প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : : গুপু ত্রিদেবী
ইলিয়াস বাবর
শহরকে কেমন যেন হৃদয়হীনা প্রেমিকার মতোন লাগে আজকাল! হৈ-হুল্লোড়, জ্যাম, ছোটাছুটি, দৌড়, প্রতিযোগিতা... এসব। অথচ কোন এক শীতমগ্ন ভোরে স্বপ্ন দেখি, এই শহরেরই এক কোণে ব্যাচেলর বাসার সস্তায় কেনা খাটে শুয়ে। নগরের সব রাস্তা মিলেছে লালদিঘীর মাঠে। সড়কদ্বীপগুলোয় হলুদাভ-সবুজ পাতা নিয়ে জেগে আছে কতিপয় নাগরিক গাছ। তাদের হাবভাব গ্রামীণ অথচ স্বতঃস্ফূর্ত। গাছেরাও আশ্চর্য শৃংখলায় এভাবে পরস্পরে লাগোয়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে! কানাকানি চলছে তাদের, শুরু থেকে শেষ অবধি। একটি রাস্তা, যেটা রাহাত্তারপুল থেকে গেছে গন্তব্যে, তার বুকে করে সারথি হই আমিও। গাছের পাতায় তখন জমতে শুরু করে কুয়াশা। কিছু পাতায়, কিছু ছুঁইয়ে পড়ছে রাস্তায়, কংক্রিটে। গাছেরা জুড়ে দেয় কিছু পংক্তি। তারা নাকি আগের জন্মে মানুষ হতে চেয়েছিল, পারেনি। তাদেরই অগ্রভাগের বৃক্ষটি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিল, বৃক্ষ হওয়াই ঢের ভালোÑ পারতপক্ষে কারো লাভ করতে না পারি, ক্ষতি তো হবে না! এ্যা, মানুষেরা কী করে দেখোনি? মানুষেরাই তো কথা না রাখার প্রচলন করছে এই ধরায়... গায়ক-বৃক্ষ গলা ছেড়ে মুক্তির গান গাওয়ার পরেই তাদের শরম শরম লাগে। কিছুক্ষণ আগে তার সাথে যোগ হওয়া শিক্ষানবিশ-গায়ক, আধা-শিক্ষিত গায়ক-বৃক্ষেরা নিজেদের জিহ্বায় কামড় বসায় নিজেদেরই লাজে। পস্ট মনে পড়ে এখন রঙ্গের টাইম নয়! হর্ষ-কোরাসে মত্ত হবার সময় নয় বাপু, গাইলে মর্সিয়া গাওÑ বৃদ্ধবৃক্ষটি বলে ওঠে। তখন ওদেরই একজন বলে যায়Ñ গ্রাম ও শহরের তফাত। বর্ষা ও গ্রীষ্মের বন্দনা। মানুষ ও বিশ^াসঘাতকের জেনেটিক যোগ-বিয়োগ। তারা কাছাকাছি হতে থাকে লালদিঘীর, চিনতে থাকে মানুষের উপসর্গ। সবচেয়ে বয়সে কম কবি-বৃক্ষটি সবাইকে অবাক করে দিয়ে আবৃত্তি করতে থাকেÑ ‘এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;/ বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,/ কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।/ শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে/ সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।/ এদিকে কোকিল ডাকছে পউষের মধ্য রাতে;/ কোনো-একদিন বসন্ত আসবে বলে?/ কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?/ তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হয়ে যেতে দেখেছি,/ তারা কিশোর নয়,/ কিশোরী নয় আর;/ কোকিলের গান ব্যবহৃত হয়ে গেছে।’ হঠাৎ করেই যেন তাদের হৃদয়ে জেগে ওঠে আবার মিলিত হবার বাসনা। বৃক্ষসকল ঘোষণা শুনতে চায় সমুখে থাকা তাদেরই গুরুকণ্ঠে। যে ঘোষণা ঋতুহত্যার বিচারের, যে ঘোষণা নদীহত্যার, যে ঘোষণা মানুষের চেহারায় শিয়াল হয়ে বসবাসের। আশ্চর্য, আপনি চুপ করে আছেন জনাব! কম বয়েসী যে বৃক্ষটি এতক্ষণ কবিতার ঘোরে ছিল, সে-ই বলেÑ মানুষ মানুষ করো না, মানুষ না থাকলে তোমাদের দাম দিত কে? নগরের দামি এই জায়গায় তোমাদের বাসিন্দা করলো তো মানুষেরাই! সমবেত বৃক্ষ সমাবেশে নেমে আসে হীমশীতল নিরবতা। অতঃপর চলতে থাকে চোখ দেখাদেখি, চোখ টিপাটিপি...
ভোরটা ক্রমশ সকালের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আমি, সেই একাÑ যার কি না কোনদিনই কোলবালিশ নেয়ার অভ্যেস ছিল না, সে-ই খাটের পাশে রাখা বইয়ের স্তুপ থেকে আরামচে বুকে টেনে নেয় কতিপয় কঠিন কিতাব। বাইরের দুধসাদা কুয়াশার রেশে তখন ঘর যেন কোল্ড স্টোর! আলগোচে টেনে নেই কম্বলটি। আমার বেহুশ হৃদয়টি তখন হয়তো গেয়ে উঠতে চায়Ñ ব্যাচলরের সম্বল, একটা বালিশ-কম্বল! হিহিহি, কবি হয়ে উঠছি মনেহয়! মনের কি আর সেন্সর আছে? সে যা চায়, যা বোধগম্য, রীতিসিদ্ধÑ সবটাই করে বসে আমার অজান্তে। ঠিক তখনই নস্টালজিয়া নামের ব্যাধিটি আমার কাঁধে সওয়ার হয়ে যায়। সে ফিরে যায় শৈশবের শীতকালে। ন্যাড়াবিলের মাঝ বরাবর যে অস্থায়ী পথরেখা তৈরি হতো, তার সামনে ছেড়ে দেই থুরথুরে হাঁটতে থাকা ভাইপোকে। সে আক্কেলগুনে পথরেখা ধরে হেঁটে যায় জালিয়াখালী বাজারে। থলে ভরে নিয়ে আসে শীতকালীন সবজি। টাইম বাজারের পূর্বদিকে, যেখানটায় জমে আছে ইকোপার্কÑ তার আশেপাশের বেলেমাটিতে বেড়ে ওঠা সবজি বাগানের দিকে মন দিয়ে তাকালে জীবনে আর কিছু দেখা লাগে তার! বেগুন-মূলা-কফি, করলা, হরেক রকম শাকে ভরা একেকটা জমি যেন স্বর্গের সবুজ টুকরো। তা-ই সকাল সকাল চলে আসে জালিয়াখালী বাজারে। আমার ভাইপো সবজির সাথে আনে ধনেপাতা। এত্তটুকুন ছেলে পারলো কেমন? এ্যা! তাকে দেখেই আমার জেঠা নাকি কানে শুনিয়ে বলে, বরবাদ গেল আমাদের ছেলেরা, খালি ঘুম আর ঘুম। দেখ তো নাতিটা কেমন চালাক... পথরেখা আঁকা জমির এককোণায় সমবয়েসীরা বসে যাই আগুন পোহাতে। তা আগুন আর লাকড়ি কোথাই? ওই যে ধান-কাঁটা ন্যাড়া আছে না! কেউ একজন লুকিয়ে রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসে লাইটবক্স। বেশ, ধুমছে চলে আগুন পোহানো। যারা বকা-গালি দিত আমাদের এসব কান্ড দেখে, তারাই হয়তো আগুনের ধোয়ার আমন্ত্রণে চলে আসে আমাদের দিকে। আমরা তাদের একটু সাইট দেই, অগ্রজ বলে। হাত-পা গরম করে, নিজেকে চ্যাকে নিয়ে চলে যায় মাঠে, বাজারে, ব্যবসায় কিংবা অন্য কাজে। ওদিকে আমার ঘুম গভীরতর হতে হতে স্বপ্নটার শেষ দেখতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
গাছেরা আনন্দ কিংবা দুঃখের কথা ভুলে গিয়ে নজর দেয় নিজেদের দিকে। ভাবনায় যোগ হতে থাকে লম্বাটে অথচ কালো একটা দীর্ঘশ^াস। কার দোষ দেই এতক্ষণ? মানুষ! নিজেদের সৌন্দর্য-আকরে মৃত্যুবারতা বয়ে যায় তা খেয়াল করেছো কেউ? ক’দিন আর? সামনের সপ্তাহেই হয়তো ঝরে যাবে নিজেদের অস্থিত্ব বিপন্ন করে। নতুন অতিথি আসবে সেই কবে, কোকিলের যাক শুনে! কিছুই করার নেই, যে যাবে সে যাবেই; এটাই তো বৃক্ষসমাজের নিয়ম, রীতি বলেই মেনে নিয়েছি আমরা। পুরনো পাতা না ছড়ালে নুতন পাতা আসবে কোত্থেকে? পাশের বৃক্ষটি তখন পাল্টা প্রশ্ন করে, সাপের খোলস বদল দেখেছো, কখনো? খানিক ভ্যাবাচেকা খেয়েই তার পাশের যুবক বৃক্ষটি বলে, দেখেনি। তবে রাস্তার মোড়ে কবিরাজের দাবাই বিক্রি দেখেছি, যেখানে সাপের কথা বারবার বলতে শোনা যায়। সাপের মতো মিলন... হিহিহি রব উঠে চারদিক থেকে। অপ্রয়োজনে খিলখিলিয়ে হাসা মানে অশ্লীলতার ইঙ্গিত। ঠোঁটকাটা বৃক্ষটি বলে, নিজেরা করবে, তলেতলে জল খাবে; আর আমরা বললেই যত দোষ! আরেক দফা হাসির তোড়ে লালদিঘী ময়দান কেঁপে উঠে। যোগ হতে থাকে মিলনের আকাঙ্খায় জড়ো হতে থাকা বৃক্ষদের মিছিল।
বাড়তে থাকে কুয়াশার প্রেম। দলবেধে জড়িয়ে ধরে বৃক্ষকে, বাড়িকে, মানুষকে... আমার তখন লোভ লাগে নগরের মোড়ে মোড়ে বসা ভাপাপিঠায়লা হতে। বেকারের দিনে ও ব্যবসাটা মন্দ হতো না। কেউ একজন জিজ্ঞেস করলেই টুপ করে বলতে পারবো, ঐতিহ্য রক্ষা করার কারবারে নামছি ভাই, কি আর করা চুরি তো করছি না; বাটপারি শিখিনি কখনো তারচে ভাপাপিঠা বিক্রি করাই ভালো। চারদিকে লোক ভিড় করবে, কেউ একজন বলবে, মামা দেন, তাড়াতাড়ি দেন। টোকাই যাদের নাম দিয়েছে নাগরিকেরা, তাদের ডেকে হয়তো দু-চারটা পিঠা ফ্রিতে খাইয়ে আনন্দ পাবো। তারা আমাকে বলবে, দেখছেন মামা, মানুষেরা কিভাবে শীতবস্ত্র বিতরণ করছে! খালি ক্যামেরাতে মুখ দেখায়, আমরা গেলে কয়, ধুর, বাগ এখান থেকে... মুখচেনা মানুষদেরই তারা কাপড় দেয়, পাতলা পাতলা কম্বল দেয়... আমি একটা দীর্ঘশ^াস ছাড়ি। আমি কি কোনদিন কাউকে শীতবস্ত্র দিতে পারবো? যে পারে না দিতে, তার কি বড় কথা মানায়? নিজের ছায়াতেই থুথু ছিটাই আমি। যাক বাবা, ওরাও বোঝে যত ভগবাজি। কেউ একজন হয়তো গায়ের আধপুরনো গরমজামাটি দিয়ে দেবে কাউকে, গম্ভীর একটা পোজ দিয়ে ছবিটা আপলোড দেবে ফেসবুকে। আমরা বাহবা দেব। কেউ একজন আবার রাগ করবে, কমেন্ট না করার অভিযোগে।
সমবেত বৃক্ষরা পরামর্শে বসে কী করা যায় এই মরা-মৌসুমে! পাতারা ঝরে যাবে যাক। কী করা যায়, বলুন তো? নেতাগোছের এক বৃক্ষ সবাইকে চোখ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে শুরু করে তার ভেলকিবাজি। হলুদাভ পাতাগুলো তখনো শংকিত, কী হচ্ছে আসলে! চোখ খোলার পরেই আবিস্কার করে, তাদের শক্ত ঢালগুলো হয়ে গেছে একেকটা পাখি। তারা অতিথি পাখির দলে মিশে যায় নিমিশেই। গানের সাথে, উড়ার সাথে, তাদের পথ ভাঙার সাথেই মাটিতে নেমে আসে কবিতার লাইন। গায়ের বধূরা, যারা কিনা মাথায় ওড়ানা না তোলার অপরাধে বকা শোনে শাশুড়ির কাছে, তারাই মোটা কাপড় আর শালে নিজেদের রক্ষা করে। এই সুযোগে শহরের দামি শপিংমলগুলোয় বেড়ে যায় শালের চাহিদা। চড়াদামে কখনোবা ডিসকাউন্টে বিক্রি হয় শাল, দেদারচে। যে পুরুষেরা শাল পড়লে কবি কবি লাগতো তাদের এখন প্রেমিকের মতোন লাগে। অথচ এসব প্রেমিকের বুকে তখন বৃষ্টির প্রার্থনা। বৃষ্টি মানে রাস্তার বিরক্তকর ধূলো মরে যাওয়া, বৃষ্টি মানে আরো ঘনিষ্ঠ হওয়া, আরো আরো শীতলগ্ন হওয়া। বৃক্ষদের পাতা ঝরে যাওয়া, আমের বাগানে মুকুল আসা। আর? আমাদের বিবাহিত প্রেমিকাদের বাড়ি থেকে শ^শুড়বাড়িতে পিঠাপুলি যাওয়া। বাউন্ডুলেদের অবাক চোখে চেয়ে থাকা।
স্বপ্নটা আর দীর্ঘ হতে চায় না। স্বপ্নেরও বুঝি বিরক্তি আসে? মেবি! নিমিষেই জড়ো হওয়া সড়কদ্বীপের বৃক্ষরা বিছিন্ন হয়ে যায় নিজেদের মতো। তারা চলে যায় যার যার ঠিকানায়। ধপাস করে আমি পড়ে যাই, ফ্লোরে। ভেঙে যায় ঘুম। কী হলো আমার! আশ্চর্য, কেউ শোনে না আমার কথা। রুমমেটরা মিনমিনে স্বরে বলতে থাকেÑ ‘ঘোরে তারা শুকনো পাতার পাকে/ কাঁপন-ভরা হিমের বায়ুভরে।/ ঝরা ফুলের পাপড়ি তাদের ঢাকে/ লুটায় কেন মরা ঘাসের’পরে।/ হল কি দিন সারা।/ বিদায় নেবে তারা?/ এবার বুঝি কুয়াশাতে/ লুকিয়ে তারা পোউষ-রাতে/ ধুলার ডাকে সাড়া দিতে চলে/ যেথায় ভূমিতলে/ একলা তুমি, প্রিয়ে,/ বসে আছ আপন-মনে/ আঁচল মাথায় দিয়ে?/ মন যে বলে, নয় কখনোই নয়/ ফুরায়নি তো, ফুরাবার এই ভান।’