বেদনা আমার জন্ম সহোদর : ইজাজ আহমেদ মিলন
-রাহাত রব্বানী
ইজাজ আহ্মেদ মিলন মূলত কবি। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি এবং নিজস্ব শৈলীর
সমন্বয়ে প্রেম ও দ্রোহের কথা ব্যক্ত করেন রূপকের অন্তরালে। নানা ছন্দময় ভঙ্গিমায় চারপাশের
দারিদ্র্য, রাজনীতি, শোষণ আর কুসংস্কারে বেড়ে উঠা চিত্র নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেন কাব্যের
পঙ্ক্তিতে। প্রেম-ভালোবাসা, দু:খ-কষ্ট, বিরহ-বেদনাও উপেক্ষিত নয় তাঁর লেখায়। ¯্রষ্টার
প্রতি অগাধ বিশ্বাসী ইজাজ তাঁর কবিতায় বারবার অদৃশ্যের দর্শন খুঁজে ফিরেছেন।
‘নষ্ট শরীর ভিজে না
রৌদ্রজলে’ শীর্ষক তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের জন্য ২০০৯ সালে লাভ করেন ইমপ্রেস টেলিফিল্ম
(চ্যানেল আই) এবং সিটি ব্যাংক প্রবর্তিত ‘সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার’। মুক্তিযুদ্ধ
বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রবর্তিত ‘ বজলুর রহমান স্মৃতি পদক ’ পেয়েছেন
বর্ষসেরা সাংবাদিক হিসেবে। বরেণ্য সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেছেন,
‘ইজাজের কবিতার হাত বেশ শক্তিশালী এবং তিনি একদিন অনেক বড় কবি হবেন, যদি তাঁর সাধনায়
ছেদ না ঘটে।’ এরপর প্রবীণ রাজনীতিক মো. রহমত আলীর পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক জীবনী নিয়ে
‘কালের আয়নায় এড. মো. রহমত আলী’ রচনা করে ব্যাপক সাড়া ফেলেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ গ্রন্থটি
প্রসঙ্গে লিখেছেন ‘এড. রহমত আলীর অর্ধ শতাব্দী-ব্যাপ্ত রাজনৈতিক জীবনের এমন অনেক অজানা
অধ্যায় ইজাজ আহ্মেদ মিলন রচিত এই গ্রন্থটিতে বর্ণিত হয়েছে, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের
ইতিহাস চর্চায় গবেষকদের কাজে লাগবে’।
কবি আল মাহমুদ লিখেছেন, ‘ইজাজের মতো তরুণ কবিই শেষ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হয়ে যান।’ ইজাজের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দেহারণ্যের ভাঁজে শূন্যতার বিলাপ’ বের হয় ২০১২ সালে। গ্রন্থটি পাঠ করে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন ‘তুমি পদ্য বাদ দিয়ে গদ্য লিখো, অনেক ভালো করবে’। হুমায়ূন আহমেদের প্রেরণায়ই প্রখর জীবনবোধের গল্প নিয়ে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ছাতিম গাছের মৃত ছায়া’ বেরিয়েছে ২০১৩ সালে। এই গ্রন্থ সম্পর্কে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন ‘ এ প্রজন্মের শক্তিমান লেখক ইজাজ আহমেদ মিলন কবিতার মতো গল্প লেখাতেও মুনশীয়ানার দেখিয়েছেন।’ কবি মহাদেব সাহা লিখেছেন, ‘ ইজাজের কবিতা আমাকে স্পর্শ করেছে।’ বরেণ্য সাহিত্যিক আনিসুল হক তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন ‘নতুন দিনের কবিরা স্পর্ধাময়, তারা কোনো প্রবীণ কবির সনদপত্রের জন্য হা করে তাকিয়ে নেই। ইজাজের কোন সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। ইজাজ বর্তমানে দৈনিক সমকালের সংবাদকর্মী হিসেবে কর্মরত আছেন। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ঘন সবুজে আচ্ছাদিত মাওনার আক্তাপাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া এই তরুণ লেখকের নানা অজানা অধ্যায় জানতে তার মুখোমুখি হয়েছেন রাহাত রাব্বানী
কবি আল মাহমুদ লিখেছেন, ‘ইজাজের মতো তরুণ কবিই শেষ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হয়ে যান।’ ইজাজের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দেহারণ্যের ভাঁজে শূন্যতার বিলাপ’ বের হয় ২০১২ সালে। গ্রন্থটি পাঠ করে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন ‘তুমি পদ্য বাদ দিয়ে গদ্য লিখো, অনেক ভালো করবে’। হুমায়ূন আহমেদের প্রেরণায়ই প্রখর জীবনবোধের গল্প নিয়ে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ছাতিম গাছের মৃত ছায়া’ বেরিয়েছে ২০১৩ সালে। এই গ্রন্থ সম্পর্কে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন ‘ এ প্রজন্মের শক্তিমান লেখক ইজাজ আহমেদ মিলন কবিতার মতো গল্প লেখাতেও মুনশীয়ানার দেখিয়েছেন।’ কবি মহাদেব সাহা লিখেছেন, ‘ ইজাজের কবিতা আমাকে স্পর্শ করেছে।’ বরেণ্য সাহিত্যিক আনিসুল হক তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন ‘নতুন দিনের কবিরা স্পর্ধাময়, তারা কোনো প্রবীণ কবির সনদপত্রের জন্য হা করে তাকিয়ে নেই। ইজাজের কোন সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। ইজাজ বর্তমানে দৈনিক সমকালের সংবাদকর্মী হিসেবে কর্মরত আছেন। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ঘন সবুজে আচ্ছাদিত মাওনার আক্তাপাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া এই তরুণ লেখকের নানা অজানা অধ্যায় জানতে তার মুখোমুখি হয়েছেন রাহাত রাব্বানী
রাহাত রাব্বানী: আপনার মূল্যবান সময় থেকে আমাদরে সময় দিচ্ছেন বলে প্রথমেই আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
করছি।
ইজাজ আহমেদ মিলন : ধন্যবাদ তোমাকেও ।
রাহাত রাব্বানী: কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লিখলেও আপনি মূলত কবি।
জীবনানন্দ দাশ তো বলেছেন,'সবাই কবি নয়, কেউে কে কবি। ।'আপনি কাকে কবি বলবেন?
ইজাজ আহমেদ মিলন: কবি শব্দটি 'কু’ ক্রিয়ামূলের বংশে প্রসূত
একটি শব্দ। 'কু' অর্থ অ-সাধারণ (নবরূপে উত্তীর্ণ) কারী। এতেই বোঝা যায়
কবি সেই মানুষ যিনি সাধারণ অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি
অথবা প্রচলিত শব্দকে নতুন রূপে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম। উইকিপিডিয়া এমনটাই বলছে। জীবনানন্দ
দাশ ‘ কবিতার কথা’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধে লিখেছেন - ‘সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। কবি
জীবনানন্দ দাশের এই অমর উক্তির সাথে দ্বিমত করার
কোন সুযোগ নেই। কবিতা লিখলেই তিনি ‘ কবি ’ হবেন এমন নয়। কবি সেই ব্যক্তি বা
সাহিত্যিক যিনি কবিত্ব শক্তির অধিকারী এবং কবিতা রচনা করেন। ফরাসি কবি র্আথার রিমবোঁদ
‘কবি’ শব্দের লিখিত সারাংশ প্রদান করেছেন ‘একজন কবি দর্শনীয় মাধ্যম
হিসেবে নিজেকে অন্যের চোখে ফুঁটিয়ে
তোলনে। তিনি একটি র্দীঘ, সীমাহীন এবং পদ্ধতিবিহীন, অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সকলরে দৃষ্টিগ্রাহ্যের বাইরে অবর্তীণ কবিতা রচনা করনে। সকল স্তরের ভালোবাসা, দুঃখ- বেদনা, উন্মত্ততা-উন্মাদনার
মাঝে নিজেকে খুঁজে পান তিনি। তিনি সকল ধরণরে বিষবাষ্পকে
নি:শেষ করতে পারনে। সেই সাথে পারেন এগুলোর সারাংশকে কবিতা আকারে সংরক্ষণ করতে।
অকথ্য দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণাকে সাথে নিয়ে তিনি অকুণ্ঠ
বিশ্বাসবোধ রচনা করে যখন, যেমন যেখানে
খুশি অগ্রসর হন। একজন অতি মানবীয় শক্তমিত্তার সাহায্যে তিনি সকল মানুষরে মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ
হিসেবে বিবেচিত হন। একজন বড় ধরণরে অর্কমণ্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে কুখ্যাত অপরাধী,
পৃথিবীর অভিসম্পাতগ্রস্থ ব্যক্তি এমনকি সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হিসেবে তিনি অভিহিত হতে
পারেন! যদি তিনি অজানা, অজ্ঞাত থেকে যান কিংবা যদি তিনি বিকৃত , উন্মত্ত, বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়েন-তারপরও শেষ পর্যন্ত তিনি নেজের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সেগুলো দেখতে পাবেন। তাই, কি হয়েছে যদি তিনি উৎফুল্লে ভেসে অশ্রুত ভেসে, নামবিহীন অজানা
বিষয়াদি ধ্বংস করনে; অন্যান্য আদিভৌতিক কর্মীরা তখন ফিরে আসবে এবং তারা পুনরায়
সমান্তরালভাবে রচনা শুরু করবে যা পূর্বেই
নিপতিত হয়েছিল।’ ‘কবি’ এবং কবিতা অনেক উচ্চ মার্গীয় একটি অধ্যায়। আমি কবিতা লেখার চেষ্টা
করি। ওগুলো কিছুই হয় না। নিজের অতৃপ্তি থেকে বলছি- কেউ আমাকে কবি বললে খুবই বিব্রত
হই। শরমে লাল হয়ে যাই। সময়ই বলে দেয়- কে কবি ! আর কে কবি নন।
রাহাত রাব্বানী: মূলত কবিতা বলতে আপনি কী মনে করেন ?
ইজাজ আহমেদ মিলন : কবির
বেদনা-অনুভূতির এ রূপান্তর -ক্রিয়া
সম্পর্কে ক্রোচে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত
করেছিলেন এভাবে - ‘ বাইরের জগতের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ বা আপন মনের ভাবনা- বেদনা
কল্পনাকে যে- লেখক অনুভূতি-স্নিগ্ধ ছন্দোবদ্ধ
তনু-শ্রী দান করতে পারেন, তাকেই আমরা কবি নামে বিশেষিত করি। ’ক্রোচের সাথে আমিও এক
মত ।
রাহাত রাব্বানী: অনেক
দিন ধরেই লেখালেখি করছেন। সফলতা পেয়েছেন ।
লেখালেখির এই প্রেরণা কোথায় পেলেন
বাব প্রেরণার উৎস কী ?
ইজাজ আহমেদ মিলন: বেদনা আমার জন্ম সহোদর। সীমাহীন বেদনা দু:খ কষ্টই আমাকে লেখার
প্রেরণা যুগিয়েছে। আমি কোথায় যেন যেতে
চাই,গভীর তদ্রাচ্ছন্ন থেকেও হাঁটি অবিরত -জাগরণে তো কথাই
নেই। আমি হাঁটছি, হেঁটে যাচ্ছি। গন্তব্যটা
আমার বেশ পরিচিত, কিন্তু পথ আমার সাথে প্রতারণা
করে যাচ্ছে ক্রমাগত , পথই আমাকে দেখায় না পথ।
আগে এক সময় সবুজ ঘাসের সাথে কথা বলতাম, তারপর ঘাসগুলো যখন ধূসরতার দখলে চলে যায় তখন
কথা বলি মাটির সাথে। চৈত্রের মধ্য কোন দুপুরে
পূর্ণিমার চাঁদ আর হাসনাহেনার গন্ধ খুঁজে খুঁজে আমি কত বার যে ক্লান্ত হয়েছি! অস্থির পৃথিবীর গন্ধ আমার কাছে লেগেছে মাকাল ফলের মতো বেরসিক। কী
যেন হারিয়েছি, কী যেন পেয়েও পেলাম
না- এমন হাহাকারের মধ্যে ডুবে থেকে চরম অস্থিরতা
আমার নিত্যসঙ্গী হয়েছে। যখন পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ আর স্বাদ নেওয়ার তৃষ্ণা মিটে যায় তখন সবুজে সবুজময় একটা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায় আমার কবিতা। কাব্যের পঙক্তি সৃষ্টি করে আমি
উপভোগ করি অপার সুখ। দু:খ আর বিরামহীন বেদনার
তাড়নায় একদিন আমি কাব্যের এই বিশাল ভুবনে হাঁটতে শুরু করি। তারপর বেশ সময় চলে
গেছে। থামিনি। পেছন থেকে কেউ কেউ আমাকে
টেনে হিঁচড়ে লাঞ্চণার জালে বন্দী করতে বারংবার চেষ্টা করেছেন। লাভ করতে পারেননি। তাদের যন্ত্রণায়
এক সময় আমি কবিতার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরাতে উদ্যত হয়েছি, বলেছি কসম খোদার ! আর এক লাইন কবিতাও লিখবো না। কিন্তু কবিতাই
আমার পেছন ছাড়ে না। কবিতা আমার সঙ্গী, বেঁচে থাকার অবলম্বন। যত দিন বাঁচি লিখেই যাবো।
সেই যে কবে শুরু করেছি। কবিতার প্রেমে ডুবে আছি আজো।
রাহাত রাব্বানী: কবিতা
লেখার ক্ষেত্রে একজন কবির ভাবনাটা আসলে কী থাকে ?
ইজাজ আহমেদ মিলন: পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষেরই ভাবনার জগত ভিন্নতর।
কারো কাছে মেঘলা আকাশ ভীষণ ভালো লাগে- কারো কাছে লাগে খারাপ। রুচিবোধটা মানুষের ভিন্ন
ভিন্ন। কবিদের ক্ষেত্রে একই রকম। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে যার ভাবনার
জগতটা বেশি প্রগাঢ় তার কবিতাও গভীরতর হয়। তবে একেক জন একেক ভাবনা নিয়ে কবিতা
লিখেন। সবার ভাবনা কখনো এক হবে না। যেমন আমার
লেখার মূল উপজিব্যই হলো দু:খবোধ। মানুষের দু:খ।
রাহাত রাব্বানী: যদি জানতে চাই,আপনি কেন কবিতা
লিখেন ?
ইজাজ আহমেদ মিলন: কবিতা হোক আর না হোক কিছু না লিখে থাকতে পারি না বলেই লেখা। আমার লেখাগুলো
আসলে লেখা হয় কিনা সেটা বিচারের ভার সময়ের কাছে।
রাহাত রাব্বানী: আমরা জানি আপনি আত্মজীবনী লিখছেন ! এতো অল্প
বয়সে আত্মজীবনী ? বইটি বের হওয়ার পর নিশ্চয়ই একটা মহল এই নিয়ে তুমূল সমালোচনায় মেতে
উঠবে। আপনার নামের ওপর থাপ্পর মেরে হয়তো কেউ কেউ টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে- প্রকাশিতব্য আত্মজীবনী
নিয়ে কিছু বলুন
ইজাজ আহমেদ মিলন : ‘ আমাকে কান্নার ভয় দেখিয়ে কোন লাভ নেই-
আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি।’ সুবীর নন্দীর গাওয়া জনপ্রিয় এই গানটির কাছে মাঝে
মাঝে আমি আশ্রয় নেই। আমাকে কান্নার ভয় দেখিয়ে কেউ কিছু করতে পারবে না। কান্না তো আমি
শিখেছি বৃষ্টির কাছে। আমার বন্ধুরা আর কতটুকু কাঁদাতে পারবে ? হ্যাঁ ঠিক বলেছো- ‘ বেদনা
আমার জন্ম সহোদর ’ শিরোনামে আমার একটি আত্মজীবনী
বেরোবে আগামী মেলায়। আত্মজীবনী লেখার ক্ষেত্রে সরকারী কিংবা বেসরকারী কোন বিধি
বিধান আছে বলে আমার জানা নেই। যে কোন শ্রেণী
পেশার মানুষ যে কোন বয়সে আত্মজীবনী লিখতে পারেন। বিশ্ববিখ্যাতরাই শুধু আত্মজীবনী লিখবেন-
বিষয়টা এমন নয়। একজন রিকশা চালক কিংবা মুচিও তার যাপিত জীবন লিপিবদ্ধ করে রাখতে পারেন।
মালালা কিন্তু আঠারো বছর বয়সে তার আত্মজীবনী লিখেছেন। তিনি বিখ্যাত বলে সকলেই মেনে
নিয়েছে। আমি তোর আর বিখ্যাত নই। সে ক্ষেত্রে কেউ কেউ হয়তো মেনে নেবে না। আমি সমুদ্রের
অনেক জল সেচেছি। ঢাকা শহরে রিকশা চালিয়েছি। অন্যের বাড়িতে কাজ করেছি। আমি একজন লড়াকু
মানুষ। বেদনাই যার সঙ্গী। আমার মনে হয়েছে আমার যাপিত জীবনটা লিখে রাখি। কারো জন্য নয়,
আমার জন্যই লিখছি। তবে কেউ যদি সেটা পড়েন তাতে আমার খুশি কিংবা অখুশি হওয়ার কিছু নেই।
আমার সমালোচকের সংখ্যা খুব বেশি না। হাতেগনা দু’চার জন। জন্মের পর থেকেই ওরা আমার পেছনে
আছে। ওরাই আমার প্রেরণা- উৎসাহ যোগায়। তারা কী সমালোচনা করবে ? সেটা মাথায় রেখেই বইটি
লিখছি।
রাহাত রাব্বানী: অনেকের ধারণা কবি হলইে নাকি প্রেমিক হতে হয়। আপনার ধারণা কী?
ইজাজ আহমেদ মিলন: প্রেম
তো প্রকৃতিগত একটি বিষয়। ঐশ্বরিক ব্যাপার।
শুধু কবি কেন - সকল মানুষই প্রেমিক। প্রেম তো আর জোর করে হয় না। কোন নারীর প্রেমের কথা যদি বলো সেটা ভিন্ন কথা।
রাহাত রাব্বানী: আপনিও কি প্রেমিক ছিলেন ?
ইজাজ আহমেদ মিলন: হ্যাঁ আমিও প্রেমিক। কৈশরের একেবারে গোড়ার
দিকে আমি একজন তরুণীর প্রেমে পড়েছিলাম। সেই মোহ এখনও আছে। তার প্রেমে এখনও আমি হাবুডুবু
খাই। ওর নাম বিউটি। জীবনকে ছন্দময় করেছে আমার
সেই প্রেমিকা। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “ মেয়েরা দুই জাতের, কোন কোন পন্ডিতের
কাছে এমনকথাই শুনেছি। এক জাত-প্রধানত মা, আর এক জাত প্রিয়া। ঋতুর সঙ্গে তুলনা করা যায়
যদি, মা হলেন বর্ষাঋতু। জলদান করেন, ফলদান করেন, নিবারণ করেন তাপ, উর্ধ্বলোক থেকে আপনাকে
দেন বিগলিত করে, দূর করে শুষ্কতা, ভরিয়ে দেন অভাব। আর প্রিয়া বসন্তঋতু। গভীর তার রহস্য,
মধুর তার মায়ামন্ত্র, তার চাঞ্চল্য রক্তে তোলে তরঙ্গ, পৌঁছয় চিত্তের সেই মণিকোঠায়,
যেখানে সোনার বীণায় একটি নিভৃত তার রয়েছে নীরবে, ঝংকারের অপেক্ষায়, যে ঝংকারে বেজে
বেজে উঠে সর্ব দেহে মনে অনির্বচনীয়ের বাণী।”
আমার প্রেমিকা হলেন বসন্ত ঋতু।
রাহাত রাব্বানী: আমরা
জানি ,আপনার চারটি কাব্যগন্থ বেরিয়েছে। প্রথম
কাব্যগ্রন্থ ‘ নষ্ট শরীর ভিজো রৌদ্রজলে’ বের হওয়ার পর চারদিকে ব্যাপক হৈচৈ শুরু হয়।
প্রথম বইয়ের জন্য আপনি পান চ্যানেল আই ( ইমপ্রেস টেলিফিল্ম) সিটি ব্যাংক প্রবর্তিত
‘ সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার। একই মঞ্চে পুরস্কার লাভ করনে অধ্যাপক আবদুল্লা
আবু সায়ীদ,সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক,কবি নির্মেৈরন্দু গুণ, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন কথাসাহিত্যিক
আনিসুল হক ও কবি হালিম আজাদ। চ্যানেল আইয়ে সরাসরি সম্প্রচারিত এই পুরস্কার গ্রহণের
অনুভুতিটা কেমন ছিল ?
ইজাজ আহমেদ মিলন: বাংলাদেশে হাতেগনা কয়েকটি দামি পুরস্কারের
মধ্যে সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার অন্যতম। পুরস্কার প্রাপ্তিটা আমাকে ভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়। যাদের সাথে আমি পুরস্কার
পেয়েছিলাম তারা প্রত্যেকেই এক একটি নক্ষত্র। বুদ্ধিজীবী। সেই অনুভূতি আমি আজও প্রকাশ
করতে পারিনি। আমার অভিধানে সেটা প্রকাশের কোন শব্দ বা বাক্য নেই। তবে পুরস্কার প্রদান
মঞ্চে বলেছিলাম ( আবেগাপ্লুত হয়ে) মনে হচ্ছে আমি নোবেল পুরস্কার পেলাম। আমার এই বক্তব্যের
সাথে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার দ্বিমত করে বলেছিলেন, অপেক্ষা করো আরো বড় কিছু পাবে।
তখন এটাকে আর নোবেলের মতো মনে হবে না।
রাহাত রাব্বানী: আপনার আরো একটি ঈর্ষনীয় সাফল্য '১৯৭১ বিস্মৃত সেই সব শহীদ'
গবেষণা মূলক লেখা। সেই লেখার জন্য পেয়েছেন
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার বজলুর রহমান
স্মৃতি পদক। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রবর্তিত এই পুরস্কারের এক লাখ টাকা ও সম্মাননা প্রদান
করেন মাননীয় স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী। 'একজন পাঠক হিসেবে
গ্রন্থটি সর্ম্পকে আপনি কী বলবনে?
ইজাজ আহমেদ মিলন : বইটি লিখতে গিয়ে কতবার যে আমি কেঁদেছি। এটা
তো হৃদয় চেড়া ইতিহাস। বইটির ভূমিকা লিখেছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় দৈনিক সমকালের বরেণ্য সম্পাদক
গোলাম সারওয়ার। তিনি লিখেছেন- ইজাজ আহ্মেদ মিলন সমকালের শ্রীপুর প্রতিনিধি। একান্তই
একজন স্বল্পবাক, আত্মমুখীন নিভৃতচারী সাংবাদিক। নিজেকে জাহির করার প্রবণতা সাংবাদিকদের
মধ্যে যথেষ্ট প্রকট। এই ব্যাধি থেকে মিলন মুক্ত বলে ওর সঙ্গে কথা হয় কদাচিৎই। স্বল্পবাকই
নয়, মিলন চলনে-বলনেও খুব নিরীহ। সম্প্রতি সে আমার সঙ্গে দেখা করে তার প্রকাশিতব্য নতুন
গ্রন্থ ‘১৯৭১ :বিস্মৃত সেই সব শহীদ’-এর ভূমিকা লেখার অনুরোধ জানাতেও সে ছিল দ্বিধান্বিত।
দেশে ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক অস্থিরতা। পেট্রোল বোমায় দ¹ব্দ হচ্ছে নারী, পুরুষ, শিশু। হাসপাতালের
বার্ন ইউনিটে মাংস পোড়ার গন্ধ, আহতদের আর্তনাদে বাতাস ভারি। ভয়ঙ্কর উত্তেজনা ও ব্যস্ততার
মধ্যে সাংবাদিকদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত। এ সময়ে কোনো পুস্তকের ভূমিকা লেখার দুরূহ
কাজ (যে কাজে আমি আদৌ অভ্যস্ত নই) সম্পন্ন করা সম্ভব নয় বলে জানালেও মিলনের করুণ মুখ
দেখে অবশেষে দু’কথা লেখার জন্য সম্মত হয়েও তাকে অনেক দিন অপেক্ষমাণ রাখতে হয়েছে। এ
জন্য কিছুটা মর্মবেদনাও অনুভব করেছি। মিলন তার নতুন বইয়ের পা-ুলিপি দেওয়ার সময় প্রকাশিত
তিনটি বইও দিল ১. পোড়ামাটির ক্যানভাসে বিরামহীন বেদনা, ২. দেহারণ্যের ভাঁজে শহৃন্যতার
বিলাপ, ৩. ছাতিম গাছের মৃত ছায়া। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নষ্ট শরীর ভিজে না রৌদ্রজলে’
পাওয়া গেল না।
মিলনের প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘১৯৭১ :বিস্মৃত সেই সব শহীদ’-এর
সূচিবদ্ধ ২৫ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার অজানা মর্মস্পর্শী কাহিনীগুলোর ওপর চকিত চোখ বুলিয়েছি।
সবগুলো পড়া হয়নি। লেখাগুলো আমাকে অশ্রুসিক্ত করেছে। স্বামী ফিরে আসবেন পথের দিকে আজও
চেয়ে থাকা শহীদজায়া আনোয়ারার কথা লিখতে গিয়ে বারবার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে মিলন। শুধু
আনোয়ারার কথা লিখতে গিয়েই নয়, অন্যদের গল্পেও আবেগ ও বেদনা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
মিলনের বাংলা একেবারেই নির্ভার, ঝরঝরে। বর্ণনার অনুষঙ্গে দৃশ্যমান হয়েছে যেন কবির চোখে
দেখা প্রকৃতি। শহীদ শামসুদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারার জবানিতে, ‘দুধভাত খুব প্রিয় ছিল তার।
সাথে কলা। আমাদের একটা গাভী ছিল। খুব সকালে উঠে রান্না শেষ করেছি। গাভীর দুধ দিয়ে ভাত
দিলাম। তিনি খেতে বসলেন। কিন্তু আমাকে ছাড়া খাবেন না। যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য বারবার
আমি অনুরোধ করেছিলাম। তিনি শুনলেন না। অনেকটা অভিমান করে সেদিন তার সাথে খেতে বসিনি।
আমি বসিনি বলে তিনিও আর খেলেন না। চলে গেলেন, অনেকটা অভিমান করে।’ এমনি করে বহতা নদীর
মতো এগিয়ে গেছে জীবনের গল্কপ্প, জীবনের বেদনা-অশ্রুপাত। তার লেখায় বারবার ফিরে এসেছে
আমাদের চারপাশের নিসর্গ, প্রকৃতি। সম্ভবত মিলন মূলত কবি বলেই প্রকৃতিতে প্রশান্তি খুঁজে
পেয়েছে। তার কবিতার প্রশংসায় দেশের সেরা কবিরা পঞ্চমুখ। কবি আল মাহমুদ, আবদুল গাফ্ফার
চৌধুরী, মহাদেব সাহা তার কবিতা ও গদ্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গদ্য লিখতে তাকে প্রেরণা
দিয়েছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও হুমায়ূন আহমেদ। তারা যে একজন যোগ্য লোককেই অনুপ্রেরণা
দিয়েছেন, তা ‘১৯৭১ :বিস্মৃত সেই সব শহীদ’ পাঠ করে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছি।
ইজাজ আহমেদ মিলন তার এলাকার বিস্মৃত শহীদদের কথা জানতে, তাদের
কথা আমাদের জানাতে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছে। জহির উদ্দিনের ‘কষ্টগুলো পাথর’
হয়ে যাওয়ার গল্প, শাহাব উদ্দিনের লাশ হয়ে ফিরে আসার কথা, গোলাম মোস্তফার ‘তেতাল্লিশ
বছরেও স্বীকৃতি না মেলা’, শামসুদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারার ‘পথপানে চেয়ে থাকা’, শহীদ খন্দকার
আবুল খায়েরের সন্তান আবুল কাশেমের যন্ত্রণার গুরুভার বেদনার অক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছে।
ইজাজ আহ্মেদ মিলনের গ্রন্থটি প্রকাশকালও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে। বাংলাদেশের
গৌরবময় স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাস করে না, যারা
মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত , যারা দেশজুড়ে
সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চাকা রুদ্ধ করতে চাইছে,
তাদের বিরুদ্ধে আমরা এখন যুদ্ধে লিপ্ত। মিলনের এই পুস্তকটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে
আরও শানিত করবে বলে আমার বিশ্বাস।
রাহাত রাব্বানী: আপনার
এই গ্রন্থের ওপর প্রায় সবগুলো জাতীয় দৈনিকেই দেশের নামজাদা লেখকরা আলোচনা লিখেছেন।
এসব প্রশংসা আপনি কভিাবে মূল্যায়ন করেন ?
ইজাজ আহমেদ মিলন: ভালোকে তো সকলে ভালোই বলবে। তবে পরিশ্রীকতরদের
গা পোড়ার গন্ধ আমি উপভোগ করেছি।
রাহাত রাব্বানী: আচ্ছা,আপনার শৈশব থেকে বর্তমান পর্যয়ে আসার পেছনের মূলে রয়েেছ পেিরশ্রম। আপনার কাছ থেকে নতুন লেখকরা কী পরামর্শ পেতে পারে ?
ইজাজ আহমেদ মিলন: পৃথিবীর কোন বিখ্যাত কিংবা সফল মানুষই ঘুম থেকে উঠে দেখেনি তিনি বিখ্যাত হয়ে গেছেন।
এর জন্য যুগে যুগে মানুষকে সাধনা করতে হয়। পড়তে হবে প্রচুর।
রাহাত রাব্বানী: আপনি
অকপটে আপনার কষ্টরে দিনগুলো লিখেছেন। সেই দিনগুলোর
কথা মনে পড়লে কি এখনও কষ্ট পান।
ইজাজ আহমেদ মিলন: এই
প্রশ্ন করার মানে খেজুর কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার বেদনাকে দগ্ধ করা ছাড়া আর
কিছুই না। লিখছি এ সব ‘বেদনা আমার জন্ম সহোদর’ বইয়ে। আমার আত্মকথনের প্রতিটি পাতাই
ভেজা।
রাহাত রাব্বানী: ধন্যবাদ আপনাকে।
ইজাজ আহমেদ মিলন: তোমাকও।
mashaallah
Reply