দীর্ঘশ্বাসের পর খুঁজতে যাই ঘুমের বড়ি
ইলিয়াস বাবর
তাজ্জব হয়ে যেতে পারি তবে আশ্চর্য হই না। তারও কারণ আছে অবশ্য-
আমাকে শোয়ার খাটে প্রায়-ঘুমন্ত দেখে ভাগিনারা
আওয়াজ খেয়ে ফেলে। তারা ইশারায় দরোজা খোলে, বন্ধ করে। আমি আড়চোখে-তখনো ঘুমপরি আমার চোখে
আসেনি তার শক্তিমত্তা নিয়ে, ফলে আমি লুকোচুরি খেলি ঘুমের সাথে, ভাগিনাদের সাথে। খাটের
দারুন আরামদায়কতায় চোখ বন্ধ করতে চেষ্টা করি কিন্তু দিনান্তের যাবতীয় প্যাচাল মনের
পর্দায় ভেসে ওঠে- তারই অপপ্রচার আর বেহুদা জ¦ালাফালায় আমি পিঠ বেডের সাথে লাগালেও বুক
থাকে উপরের দিকে। নিজের সাথেই একটু বোঝাপড়া করতে চেষ্টা করি- থাক না ওদের কৈশোরের নানান
কাজ, মাঝরাতে তাদের ভদ্রহাসি আর মার্জিত আচরণ আমাকে নিয়ে যায় কোন এক শূন্য দীঘিতে।
সেখানে দীঘির চিকচিক জলে হয়তো পদ্ম হাসে না, মাছেদের লাফালাফিতে মাছরাঙা আসে না কখনো,
আসে বালকের দীর্ঘশ্বাস! আমাদের কী কখনো দীঘির দিকে যেতে দিয়েছে? অজানা এক জুজুর ভয়ে
আমরা সংবরন করতাম লোভের রঙিন সামিয়ানা। কখনোসখনো, দুপুরের তপ্তরোদে- মায়েদের ঘুমিয়ে
রেখে ঠিকই উপভোগ করতাম রোদের সোনালু আভা। ঝিমধরা
রোদাল হাওয়া ঠিকই দেখতাম দীঘির পাড়ে, রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে থাকা তেতুঁল গাছটা। তেতুঁল
গাছের ভয় জাগানিয়া ইতিহাস কৈশোরের পাড়ে নাড়া দিতে না পারলেও হা হা হাসতাম বেঘোরে। কেউ
একজন চাচাগোছের, আমাদের দেখলে ধমক দিতো, হুংকার দিতো লক্ষিছাড়া বলে। লক্ষিছাড়া হতে
পারি কিন্তু সময়য়লা হবার সুযোগে আমরা উদোম দৌড়তাম, উপভোগ করতাম জীবনের মধু।
এখন সময় কাটে টাকা গুনে, ব্যবসায়ি হয়ে গেলাম রীতিমতো। তাও পরের
ধনে পোদ্দারি! বাইরে যাওয়ার সুবাদে নানা কিছিমের মানুষ দেখি মানুষের চেহারা দেখি। ফেসবুকে
নানা ধরণের পোস্ট আর ভাস্কর্য বনাম মূর্তি বিষয়ক কথাবার্তায় হাসির ফোয়ারা ঝরে মানুষের
কী আর কোন কাম নাই? বেহুদা প্যাচালে কেনইবা নিজের খেয়ে অন্যের গরু দৌড়ায়! ডিগবাজী তো
কম দেখালি না মাওলা! যাহোক মনের আকাশে রঙ আসতে তো আর সময় লাগে না। ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাওয়ার পরিবেশে আমরাও মহা পদ্ধতি হবার ধান্ধায়
থাকি। আরে মিয়া জানেন- ওরা কী করে? না জানুক তবে, ওরাই যখন তার দরবারে থাকে তখন ধোয়া
তুলসি পাতা। ভাই কানে কানে বলি- এভাবে নিজের নাম পচাতে নেই! কী লাভ বলুন তো? অন্যের
সামনে নিজের জিঘাংসু রূপটি মেলে ধরার! কান কেটে পরের যাত্রা ভাঙতে পারাতে যদি আনন্দ
লাগে তবে তাই করুন প্রিয় ভাই। আমরা কিন্তু জেনে যাই, কে বা কারা চেতনার ফেরিয়লা হয়ে
দূরের মেহমানকে নিজের ঘরে আসতে নিষেধ করেন তারই ভায়ের আমন্ত্রণে। ধুর, ওসব কেন মাথায়
আসছে আমার? আসলে হলো কি? আপন মানুষদের দেয়া যন্ত্রণাগুলো তিলে তিলে ঢুকে যায় অন্দরঘরে।
ঘুরেফিরে মাথায় আসে অবসরের কালে- আমাকে হত্যা করে! ব্যক্তি আমাকে হত্যা করতে না পারুক,
আমার আশা কিংবা বিশ্বাসকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয় নিজেরই অভিজ্ঞতার সামনে। মানুষের
বহুরূপ, মানুষেরই বহুবিভায় আমরা উদ্বেল হই; ফিরে যাই ন্যাংটা হয়ে দুনিয়ায় নিজের জানান
দেয়ার প্রথম অভিঘাতের কথা।
আমি তবে সময় খতম করার তালে বসে আছি! স্মার্টফোন যদি কাছে থাকার
পরেও একজন মানুষকে দূরের নির্জন দ্বীপে নিয়ে যেতে পারে তবে মানুষ কাছে থেকে কী কচুও
কাটতে পারবে না! ম্যাসেঞ্জারে কেউ কেউ ঢু মারে দিয়ে যায় অভিনব সব তথ্য; কেউবা খবরাখবর
নেয়, বউপোলার হদিস নেয়, পেট-পিঠের ধান্ধা ধরিয়ে দেয়। কখনো নিরুত্তর থাকি, কখনোবা মুখর
মনের খেয়ালে। তারপরেও বেখেয়ালে বানান ভুলের মামলায় আমার মান-অভিমান হয়, জোয়ার-ভাটা
আসে। কবিতাটবিতা নিয়ে অত মাথাব্যথা কেন বাপু ওসব তো এখন সম্পর্কের নতুন নাম! কে কতোটা
নিবেদিত, শ্রমেঘামে জীবনকে চিনে উগরে দিতে চায় কাগজের বুকে কিংবা কী-বোর্ডের মাতাল
হাওয়ায়। শব্দরা অসহায় হয়ে উঠুক, পাঠকের ভেতরে কাঁপন আসুক তবুও কবিতাকে আমরা বেইজ্জতি
করতে কুণ্ঠিত হই না। গল্পরা হয়তো বেঁচে যাওয়ার আনন্দে খিলখিল করতে পারে, তারাও পার
পায় না রাতে ডিনারের আমন্ত্রণে বিকেলে নাস্তার টেবিলে। পা-চাটারা বেদম বিহারে উদযাপন
করে শুক্রবারের সকাল। কানকথা আর ফাটামোর ফাজলামোয় টেবিলে আসে চা-পানি। হৃদয়ের আহ্বান
শুনতে না পারার বেদনা যে কত ভীষণ তা কী তলিয়ে দেখেছে সোনাবন্ধুরা? আসলে তাদের রুচিই
প্রমাণ করে কতোটা সমৃদ্ধ আর শুদ্ধতার বাহক হয়ে দিন পার করছে তারা। পাতায় পাতায় তারা
রুয়ে দিলো রুচিহীনতা আর অনুকরণপ্রিয়তার মহৎ ছবি। আমার হাসি পাওয়াটাই যদি অপরাধ হয়ে
দাঁড়ায় বন্ধু- তাতে দুঃখ নেই, সময় হয়তো চিনিয়ে দেবে মানুষের ছেলে, কে!
আমার কি না বিরহকাতর প্রাণ কেবলি মনে পড়ে মান্নান সৈয়দকে! এক
মানুষ ছিল বটে। যার কাজ ভালো, যার কাজে আলো আছে, যার কাজে সম্ভাবনার অফুরান স্ফূরণ
আছে তাকে নিয়েই তিনি লিখেছেন নানাবিধ বিভায় তাদের কাজকে মূল্যায়নের চেষ্টা করেছেন কিন্তু
আমরা তো সিরাজ-উদ-দৌলা নয় শুধু মীর জাফরের রক্তেরও উত্তরাধিকার বয়ে চলেছি! বৃদ্ধাশ্রমের
চাহিদা-উদ্যোক্তা বেড়ে যাওয়া তো নিজেদের নষ্টামির শেষ বিন্দুটিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে
দেয় জনাব! যারা মানুষের নুন খেয়ে গুন গায় তাদের নয়, সময়টা যারা নুন খেয়ে নোংরামি করে
তাদেরই! কেউবা এ সুযোগে নিজের পরিচয়কে বড়ো করে নেয় মা-বাপের চেয়েও বড়ো জ্ঞান করে সাময়িক
বাম্পারকে। কোকিল তো ঠিকই বোঝে মানুষ বোঝে না তার পরিচয়ের সীমাবদ্ধতা। নিজের দুঃখকে,
নিজেরই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মননকে এভাবে ন্যাংটা করতে নেই বন্ধু যে সময় পার করে দেই অতীত
বলে যাকে গালি দেই সে-ই তো ইতারে রের্কড হয়ে আছে! আজ না হোক, কালকের অচিন্তনীয় ভবিষ্যতে
কি তবে ফারাক রেখে যাচ্ছি না নিজেরই প্রতিকূলে! অবশ্য ছোটবেলাকার মুখোশ নিয়ে যে মানুষেরা
কাজকে বালকজ্ঞান করে তাদের কাছে শরমের বালাই নেই, থাকলে কি আর অতশত ভাওতাবাজি করতে
পারে?
সময়ের হাত ধরে আমরা এগিয়ে যেতে থাকি আর শ্রাদ্ধ করি সময়কেই!
কত কত ভীড় আর নতুনত্বের মিছিল তাতে বরং নিজেকে মানিয়ে নেয়াই আসল কাজ। নিজে বেঁচে থাকলেই
নাকি বাপের নাম ওটাই আমাকে ফানা করে দেয়, ব্যস্ত রাখে। লোভাতুর সিংহটা আলাদা করলো আমাদের
পরস্পরকে। সেই থেকে মানুষ ভাগ করতে শিখলো জায়গা-জমি। পালা করে ভাত-পানি দেয় মা-বাবাকে।
চালাক নাতিসম্প্রদায় দাদাকে দেয়া থালা কিংবা বাসন যতনে রেখে দেয় তারই বাপকে দেবার মানসে!
প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়, মানুষও নেয় বটে। মুখ দেখাদেখি বন্ধ করা অথবা খেলায় মত্ত শিশুদের
বড়োদের মন-মালিন্যের দোষে আলাদা করা নুতন সংস্কৃতি নয়। বংশ পরম্পরায় আমরা জিইয়ে রাখি
আমাদেরই স্বার্থে যেমনি সৌদিতে হামলা হলে খুশি হয় ইরান; রাশিয়া ভেজালে পড়লে হাসে আমেরিকা।
মূলত মানুষই কষ্ট পায় মানুষের ব্যাকরণে। অন্য কোনখানে, অন্য কোন প্রাণিতে এত নিগূঢ়
বিষয়াশয় না থাকতে পারে, না জানতে পারে কূট-কৌশল মানুষ তবে অগ্রগামি সবকিছুতেই। তবুও
আমরা বিশ্বাস হারাতে চাই না, বিশ্বাসহীনতার সংস্কৃতি উঠে গিয়ে স্থাপন হোক গোলাপবিনিময়।
সুরমা লাগিয়ে জুমায় যাবার আগে দেখে নেই পাশের ভাইটি কেমন আছে; হোক না অন্য ধর্মের।
মানুষকেই বর্তমান রাখতে হয় তার অভিমানের সাথে দায়ের কঠিন নিক্তি। সামাজিক লাভালাভের
সাথে দেখতে হয় পরিপার্শের আনন্দ। ব্যক্তিগত সুখদুখের সাথে মেশাতে হয় প্রতিবেশের কর্তব্য;
পরিবেশের প্রতি দায়িত্বই বা বিস্মৃত হয় কীভাবে? আসলে আমরা জড়িয়ে যাই, জড়িয়ে থাকি এবং
লোকশরমের যে ঐতিহ্যিক ইতিহাস তা লালন করি নিজেদেরই কল্যাণে। এভাবেই সুন্দর আর কল্যাণকামিতার
হাত ধরে জেগে উঠে কবিতা-গল্প-নাটক। চারপাশকে শক্ত, কখনোবা একান্তই নিজের করে দেখার
যে আনন্দ তাই তো আমাদের দিনলিপি হয়ে বসে থাকে শিয়রের কাছে!
হুদাই বাকির কথা শোনালাম ভাই নগদে লাভের কথাই তো শুনতে মন চায়!
বিজ্ঞানের দারুন উৎকর্ষতায় আমরা হয়তো বিচ্ছিন্ন হতে হতে ভুলে যাই পাশের মানুষটির কথা।
এ-কেমন রীতি তবে? বাবাকে তারই সন্তান হত্যা করতে পারে? ভাইকে ভাই? এভাবেই তো চলছে আমাদের
জীবন, সময়। আত্মহত্যাপ্রবণতার প্রবলতায় ভুলতে বসেছি, তারচে উত্তম কাজ গোলাপের চাষ;
ঘৃণা চর্চার বদলে যে বস্তিবাসির জীবন দেখাই ভালো তা কে বলবে গলা ফাটিয়ে। সবচেয়ে ভালো
হয় যদি মনখারাপের বিকেলে, নিঃসঙ্গ প্রকৃতির সাথে একটি বই নিয়ে বসা যায়। আয়নায় দেখুন
চেহারামোবারক! আশ্চর্য সুন্দর বৈভবে সে হাসবে, ভুলে যাবে অংক না মেলার দুঃখ। কিছুই
আসে না অসময়ে; কেউ-ই বাদ যায় না তার ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে সবুর করতে হয় শুধু। বিছানার
কোমলতায় নিজেকে হারিয়ে, নানা কিছিমের কথা ভর করে আমার মাথায়। উতাল-পাতাল ভাবনার সাথে
নিজেকে মিলিয়ে দেখি একবার। ধুর, যা দূরে যা যাবতীয় কষ্ট। আমার দেশের দিকেই তাকাই ঘনচোখে
কত কথা, কত তথ্য তবুও বাংলাদেশ এগিয়ে যায় তার দিকে। আমরা কি কখনো ব্রিটিশে গিয়েছি,
না পাকিস্তানে সবাই এখানে এসেছে; এর মায়াভরা বুকের সুধা সবাই পান করেছে। আমরা তো ধনিক
ঘরের মানুষ, আমরা মনিবশ্রেণির উত্তরাধিকার, তবে মনে কেন ছোট হয়ে যাবো বন্ধু! আড়চোখে
ভাগিনাদের দিকে তাকাই তাদের কোন দুঃখ নাই, হাহাকার নাই তৃপ্তিতে হাতড়ে যায় স্মার্টফোনের
শরীর। স্মার্টফোনের মৃদু আলোয় তাদের সুশ্রি মুখের ছায়ায় আমি খুঁজতে চেষ্টা করি ঘুমের
বড়ি!