নি। ময়নার কষ্টে পথের ফুল, গাছের পাতা কাঁদলেও একজন মানুষকে কাঁদতে দেখিনি। মানুষগুলো উল্টো নাক চেপে বলতো ‘পাগলডা আর মরার লাইগা জায়গা পাইলো না’। এক রাতে বাড়ি ফেরার পথে ময়নার কষ্ট দেখে আমি কাঁদলাম। মৃত্যুর জন্য ওর এই অপেক্ষা, আর পঁচে যাওয়া শরীরের নিষ্ঠুর যন্ত্রনা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না। হঠাৎ করেই ময়নার চিন্তা আমাকে শূন্যতার মতো জড়িয়ে ধরে। একরাতে সমস্ত চিন্তাকে কবর দিয়ে এক সিদ্ধান্তে স্থির হলাম ‘ময়নাকে আমি মুক্তি দিবো’। এরপর শুরু হয় আমার নতুন সংগ্রাম, ময়নাকে মুক্তি দেয়া। হঠাৎ করেই বহু রুপে আমি বিভক্ত হয়ে পারলাম। একটা আমি ময়নাকে বিষমাখা রোটি খাওয়াতে পা-বাড়াই তো আরেকটা আমি ওই পা’য়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করি। একটা আমি ময়নার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলে, আরেকটা আমি কাঁদি। এভাবেই একদিন কাঙ্খিত সেই রাত নেমে আসে। রাতটা পূর্নিমা ছিলো। চাঁদের আলো আস-পাশের সব কিছু চেনা যেতো। সেই রাতে আমার হাতে ময়ন তারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। হঠাৎ ওয়ার্ডার ওয়ার্ডের শব্দে উপস্থিত সবাই চমকে দেয় হাকিম। অর্ডার, অর্ডার, বলে তিনি হাত ঘড়ির দিকে দৃষ্টি ফেলেন। সাংবাদিক তারেক মাহমুদের চোখে কান্নার মিছিল। ওর্ডার, অর্ডার...।
হাকিম সাহেব বলছেন... ‘আজকের মতো কোর্ট এখানেই মুলতবি করা হলো।





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট