গল্পটি শুনতে চেয়ো না
সোহেল নওরোজ
নাহিদের বদলে যাওয়া একরৈখিক ছিল না। নিজের অজান্তেই সে অন্য কারো বদলে যাওয়ার প্রভাবক হয়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে আরেকজনের জীবনের গতিও বাঁক নিয়েছিল। মায়ের সঙ্গে নিরানন্দ দিন কাটিয়ে অভ্যস্ত তাহিয়া যেন তার উপস্থিতিতে জীবনকে ভিন্ন ভাবে দেখার সুযোগ আর উপলক্ষ্য পেয়েছিল! যেখানে সাদা-কালোর ছোপ ছোপ রঙের আধিক্য নয়, বরং হরেক রঙের মাখামাখি। লাল, সবুজ, বেগুনি...
হাফিজুল হকের হাতের ছবিটি তাহিয়ার। ছবিতে তার মুখ হাসিহাসি। ছবিতে কেবল একটা অবয়ব নয়, তিনি ওই সময়টাকেও ধরতে চেয়েছিলেন। মায়াবী সময়। তা কতটা পেরেছেন অনাগত সময়ই বলে দেবে। অর্পা এ ছবিটার ব্যাপারে কখনোই মুখ খোলেনি। যেন সিদ্ধান্ত দেওয়ার ইচ্ছা বা অধিকার তার নেই। লেখককেই গুরুত্বের বিচারে নির্মাণ করতে হবে নিজের মতো করে। তিনি তাহিয়ার মুখের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। এমন কারো সঙ্গে কি তার কখনো পরিচয় ঘটেছে? ঠিক মনে করতে পারছেন না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অবচেতন মনের স্মৃতিগুলো ঝাপসা হতে শুরু করেছে। মানুষ চাইলেই কিছু বিষয় এড়াতে পারে না, অস্বীকার করতে পারে না তার প্রভাব। বয়স সে বিষয়গুলোর মধ্যে একটি।
তখন আকাশে ওড়ার বয়স পার করছে নাহিদ আর তাহিয়া। স্কুল থেকে ফিরে তারা একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। কাছেই একটা নদী। হেঁটে গেলে বিশ-পঁচিশ মিনিটের পথ। তারা অর্ধেক সময়ে পৌঁছে যায়। তাহিয়ার ভাষায় এটাকে বলেÑ প্রজাপতিছুট। ঠিক হাঁটাও নয়, আবার দৌঁড়ও নয়। সে আগে আগে চলবে, তার পিছু পিছু নাহিদ। তাল-লয় একই থাকবে। দূরত্ব সারসাম্যপূর্ণ। কেউ কাউকে ছুঁতে পারবে না। তবে তারা দুজনেই প্রকৃতিকে ছুঁয়ে দেয়, কিংবা প্রকৃতি তাদেরকে। শরতে কাশফুল, বর্ষায় কূল উপচানো টলমলে জল, গ্রীষ্মে মন উচাটন করে দেওয়া মাতাল হাওয়াÑ এ সব তারা তরিয়ে উপভোগ করে। কোনো মানা নেই, নিয়মনীতির বালাই নেই। ঠিক সন্ধ্যায় আগে ফিরে এলেই হয়। এরপর আর কোনো কাজ নেই। কেবল পড়াশোনা। তাতে দুজনের কেউ তাতে অবহেলা করত না। তাহিয়ার পাঠ্যবইয়ের অনেক বিষয় আয়ত্ত করতে নাহিদ সাহায্য করত। যে কোনো বিষয় সহজে বোঝাতে পারা এবং বুঝতে পারার দ্বিমুখী ক্ষমতার কারণে পাঠ্যবইও তাদের কাছে আনন্দের জগত হয়ে উঠত। তাতে কবিতা সবচেয়ে বেশি খুশি হতো। সারাদিন গানের স্কুল, টিউশনির ধকল সামলে বাড়ি ফিরে স্বাভাবিকভাবেই ক্লান্ত থাকত। এ সময় ওদের পড়াশোনার তদারকি করা বেশিরভাগ সময় সম্ভব হতো না। নাহিদ থাকায় বিরাট চিন্তার হাত থেকে বাঁচতে পেরেছে। হুট করে খেই হারিয়ে ফেলা কবিতার জন্য এমন নির্ভরতা পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার।
এসএসসি পরীক্ষার আগের রাত। নাহিদ অনিকেতের চিঠি নিয়ে বসেছে। যখনই বড় কোনো উপলক্ষ্য হাজির হয়, নাহিদ চিঠিটা কয়েকবার পড়ে। অন্যরকম এক শক্তি আছে চিঠিটার মধ্যে। তাকে নতুন করে জাগিয়ে দেয়। লক্ষ্যটাকে সামনে নিয়ে আসে। কতদিন অনিকেতের সঙ্গে দেখা হয় না! সে কোথায় আছে কে জানে! অনিকেতও কি কাল তার মতো পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে? নাকি পড়াশোনা বাদ দিয়ে পথে পথে ঘুরছে? সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি। সব প্রশ্নের শতভাগ উত্তর মেলে না। নিয়তির হাতে তোলা থাকে। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় জানালা খুলে যায়। বাইরে শুনশান বাতাস। আকাশে আস্ত একটা চাঁদ দখল নিয়েছে। খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো হুড়মুড় করে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। যেন দূরে কেউ চাঁদের লাইট হাতে ঘরটাকে তাক করে বসে আছে। নাহিদ মুগ্ধ চোখে চাঁদটাকে দেখছে। এমন চাঁদ অনেকদিন দেখা হয় না। যখন অনিকেতের সঙ্গে মিলে এতিমখানা থেকে পালাত, তখনকার রাতে প্রায়ই এমন চাঁদ উঠত। তারা তরিয়ে সে জোছনারাত উপভোগ করত। চাঁদ আর অনিকেত কে বেশি রহস্যময়? হয়তো চাঁদ, হয়তো অনিকেতÑ নাহিদ তার কিছুই জানে না।
পরীক্ষার পর হঠাৎ করেই নাহিদের ভেতরে একধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। হঠাৎ করেই কিছু একটা করার জন্য মন উতলা হয়। এ বাড়ির প্রতি, এ বাড়ির দুজন মানুষের কাছে তার অশেষ ঋণ। তবু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টাটুকু সে করতে চায়। সে চেষ্টার জন্য যে ভিত্তি দরকার তা এখান থেকেই গড়ে নিয়েছে। সামনের পথ কারো সাহায্য ছাড়া চলতে পারলে সেটাই সবচেয়ে হিতকর হবে। তাতে গর্ব করে বলার মতো অনেক অনুসঙ্গ খুঁজে পাওয়া যাবে।
নাহিদ কবিতা বা তাহিয়া কাউকেই বিষয়টা বুঝতে দেয় না। ভালো কোনো কলেজে পড়ার ইচ্ছার কথা কবিতাকে জানায়। সে না করতে পারে না। মন সায় না দিলেও তার ইচ্ছার ওপর কথা বলা যায় না। তাহিয়া ঠিক তার উল্টো। নাহিদ সরাসরি বলে দেয় অমতের কথা। এতদিন বাদে তার সমস্যা জেগে ওঠা স্বাভাবিক কিছু নাÑ তাহিয়ার কথায় শ্লেষ থাকে, মায়া থাকে, অভিমান থাকে। নাহিদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবু মনের বিরুদ্ধে সে আসন গাড়তে চায় না। এটা বেশ বুঝতে পারে, এ পরিবার ছেড়ে একেবারে দূরে সরে যাওয়া তার পক্ষেও সম্ভব নয়। কাজটা করতে হবে ধীরে ধীরে। তিনটা মনের ওপর একসঙ্গে আঘাত না দিয়ে। তবু এ কাজে তাকে সফল হতে হবে। দূরে সরে যেতে হবে। একই মায়া বেশিদিন লালন করলে স্থায়ী হয়ে যায়। সে বলয় থেকে আর কখনোই বের হওয়া যায় না। চাইলেও না। বলয়বন্দী হওয়া মানুষেরা অনুভূতি হারিয়ে ফেলে। ভেতরের শক্তি ক্রমশ ভোঁতা হয়ে পড়ে। কঠিন চ্যালেঞ্জ দেখলে পাশ কাটিয়ে যায়। সে তাদের মতো হবে না। সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। একেক চ্যালেঞ্জ একেক রকম। সেগুলো সাফল্যের সঙ্গে পেরোতে হবে। তার লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে। অনিকেতই ঠিক করে দিয়েছিল সে লক্ষ্য। তাকে শুধু সেখানে পৌঁছাতে হবে, শুধু মাথাটা উঁচু করে।
(............ক্রমশ)