অলঙ্করণ : : শতাব্দী জাহিদ
ইজিবাইকের গোপন সুখ
আবু উবায়দাহ তামিম
ইজিবাইকের নামকরণ.
বাবা আমাকে ইজিবাইকটি কিনে দিয়েছিলেন ত্রিশ দিন আগে, এক মেঘলা দিনে দুপুরে। সেদিন আকাশ মেঘলা থাকার কারণে, বাবা বড় উঠোনে বসে বসে বলেছিলেন ইজিবাইকের নামটি যেন আমি মেঘলা আকাশ নামে রাখি। অর্থাৎ মেঘলা আকাশ পরিবহন বা এই জাতীয় কোনো নামে। অথচ এ নামটি রাখার সিদ্ধান্তে আসতে গিয়ে আমার আপত্তি ঠেকল একখানে গিয়ে- মেঘলা নামের একটি মেয়ের কারণে। সে আমাদের এলাকার খুব অল্প বয়সে বেড়ে ওঠা ও মা চলে যাওয়া একটি মেয়ে। চলে যাওয়া বলতে সংসার ছেড়ে চলে যাওয়া। এবং মেয়েটি ফর্সা শরীরের অধিকারী ও অতিরিক্ত হাসি অনিয়ন্ত্রণকারী। তাকে দেখে আমার মা দাদীরা প্রায় প্রায়ই বলত, এ মা ছাড়া মেয়ে খুব বেশিদিন ভালো থাকে না, খারাপ হয়ে যায় রে, দেখিস একদিন। আমি বাড়ির মহিলাদের এভাবে কথা বলা মানতে পারতাম না। কেননা একে তো তারা আজীবনই যুক্তিহীন কথা বলতে অভ্যস্ত, তাছাড়া একটি নিরীহ মেয়ের উপরে আমিও যেন অহেতুক দোষ দিতে পারতাম না। কিন্তু বছর দুয়েক যেতে না যেতে দেখা গেল- আমার মা দাদীদের কথাই অনেকটা সত্যি হয়েছে। মেয়েটির মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে।
আমাদের গ্রামের হ্যাঙলা পাতলা গড়নের ছেলেটি, যার বাবার ও তার চরিত্র সম্পর্কে গ্রামের মানুষের সম্মিলিত ধারণা একই এবং তা নেতিবাচক ছাড়া আর কিছু নয়। নেতিবাচক বলতে বাবার মতো ছেলেরও অতিরিক্ত নারী ঘেঁষা স্বভাব বা আঞ্চলিক পরিভাষায় বলতে গেলে ‘মাগিখোর’ স্বভাব; যা সবার কাছে ঘৃণিত এবং কারো কাছেই তা অজানা নয়। ছেলেটির নাম স্টিমার। সেই ছেলেটির সঙ্গে- মেঘলার কিভাবে কিভাবে যেন প্রণয় তৈরী হয়ে গেল এবং প্রকাশ্যে তারা প্রণয়ের বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। কিন্তু আমার কাছে একটা হ্যাঙলা পাতলা কিংবা চরিত্রহীন ছেলের সঙ্গে একটি মেয়ের প্রণয় তৈরী হওয়া কোনো দোষ বা অপরাধ ছিল না। বরং দোষ বা অপরাধ ছিল কিংবা আমার ইজিবাইকের নাম মেঘলা আকাশ নামে নামকরণের ব্যাপারে আপত্তির মূল কারণ ছিল মেঘলার একটি পৈচাশিক ঘটনা। ঘটনাটি এমন যে, শেষ পর্যন্ত মেঘলা ও স্টিমারের প্রেম-পরবর্তীতে বিয়ে হলো এবং কয়েকমাস যেতে না যেতে স্টিমারের ঔরসে মেঘলার গর্ভে একটি নবজাতকের প্রাণ এল। তারপর ধীরে ধীরে মেঘলার পেট ফুলতে থাকলে মানুষ সাধারণভাবে জানতে পারল তাদের ঘরে এবার সন্তান আসবে। সেই সঙ্গে স্টিমারও মানসিকভাবে বাবা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। এর বিপরীতে মেঘলা চার মাসের অন্তঃসত্তা হওয়া সত্ত্বেও হয়ত সন্তানের মা হবার প্রস্তুতি নিল না বা মা হতে চাইল না। কিন্তু তার এই মা হতে না-চাওয়ার কারণ সবার কাছেই অজানা রয়ে গেল। সুতরাং এই মা হতে না-চাওয়ার প্রেক্ষিতে একদিন সে হুট করেই কাউকে না জানিয়ে গর্ভের বাচ্চাটি অপসারণ করে ফেলল। তারপর, মেঘলার এই জঘণ্যতম কা-ে তার প্রতিবেশীরা ‘বলতে হয় তাই বলা’র মতো করে কয়েকদিন ছিঃ ছিঃ বলে চুপ রইল এবং তাতে যেন মেঘলার কিছুই এল না বা কিছুই গেল না ভাব নিয়ে সে স্বাভাবিকভাবেই দিন যাপন করতে লাগল।
মেঘলার পৈচাশিক ঘটনা এটাই, এতটুকুই। যার কারণে সেদিন, অর্থাৎ যে ত্রিশ দিন আগে ইজিবাইকটি কেনা হয়েছিল, সেদিন আমার নতুন ইজিবাইকের জন্য বাবার দেয়া ‘মেঘলা আকাশ’ নামটি রাখতে গিয়ে আপত্তি উঠে এল। বাবা বললেন,
এ নামে অসুবিধা কী?
অসুবিধা বুঝতেছি না, কিন্তু এই নামটা আমার পছন্দ হইতেছে না।
তো কী নাম রাখবি? শুনি।
দাঁড়ান দেকতেছি, কী নাম রাখা যায়! কী নাম রাখা যায়!
কী নাম রাখা যায় ইজিবাইকের জন্য, তাই ভাবতে ভাবতে অনিচ্ছাকৃতভাবে আমার ডান হাতের তর্জনী আঙুলটি আমার থুতনীর নিচে- কবুতর যেমন ঠুক ঠুক করে ধান খায় তেমন ভাবে- ঠুক ঠুক করে যাচ্ছিল। আর বাবা চেয়ারে বসে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন এ অপেক্ষায় যে, কখন আমি নামটি বলব।
একসময় নামটি আমার মাথায় নামল।
হ, পাইছি।
কী?
সুখী পরিবহন।
তার মানে?
মানে হইল, সবাই যেহেতু সুখী হইবার চায়। তাই যখন অনেকগুলি গাড়ির ভেতরে আমার ইজিবাইকে সুখী পরিবহন লিখা দেকবে। তখন তারা সবগুলি থুইয়া আমার ইজিবাইকের দিকেই আসতে চাইবে।
বাহ, দারুণ বুদ্ধি তোর।
বাবা আসলেই আমার প্রশংসা করলেন কিনা, তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি কিছুটা বোকা বোকা ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম উঠোনের পরে, ইজিবাইকের সাথে হেলান দিয়ে। তারপর বাবা মধ্যম গতির একটি নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, আচ্ছা, তাহলে তাই রাখ, ‘সুখী পরিবহন’ই রাখ ইজিবাইকের নাম। আমি বাবার কথায় হ্যাঁ সূচক কাঁধ নাড়ালাম। তারপর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে নিজের কাছে নিজেই একটি প্রশ্ন করে বসলাম, আমি এই নাম দিলাম কেন! কেনইবা নামের ভেতরে এই সুখ শব্দটা নিয়ে এলাম?
এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পেলেও, কিছু সময় পরে আমি আমার নিজের মতো করে একটি উত্তর গুছিয়ে আনলাম এবং তারপর মনে হলো সেটাই হয়ত এর সম্ভাব্য সঠিক উত্তর।
‘সুখী পরিবহণ’ নামে নামকরণের কারণ.
সুখী নামটার উদ্ভব, ধরে নিই যে আমার অসুখী হওয়া থেকেই হয়েছে। এখন কিভাবে আমি অসুখী হয়েছি অথবা আদতেই কি আমি অসুখি হয়েছি নাকি কেবল নিজেকে অসুখি অসুখি ভাবছি! হ্যাঁ, হতে পারে আমার দুটি দিন-যাপনের চিত্র একেঁ দিলে হয়ত এ বিষয়গুলো স্পষ্ট হবে।
অতীতের দিন-যাপন ঃ
যখন আমার বন্ধুরা- যাদের পাতলা পাতলা দাঁড়ি গোফ উঠে বড় হয়ে যাচ্ছে এবং তখনো প্রথমবার শেভ করেনি- তাদের কেউ কেউ জীবনে প্রথমবারের মতো প্রেম করছে ও প্রেমের শুরুর দিকে তারা খুব আনন্দময় মুহূর্ত কাটাতে শুরু করেছে নিজেদের প্রেমিকাদের সঙ্গে। তখন আমি প্রেম না-করে নিতান্তই নিরীহ একটি ছেলের ভূমিকা পালন করছি যেন। কেন প্রেম করছি না? কেননা তখনো আমার ভেতরে প্রেমের তাড়না আসেনি বা ভেতরে এমন আবেগও তৈরী হয়নি যে, আমার একটি প্রেম করা দরকার কিংবা আমার একটি প্রেমিকা থাকতে হবে। তারপর হঠাত একদিন কেন যেন মনে হলো, আদতে কি আমি নিজ থেকেই প্রেম করছি না, নাকি আমি এ প্রেম করতে অক্ষম বলেই তা আমার সঙ্গে মিলছে না? এই হঠাত করে নিজেকে কোনো বিষয়ে অক্ষম মনে হওয়ার পেছনে নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, অথবা সাইক্লোজিক্যাল সাইড থেকে বলা যায়- এটা নতুন উদয় হওয়া একটি মানসিক সমস্যা।
তো অতীতের এইসব দিনে, আমার অসুখী হয়ে ওঠা তখন থেকেই শুরু হলো, যখন আমি আমি আমার অক্ষমতা অস্বীকার করে সক্ষমতা প্রমাণের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলাম। এভাবে যে, আমাদের আশেপাশে থাকা মেয়েদের একজনকে বা সক্ষমতা প্রমাণের তাগিদে জোর পূর্বক পছন্দ করে নেয়া একজন মেয়েকে আমার সঙ্গে প্রেম করবার প্রস্তাব দিয়ে ফেললাম। মেয়েটি সম্মতি প্রকাশ না করে প্রত্যাখ্যান করল। আমি আমার সক্ষমতাকে আবারও প্রমাণের জন্য দ্বিতীয় আরেকজন মেয়েকে প্রস্তাব করলাম, অনুরূপভাবে সেও প্রত্যাখ্যান করল। তারপর তৃতীয়জন, সেটিও হলো না। ঠিক সেভাবেই না হতে হতে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠজন পার হয়ে গেলে আমি বিশ্বাস করতে শুরু করলাম আসলেই আমি এ প্রেম করতে অক্ষম। আমাকে দিয়ে এ প্রেম ট্রেম হবে না। সেদিন আমি বুঝে গেলাম, আমি এখন অসুখী রোগে আক্রান্ত। তারপর প্রেমের এ চিন্তা-ধারায় ক্লান্তি নেমে এলে আমি ভাবতে লাগলাম, তাহলে এ প্রেমের বিকল্প কিছু আছে কি আমার জন্য? যেটায় আমি সক্ষম?
হ্যাঁ, আছে। বিয়ে। এর বহুদিন পরে একদিন, যখন আমার বয়স চব্বিশে পদার্পণ করল, আমি নানাবাড়ির এলাকার একটি মেয়েকে বিয়ে করে ফেললাম। কেননা সেই বিয়েতে মেয়ের কোনো মতামতের সুযোগ ছিল না। মেয়ের বাবামার মতামতই সব। মতামতের এই ধারায় আমি নিজেকে সক্ষম ভাবারও একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেলাম যেন তখন। অথচ আমি তখনও বুঝতে পারলাম না যে, এ বিয়েই আমার জীবনে দ্বিতীয়বার অসুখী হওয়ার সূচনা করে গেল।
বর্তমানের দিন-যাপন ঃ
দ্বিতীয়বার অসুখী হওয়ার সূচনা হলো আমার বিবাহ পরবর্তী সংসার-জীবনে। এখন আমার একটি সংসার আছে। সংসারে একজন বউ আছে, তবে বাচ্চা কাচ্চা নেই। এই সংসারের বয়স মাত্র পাঁচ মাস। বিয়ের আগে বাবা মায়ের সঙ্গে থাকতাম। কিন্তু বিয়ের পর কিছুদিন পার হতে না হতে আমার আশঙ্কা হলো, হয়ত আমার বউয়ের কোনো কাজ-কর্ম দ্বারা আমার বাবা মা শুধু শুধু হতাশায় ভুগবেন বা আমাকে নিয়ে বিচলিত হবেন। যেমন তার একটা অভ্যাস ছিল, একটু দেমাগ চড়ে গেলেই সে খেকিয়ে খেকিয়ে কথা বলে উঠত। বিপরীত দিকের মানুষটি তার বয়সী কিনা, তার সঙ্গে এভাবে কথা বলাটা ঠিক হচ্ছে কিনা- এসব কিছু সে ভাবত না। যেকোন মানুষের সঙ্গেই এমন রূঢ় ব্যবহার করতে বাধত না তার, না আমার সঙ্গে, না আমার বাবা মায়ের সঙ্গে। সেজন্য আমি বুদ্ধি সুদ্ধি করে একদিন বাইরে ঘর ভাড়া নিলাম। বউকে বললাম, চলো, তুমার সুখীর জন্যিই আলাদা হইছি। বাপমা বাপমার জাগায় থাকুক, তুমি তুমার জাগায়।
সুতরাং বলতে পারি, এই পরিবার বিচ্ছেদও আমার অসুখী হওয়ার একটি কারণ।
তাছাড়া সংসার জীবনে- মূল যে সমস্যাটায় আমি ভুগছিলাম, তা হলো আমার উপার্জনাক্ষমতা। আমার একটি ভুল ছিল যে, আমি উপার্জনের শক্ত কোনো পথ ঠিক না-করেই বিয়ে করে ফেলেছি। কেননা তখন আমার প্রেম না করতে পারার অক্ষমতা আমাকে বিবাহের দিকে ঠেলে দিয়ে উপার্জনের কোনো পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয়নি। আর আমার বউ এই বড় দূর্বলতাটিকে কাজে লাগিয়ে, সে আমার সংসার জীবনকে আরো অসুখী করে তুলছে। তাই এবার পরিস্কারভাবে বলতে পারি, আমার জীবনের এই অপূর্ণতাগুলি বা না-পাওয়াগুলি অর্থাৎ, প্রেম করতে না পারা, বিবাহের পর বউয়ের কারণে পরিবার বিচ্ছিণœ হওয়া এবং আমার যথাযথ উপার্জন না-থাকাই আমার অসুখী হওয়ার কারণ। আর আমার ভেতরের এই অসুখী অসুখী ভাব থেকেই অথবা সুখী হবার আশা থেকেই- যখন আমার বাবা উপার্জনের যন্ত্র হিসাবে ইজিবাইকটি কিনে দিয়েছিলেন তখন সেটার নামকরণের সময়- সুখী পরিবহন নামটি নির্গত হলো। এবং শেষ পর্যন্ত ইজিবাইকটির নাম ‘সুখী পরিবহন’ নামেই নামকরণ করা হলো।
ইজিবাইক চালানোর একদিন.
সাধারণভাবে ইজিবাইক চালানোর মধ্য থেকে আমার কাছে বিশেষ হয়ে উঠল একটি দিন। সেদিনের সকালটি ছিল মন খারাপের। মানে আমার বউয়ের সঙ্গে ঠুনকো একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেছিল আর তাতে সকালের কোমল মনটা যেন বিষিয়ে উঠল। রাগের তীব্রতা এত হলো যে, আমি আর ভাত খেতে পারলাম না। তখনি ইজিবাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
আমি খুলনা শহরের ভেতরেই লোকাল যাত্রী নিয়ে ঘুরি। এ স্টেশন থেকে ও স্টেশন। শিরোমণি বাজার থেকে রূপসা পর্যন্ত। তারপর আবার উল্টোভাবে, রূপসা থেকে শিরোমণি বাজার পর্যন্ত।
সেদিন সকালে বেরিয়ে মনে হলো, আজ যেহেতু মন খারাপ। সুতরাং একটু ভিন্ন নিয়মে গাড়ি চালালে হয়ত মন খারাপের কথা ভুলে থাকা যাবে। এবং ভেতরে ভালোলাগা সৃষ্টি হবে। গাড়ি নিয়ে ফুলবাড়িগেট বাজার পর্যন্ত এসে আমি একটি চায়ের দোকানে বসলাম। সকালের হালকা পাতলা নাস্তা করতে। তখন আমার ইজিবাইকটি বাইরে থামানো ছিল। কিছুক্ষণ পরে আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে হঠাত দেখতে পেলাম, ত্রিশের কাছাকাছি বয়স এমন একজন নারী ও একজন পুরুষ একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এসে আমার বন্ধ ইজিবাইকের সামনে উঁকি ঝুকি মারছে। তাদের ভঙ্গী দেখে আমি বুঝতে পারলাম যে, তারা স্বামী-স্ত্রী এবং তারা ইজিবাইকে কোথাও যাবে বলে ড্রাইভার খোঁজ করছে। যেহেতু আজকে এখনো কোনো যাত্রীই আমার গাড়িতে ওঠেনি এবং তারাই প্রথম, তাই আমি ভাবলাম, তাদেরকে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। তারপর আমি বেরিয়ে এলাম।
আপনারা যাবেন কোনে?
তুমি রিজার্ভ যাবে? লোকটি প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, আপনারা চালি যাব। কোনে যাবেন? কন।
এই ধরো... আমরা নির্দিষ্ট কোথাও যাব না।
তালি?
আমরা ঘন্টা দুয়েক তোমার গাড়িতে করে ঘুরব। তুমি এই মেন রোড ধরে, দুই ঘন্টার ভেতরে যতদূর পারো আমাদের ঘুরাবে। পারবে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, পারব।
কত দিতে হবে?
২৫০টাকা দিয়েন।
তুমি কিন্তু এর ভেতরে কোনো লোকাল যাত্রী উঠাতে পারবে না।
ঠিকাছে, ঠিকাছে, বুচ্ছি।
তারা দুজন ইজিবাইকে উঠে বসলে আমি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে চালানো শুরু করলাম। বললাম, কোনদিকি যাব?
তুমি যেদিকে ভালো মনে করো। আমাদের দুঘন্টা ঘুরালেই হবে। কী বলো জান?
লোকটি তার বউয়ের দিকে তাকিয়ে তার সম্মতি নেয়ার চেষ্টা করল। লাজুক চেহারার মহিলাটি নিঃশব্দে মুচকি হেসে দিল। আমি বললাম, আচ্ছা।
আমি ইজিবাইকের চাকা যশোরের দিকে অগ্রসর করলাম। ভাবলাম ওদিকে ফুলতলা পর্যন্ত ঘুরিয়ে নিয়ে আবার এদিকে সোনাডাঙা বা গল্লামারী পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনলে আমার দু ঘন্টা পূর্ণ হয়ে যাবে। তাতে আমার ভাড়া মিটে যাবে।
ইজিবাইক চলতে থাকল মধ্যম গতিতে। ভেতরে তারা দুজন খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে কথাবার্তা বলছে, যার আওয়াজ আমার কানেও মাঝে মাঝে ভেসে আসছে পেছন থেকে। ফলে ভুলক্রমে আমার চোখ লুকিং মিররের মাধ্যমে তাদের উপর পড়ছে। এটা যে অপরাধ, এই ভেবে আমি আবার চোখ ফিরিয়ে আনি তখনি। হঠাত করে পুরুষ লোকটির একটি কথায় আমার ভাবনা যেন একটু নড়ে চড়ে ওঠে। কথাটি সে আমায় বলেনি বা নিজে নিজেও বলেনি। সে তার স্ত্রীকে বলল, ছেলে মেয়েগুলি কেমন আছে?
হ্যাঁ, ভালো আছে।
আমি এই কথাটুকু শুনে ধারণা করে নিলাম, তাহলে নিশ্চয় তাদের ছেলেমেয়েগুলি মায়ের কাছে থাকে, এবং ছেলেমেয়েগুলি বাবার চোখের আড়ালে থাকে। নয়ত পুরুষ লোকটি কেন জিজ্ঞাসা করবে তাদের অবস্থা সম্পর্কে?
মহিলাটি বলল আমাকে উদ্দেশ্য করে, আচ্ছা জানালার পর্দাগুলো কি ফেলে দেয়া যাবে?
হ্যাঁ, ম্যাডাম অবশ্যই যাবে।
আমি ইজিবাইকের ব্রেকে পা রেখে দু’পাশ থেকে পর্দাগুলি ছেড়ে দিলাম। এবং বুঝতে পারলাম তারা এতে কিছুটা স্বস্তি পেল। আমি গাড়ি ছেড়ে দিলাম।
তারপর,
ইজিবাইক তার নিজস্ব গতিতে চলতে লাগল। ইতিমধ্যে আমি খেয়াল করে দেখলাম, আমরা স্টার্নগেট পার হয়ে অনেক দূর চলে এসেছি। এবং আমাদের দু’ঘন্টা সময় থেকেও প্রায় এক ঘন্টার মতো সময় অতিবাহিত হয়েছে। আমি তাদের উদ্দেশ্যে গলার স্বর একটু মোটা করে বললাম, ভাইজান সুমায় কিন্তু প্রায় শ্যাষ হয়ে আইছে। তারা আমার এই কথার উত্তর দিল না। আমি কিছু সময় উত্তরের অপেক্ষা করে অভ্যাস মতো অথবা বদাভ্যাস মতো লুকিং মিররে আবারো চোখ উঠালাম। তখন দেখতে পেলাম তাদের একটি হৃদয় ছোঁয়া দৃশ্য। এবং আমি সব ভুলে যেন এ দৃশ্যই দেখতে মগ্ন হয়ে গেলাম।
দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরেছে, এবং দুজনের চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। পুরুষ লোকটি বলল,
তোমার কি মনে পড়ে আমরা কিভাবে সেই প্রথম প্রেমের দিনগুলি কাটিয়ে ছিলাম?
হ্যাঁ, সবই মনে আছে। তা কি আর ভুলা যায়!
এখনো আমায় ভালোবাসো?
না বাসলে কি এতদূর আসতাম।
তোমায় খুব মিস করি, হয়ত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই না-পাওয়ার আফসোস থেকে যাবে।
তোমার স্ত্রী কেমন আছে? সে তোমার যতœ নেয়?
হুম, ও আমার খুব খেয়াল রাখে।
আমার হাত স্টেয়ারিং-এ, কিন্তু আবারো মনোযোগ চলে গেল তাদের কথায়। তার মানে কী? এরা ডিভোর্সড কাপল! কিন্তু ওদের ভেতরে যে কত ভালোবাসা! তবুও ডিভোর্সড হলো কেনো?
হঠাত আমার মনে হলো, নাকি পরকিয়া করছে তারা?
ধুর, আমি কী সব ভাবছি। যা হবে হোক গিয়ে। আমার কী তাতে। আমার দু’ঘন্টা হয়ে গেলে এবং ২৫০ টাকা পেলেই যথেষ্ট। হঠাত পেছন থেকে পুরুষ লোকটি বলল,
আচ্ছা ঐ সামনে যে গাছটি আছে, দুইজন লোক দাঁড়ানো। ওখানে আমাদের নামিয়ে দাও।
আমি ইজিবাইক স্লো করে মেন রোড থেকে বাঁ দিকে নেমে গাছের পাশে থাকা লোক দুজনের সামনে স্টপ করলাম। দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুজনের একজন পুরুষ ও একজন মহিলা। আমার ইজিবাইকটি থামতে না থামতেই লোকদুটি ইজিবাইকের কাছে এসে গেল। আমি ভাবলাম, যাক ভালোই হবে। একটা ভাড়া শেষ হতে না হতেই অন্য যাত্রী ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু না, লোকদুটি এসে আমার ইজিবাইকের ভেতরে থাকা দুজনকে বলল, আরে এসে গেছ? নামো, নামো, চলো।
আমি তাদের কথাবার্তার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। তুমুল আগ্রহ নিয়ে চেয়ে রইলাম তাদের দিকে। এদের সঙ্গে ওদের কী সম্পর্ক? যদি এরা পরকিয়াই করে তবে তো লুকিয়ে লুকিয়ে থাকার কথা। তারপর পুরুষ লোকটি বলল আমাকে,
এই নাও ৩০০ টাকা, তোমাকে ৫০ বাড়িয়ে দিলাম।
আমি তার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একশ’ টাকার তিনটি নোট। আমি তার দিকে স্মিত হেসে টাকাটি ড্রয়ারে রাখতে গেলাম। ঠিক তখন উনি আবার এক বাক্যের একটি কথা বলে চলে গেলেন।
লুকিং মিররে এতবার তাকিয়েও বুঝতে পারলে না আমাদের সম্পর্ক কী?
আমি লজ্জায় যেন আর মাথা ওঠাতে পারলাম না। ঝিম ধরে বসে রইলাম। এর কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে দেখতে পেলাম, তারা চারজন দুটি জোড়ায় বিভক্ত হয়ে খূব ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কেবল একটি পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে- তা হলো, ইজিবাইকে থাকা মহিলাটি গাছের নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষের হাত ধরে হাঁটছে। আর ইজিবাইকে থাকা পুরুষ লোকটি গাছের নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটির কাধ ধরে হাঁটছে। আমি তাকিয়েই রইলাম তাদের দিকে। যেন আমার চোখ ফেরাতে ইচ্ছে হলো না তাদের উপর থেকে। আমার মনে হলো, ওরাই কি তাহলে পৃথিবীর সুখী মানুষ?? আচ্ছা, ওরা কি একবারও দেখেছিল, আমার ইজিবাইকের নাম ‘সুখী পরিবহন’। আমি আবারও স্টার্ট করলাম ইজিবাইক।
ফাঁকা রাস্তা। ‘সুখী পরিবহন’ চলছে দ্রুত গতিতে। আমারও ধীরে ধীরে মনে হলো, আমিও আজ অনেক সুখী। অনেক সুখী। তবে কেনো এত সুখ বিরাজ করছে আমার মনে? প্রকৃত সুখী মানুষ দেখেছি বলে?
তারপর দেখলাম, ইজিবাইকটি আর রাস্তায় চলছে না। ধীরে ধীরে সেটা অনেক উপরে উঠে যাচ্ছে। আমি স্টেয়ারিং ছেড়ে দিলাম। ব্রেক থেকে পার উঠিয়ে আনলাম। এবং উপলব্ধি করতে লাগলাম এক সুখ। যে সুখ পরম সুখ। ইজিবাইকের গোপন সুখ।