নিশ্চুপ হেঁটে চলে...
শাহমুব জুয়েল
একটু আগে খবর এলো। ঘরে থাকার দিন ফুরিয়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরে জল ঘুরছে। ঢেউয়ের চিৎকারে নদীগুলো বেশ সরগরম। এই তো হেঁকে উঠলো। জল আর জল। জল উপরে উঠলে বাঁচার স্বাদ হজম হয়ে যাবে। তাও আবার পাঁচ ছয় ফুট। উপচিয়ে পড়লে গলাচিপে ধরবে। কী আর করা। দু চারটে জিনিসপত্র বোগলতলে নিয়ে দৌড় দেয় বেদে সুরত মিঞা।
ডাকাতিয়া নদী। ছোট ছোট নৌকায় জীবনযাপন করে একটি জনগোষ্ঠী। সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্ম সে তো নাগালের বাহিরে। তারা তো তারা বোঝে না। দিনভর চিপ ঝাঁঝরা বা জাল দিয়ে মাছ ধরে দেহের সাথে প্রাণ লটকে থাকে। তাদের এ লকরঝকর জীবনের উপর দখলদারদের লাঠি পড়েছে। বালির নল ওঠানামা করছে। ঝোঁপঝাড় কেটে নদীর বাঁকে বাঁকে তৈরি হয়েছে চিংড়িখের। স্বাভাবিকভাবে তারা চলতে পারছে না। সব নৌকা তুলে নেয়া হয়েছে। কোথায় থাকবে তারা। রাস্তার কার্ণিশে ঘুড়ির চাউনি তুলে কোনরকমে বসবাস করে। তাতেও শান্তি নেই। বালি ব্যবসায়ীদের উৎপাতে তাতেও রক্ষা নেই। তাড়া খেয়ে খেয়ে রীতি চালু হয়েছে। এ বেলা এখানে ওবেলা ওখানে। কথায় বলে- একখানে সাত দিনের বেশি থাকতে নেই। নদীতে পড়ে থাকে সুরত মিঞা। ভাঙ্গাচোরা ডিঙি ।
মাছ ধরা তো দুরের কথা নৌকা থামিয়ে একটু রান্না করবে তারও জো নেই। রোদ বৃষ্টি ঝড়ে তারা থাকে বাঁকে। খিদের তোড়ে পেট চো চো করে। বডি ঝুইল্যা পড়ে তবুও মাছ ধরা ছাড়ে না। যার তবিয়তে জীবন বাঁচে। রান্না করতে বসে সুরত মিঞার স্ত্রী খুপরি। বয়স কম লাউয়ের ডগার লাহান শরীর। কাপড় পরলে ঝুলে থাকে। তাদের কেউ দোষ ধরার নেই। চোখে পড়লে তো ধরা পড়বে। চোখের দিকে তাকালে দরদ লাগে। বাতাসে নৌকা ঘুরছে ছাউনিতে ফাত ফাত শব্দ। রান্না বসায়, আরেক পারে রান্না শেষ হয়। এবার বউকে শুনায়। একপাড়েতে রান্ধি বাড়ি আরেক পাড়ে খাই সুখের সীমা নাইরে বন্ধু সুখের সীমা নাই।তাই সুরত।
কচুরিপানার ভাঁজে ভাঁজে চিপ ফেলে মাছ ধরে সুরত মিঞা। দেশীয় নানানপদের মাছ পায়। এতে নড়েবড়ে সংসার চলে।
ডাকাতিয়ার উপর গাড়ির ফা ফা শব্দ। দুধারে রঙিন লাইট। দিনে নজরে তেমন আসে না। রাতে শব্দের পাশাপাশি রঙিন আলো। নাম ডাকাতিয়া সেতু। নদীর মাঝখান থেকে তীরের মত আটকে যায়। সেতুর দিকে যেদিন চাঁদের আলো নিরুদ্দেশ হয়। সরকারি আলোতে খুপরির মুখখানা ভারি মিষ্টি লাগে। বুকখসা কাপড় লজ্জায় লাফিয়ে ওঠে। ভাত খায় । হাত মোছে আঁচলে। তারপর গাড়ি চলে রাস্তায়। তারাও গাড়ি হাঁকায় রাতের যৌবনে তারা তৃপ্তির ডেকুর তোলে। তারা পাড়ি দেয়। যার যার পথ।
চারদিকে অন্ধকার। রাত নাকি। না রাত তো হয় নি। এই তো রেললাইনে খাটু মিঞার দোকানে মাছের টাকা আনার সময় দেখলাম দশটা বাজে। তাহলে এখন সময় কত? অন্ধকারে ডাকাতিয়া ব্রিজ দেখা যায় না। বাবারে- মোরিয়ে মোরিয়ে আসছে কী আসছে সব উড়ে যাচ্ছে। শোঁ- শোঁ-বাতাস। বিদৎুকেন্দ্রে লাইনম্যান হয়তো আছে। বাতি জ্বলছে না। বাতাসের তোড়ে সব চিন্ন বিচ্ছিন্ন। গত বর্ষায় একদিনের মাছ বিক্রি করে কেনা স্মার্টফোন আছে। পারের দোকানে দশটাকায় চার্জ দেয়া যায়। সেভাবে চার্জ দেয়া।কিন্তু বিদৎুতের মতিগতিতে চার্জ কম।টিপ টিপ করে লালবাতি জ্বলছে। এইতো বন্ধ হয়ে গেল।
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। রাস্তায় গাড়ি নেই। জলে জেলে নেই, মাঝি নেই । টলার নেই। রাস্তা ফাঁকা জনমানব নেই। কেবল একটি অটো দেখা য়ায়। দুপাশে মাইক ঝুলানো। বলা হচ্ছে -সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি : ১০ নম্বর বিপদ সংকেত। সাবধানে থাকুন, অমুক যায়গায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয় নিন। নিরাপদ স্থানে আসুন। খুপরি চেঁচায় ও সুরত তুমি কোনহানে। শুন কী কহে । সুরত বুঝেশুনে বলে। বলুক। আমেেগা কী আর যায়গা আছে। কি কও।সুরত মনে পড়ে। বছর তিনেক আগে ভারী বন্যা হয়েছিলো।
প্রাণের ভয়ে ছুটছিলাম আশ্রয় কে›্দ্ের। দরজায় মুখ দিতেই ছালামত মিঞা তেড়ে ওঠে। ঐ কেরে তুই বাইদ্যার ঘরের বাইদ্যা। এহানে কী হারামির বাচ্চা হারামি। জন্মের ঠিক নাই। সে আবার বাঁচতে চায়। তোরে আইতে কইছে কে।যা ডিঙ্গায় যা।অমনি নজর দেয় খুপরি।বলে কী ভাই আমগোরে মানুষ মনে হয় না।জ্বিভা হাঁকায়। ঘনঘন ডোক গিলে ছালামত। চোখ লাল। তুমি আবার কে, সেরকম তো। আইয়্যো। সুরত বলে। ঐ। এ বলে নৌকায় ফিরে। পথে চোখ বাড়ায় ছেলামত। গো গো করে সুরত মিঞা মইরা যামু। আর আমু না।
এবার কী হবে। যা হবার হবে। খুপরি আল্লাহরে ডাক। ঝড়োহাওয়া শুরু হয়। ধুমড়েমুচড়ে সব চারখার হয়ে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে খুপরির।খুপরি চিল্লায় আল্লাহরে; আল্লাহরে। ফুঁপে কাঁদে। আর চিল্লায়। কেরামত নদীতে নেমেছে শব্দ শুনে কিন্তু দুধারি শব্দে ঠিক ঠাহর হয় না। কী শব্দ। হঠাৎ জল ফুঁপে ওঠে। জল চাঙ্গিতোলা করে। একটা নৌকায় বাড়ি খায় সুরত মিঞা।কার নৌকা এটি। নৌকাটি কোত্থেকে এলো। সে দেখলো নৌকাটি দ্রুত চলে যাচ্ছে। বামে তার নৌকাটি ডুকরে ডুকরে কাঁন্নার শোনা যাচ্ছে। নদীতে শাড়ির আঁচল দোল খাচ্ছে। পাটাতনে দেহ। নজরে এলে দেখা গেলো খুপরি।কী হলো খুপরির।
হঠাৎ জল নেমে গেলো। নৌকা আঁটকে গেলো। মাটিতে। মাটি বলতে-এ যে ঘাটের রাস্তা। রাস্তায় জলের দাগ। পায়ের চাপ। কিন্তু কোথাও তো জনমানব নেই।তাহলে এ মহুর্তে কে গেলো এপথে। মনে হয় এইমাত্র সদ্যস্নাত কেউ গিয়েছে। অনেকক্ষণ খুপরির সন্ধান করছিলো সুরত। চোখের জল বৃষ্টির জল একসাথেই গাল বেয়ে পড়ছিলো। কিন্তু কারো খোঁজ মেলেনি। মাথা উপরে উঠলো।মচোখ তুলতেই দেখা গেলো অর্ধবস্ত্র পরিহিতা রমনী। হঠাৎ ঘোর অন্ধকার। মেঘের তা-ব। বিজলীতে আধো দেখা কে যায় কিন্তু বোঝা গেল না। নি:শব্দে দেহ হেঁটে যায় ।