গল্প- কুসুম স্বপ্নের বিরহী সমীরন





কুসুম স্বপ্নের বিরহী সমীরন
জাহিদ হোসেন

‘শালা শ্বশুরবাড়ি’- জেল থেকে বেরিয়ে গা চাঁড়া দিয়ে হাফ ছাড়ে সাদেক আলী। গ্রামের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। শহরের ব্যস্ততম সড়কটা পেছনে ফেলে শহরকে বিদায় জানিয়ে ছোট্ট রূপচাঁদা নদীটি ডিঙ্গি নৌকায় পার হয়েই গ্রামকে স্বাগত জানায় সাদেক আলী। আজ অনেকদিন পর এই মাটি ও পরিচিত গ্রামের সাথে দেখা হয়ে আনন্দে মনটা নেচে উঠছে। অনেক কিছুই বদলে গেছে গ্রামের। রাস্তার ধারের গাছগুলো দশ বছর আগেই কত ছোট ছিল। এখন সে গাছগুলো এত বড় হয়েছে যে, তেজী সূর্যের  আলোকে আটকে দিয়েছে উপরেই। গাছের পাতাগুলো সীমান্তরক্ষী হয়ে সড়কের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে চলছে অবিরত। তবুও জেদী সূর্য সংবিধান ভেঙে পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে অবৈধভাবে সড়কে প্রবেশ করেছে। গ্রামের এই গাছঘেরা, ছায়াঢাকা পথে হাটতে ভালোই লাগছে তার। বেলা পড়ে আসছে। সড়ক থেকে আলপথে মোড় নেয় সে। চীনা ক্ষেতের সবুজ গালিচার মধ্যদিয়ে  এঁকে বেঁকে চলে গেছে পায়ে হাঁটা পথ ঐ দূরের গ্রামে। আজ দশ বছর পরে তার স্ত্রী-সন্তানের সাথে দেখা হবে,এই আনন্দে আত্মহারা হয়ে কণ্ঠে মধুমালতি ছায়াছবির গান গুনগুনিয়ে সজোরে পা চালায় সাদেক আলী। কিন্তু পথ আর শেষ হয় না। যে পথ সে দশ বছর আগে রেখে গিয়েছিলো সে পথ যেন দিগন্তের কোল ঘেঁষে সবুজ বনানীর সীমারেখায়,কাঁশবনের উদ্দাম ইশারায় কোন এক সুদূর স্বপ্নরাজ্যে হারিয়ে গিয়েছে। পথের সাথে তার সখ্য হতে কিছুটা দেরি হলেও ক্ষেতে গঙ্গা-ফড়িংগুলো সখ্য গড়তে মোটের দেরি করেনি। তার মৃদু পদধ্বনিতে গঙ্গা-ফড়িংগুলো স্বাগত জানিয়ে লাফালাফি করছে। দুর্বাঘাসের সঞ্চিত শিশিরবিন্দুগুলো তাকে অভিনন্দন জানিয়ে পা ধুয়ে দিচ্ছে। বিকেলের শান্ত পরিবেশ ও প্রকৃতি আরো বেশী মোহনীয় করে তুলেছে নরম সোনালি রোদ্দুর।
    বাড়ির সীমানায় পা রেখেই হাক দেয় সাদেক আলি- ‘বউ, বউরে- কই গেলি তুই।’ করিমন সদ্য মেম্বারের বাড়ি থেকে ফিরেছে। করিমনের মনে আচমকা জিজ্ঞাসা- ‘জেল থিকা আজি ছাড়া পাইলেন ?’ সাদেক আলি যথাসম্ভব গাম্ভীর্য  রেখে বলে- ‘হ, শালাদের মনে একটুও দয়ামায়া নাই।’ করিমনের মনে আনন্দ ধরে না। অনেকদিন তাকে ‘খুনির বউ, খুনির বউ’ বলে উপহাস করেছে গ্রামের লোক। এমনকি খুনির বউ বলে কারো বাড়িতে একখানা ঝি এর কাজ পর্যন্ত পায় নাই। শেষে মেম্বার সাহেব দয়া করে তার বাড়িতে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখন তার স্বামী ফিরে এসেছে। তাকে এখন আর দু’মুঠো ভাতের জন্যে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হবে না। মানুষের উপহাস, তিরস্কার, লাঞ্ছনা আর তাকে শুনতে হবে না। স্বামীকে পেয়ে মরা নদীতে জোয়ার এলো বলে তার সারাদিনের ক্লান্তি এক নিমিষেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। করিমন স্বহাস্য বদনে স্বামীর যতœ-আত্মি করতে লাগলো। সাদেক আলি জিজ্ঞাসা করে- ‘সখিনা কই ? ওরে দেখিনা ক্যান ? করিমন উত্তর দেয়- ‘এই দশ বছরে আমাদের সখিনা অনেক বড় হইচে। অহনে জানি কই গেল । স্থির হইয়া কোন হানে  থাহে না। শুধু উড়াং পাড়াং করে।’ মেয়ের কথা শুনতে শুনতে চিন্তার জালে আটকে যায় সাদেক আলী। সেই সখিনাকে পাঁচ বছরের রেখে জেলে গিয়েছিলো সে। এখন তার মেয়ে বড় হয়েছে। একটা ভালো জামাই দেখে বিয়ে দিতে হবে। অনেক টাকা-পয়সার ব্যাপার। সে এখন কী করবে। এই চিন্তায় ঘুম আসে না। চিন্তাগুলো যেন তার ঘুমের শত্র“। সারাক্ষণ ঘুমকে তাড়া করে ফিরছে। কিন্তু তবু কোন কূল কিনারা পায় না। অবশেষে চিন্তা আর ঘুমের প্রচন্ড ধস্তাধস্তির পর জয় হয় ঘুমের।
    পরদিন সকালে উঠোনে বসে তার চিন্তা রীতিমতো থমকে দাঁড়ায়। সেই দশ বছর আগে অযতেœ অবহেলায় রেখে যাওয়া বাড়ির চারদিকের তালগাছগুলো আজ যৌবনবতী হয়েছে। তাদের শরীরে রস ডগমগ করছে। সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে তালগাছগুলোর পরিচর্যা করতে থাকে সে। চোখে মুখে তার নতুন আশার স্বপ্ন। সন্ধ্যা হতে না হতেই তালগাছগুলোতে পাত্র লাগানোর কাজ শেষ করে। তার কাছে পৃথিবীটা সুন্দর বলে মনে হয়। তাই এই সুন্দরের পৃথিবীতে আবেহায়াত ছায়াছবির গান গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়ে নতুন প্রভাতের নতুন সকালের আশায়। এদিকে সারারাত অবধি তালগাছের কাটা ডালের কাঁচা রস বাতাসে দুর্মর সুগন্ধ সংবরণ করে একেকটি বৃহৎ আনন্দ অশ্রু হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পাত্রের ভিতরে জায়গা দখল করতে থাকলো। রাতারাতি রসের ব্যবসায়ী বনে যায় সাদেক আলী।
    পরদিন প্রভাতে পাখিদের কলকাকলীতে ঘুম ভাঙে তার। ঘুম থেকে উঠে গাছ থেকে পাত্র নামিয়ে মুগ্ধ হয় সে। একটা নিষ্কণ্ঠক আত্মতৃপ্তিতে মন ভরে ওঠে তার। কী যে নেশা ধরানো রঙ,¯িœগ্ধ মোলায়েম তার সুগন্ধি আমেজ। সারাটা উঠোন যেন মৌ মৌ গন্ধে ভরে উঠলো। এদিকে খাদকরা দেয়া খবরের ভিত্তিতে বেশ আগে ভাগেই সাদেক আলীর উঠোন ভারি করতে থাকলো। আস্তে আস্তে এত খাদকের উপস্থিতি সেখানে ঘটলো যে, সে রীতিমত ব্যস্ততার চরম পর্যায়ে চলে গেল। তবে সাদেক আলী সব খদ্দেরকে তেমন বসার উপকরণ যোগান দিতে পারলো না। কেউবা মাদুর পেতে প্রথম শ্রেণীর আরামদায়ক জায়গা পেয়ে জমিদারের রঙমহলের মতো শুয়ে বসে রস পান করছে। কেউবা টুল বা পিঁড়েতে বসে  রস গিলছে। কারো ভাগ্যে জুটেছে খড়, তার উপরে বসেই অবাধে পেটে রপ্তানি করে চলছে তালের পাকানো রস। আবার কেউবা মাদুর, টুল, পিঁড়ে, খড় কোনটাই না পেয়ে সেন্ডেলে বসেই ঢক-ঢক করে গলায় ঢালছে। এখানে বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় সাদেক আলীর উঠোন ধুমায়িত হয়ে উঠেছে। খদ্দেররা রস পানের বিরতিতে মুখরোচক বঠ ব্যবহার করে। একটু বড় মাপের খাদকরা বঠ হিসেবে গরু বা খাসীর মাংস খায়। কেউবা ঝাল চানাচুর, কেউবা ছোলা। আর যার ভাগ্যে কোনটাই জোটে না তারা শুধু লবন মরিচ ব্যবহার করে। কোন খদ্দের রসের অর্ডার দিচ্ছে আর কেউ তা ডেলিভেরি নিতে ব্যস্ত।
    এভাবেই রস খাদকদের কাছে সাদেক আলীর মান-সম্মান, প্রতিপত্তি দিনে দিনে বাড়তে থাকে। সখিনার বিয়ের সম্মন্ধ বড় বড় ঘর থেকে আসতে শুরু করে। রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক কিছু চিন্তা করে সে। চিন্তাগুলো আবার তাকে গ্রাস করে ঘুমের বদলে। মাটিতে লাগানো গাছের জীবন জাগানো রসের সাথে মিশে গেছে তার জীবিকা। প্রকৃতিই তাকে নতুন পথ দেখিয়েছে। তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছে। এইতো কদিন আগেই তাকে চুরি করতে হয়েছে। ঘটনাক্রমে খুন করে জেলের ঘানি টানতে হয়েছে। তবুও এ জগৎ সংসারের বিচিত্র মানুষ তাকে ক্ষমা করতে না পারলেও প্রকৃতি সত্যিই তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। দিয়েছে মান-সম্মান আর বেঁচে থাকার অনাবিল আনন্দ। এসব চিন্তা করতে করতে কখন ঘুম এসে যায় টেরও পায় না।
    গাইবান্ধা কেন্দ্রীয় কারাগার। ভোরের আযান শোনা যাচ্ছে। সেই সাথে জেলের ঘন্টিও বাজছে। সেক্টর ম্যাট সব কয়েদী, হাজতীদের ডেকে তুলছে। ঘুম ভেঙে গেল সাদেক আলীর। যথারীতি প্রত্যেক দিনের মতো আজও লাইনে যেতে হবে। ফাইল গুনতি হবে। সবার সাথে সাদেক আলীও ঘুম জড়ানো চোখে লাইনে এসে বসে। এদিকে ম্যাট ও রাইটার মাথা গণনা নিয়ে ব্যস্ত। সূর্যটা তখনও ছাড়পত্র পায়নি। সাদেক আলী তাকিয়ে আছে দূরের নিঃসঙ্গ আবছা অন্ধকারের দিকে।





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট