দাহ
আহমদ মেহেদী
১
গ্রামাঞ্চলে বেকার ছেলেদের বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার যারা তাদের প্রতি সমাজের কিছু টাউট শ্রেণীর মুরুব্বিদের কত অদ্ভুত অভিযোগ আর কুদৃষ্টি । যেন বেকাররা তাদের ঘরের ভাতে ভাগ বসাবে এমন অবস্থা। ভিলেজ পলিটিক্সের মধ্যে কারুকাজ গুলো চোখে পড়ে তা হল ওমকের ছেলেটি কি করে চলে? কি করছে? এত দামি লুঙ্গি-শার্ট পরে, মোবাইলে কথা বলার এত টাকা কোথায় পায়? এতশত কল্পনা-জল্পনা নিয়ে রোজ চায়ের দোকানে বাাকি চা খেতে দেখা যাায়। মেম্বার-চেয়ারম্যানদের চামচারা এক্ষেত্রে পিএএইচডি ডিগ্রিধারী। তাদের কারও কারওর চুলায় আগুন একবেলা জললে ও আরেকবেলা জলে না। তারা আদৌ ভাবতে শিখেনি যে একজন বেকার ছেলের ও বাবা-মা আছে , হয়তো কেউ লেখাপড়া করছে, কেউ সবেমাত্র পাশ করেছে, চাকরি -বাকরি পেলে কি আর এভাবে বসে থাকবে? এরকম মানসিক অত্যাচারে জর্জরিত আমাদের গ্রামেরই একজন মানিক। এ বছর ডিগ্রি পাশ করেছে। কুমিল্লায় লজিং আর টিউশনি করে নিজেকে চালিয়েছে দীর্ঘ সাত বছর ধরে । সেই দিনগুলো অনেক বেদনার ছিল। বাড়ি থেকে নামমাত্র টাকা নিত সে। পায়ে একজোড়া সান্ডাক জুতা আর এক বন্ধুর দেওয়া জিন্স এবং টিয়া রংয়ের টি শার্টটিই ছিলো তাঁর একমাত্র ভালো পোশাক। হাতে টাকা না থাকলে কলেজে যেতে পারত না। বেশিরভাগই কলেজের বাসে যেতে হতো। বাসে উঠে পোশাকের জন্য সহপাঠীদের বাঁকা চাহনি আর টিসকারির জন্য ও দুঃখবোধ কম ছিলো না। পাশ করে একটি চাকরির জন্য দিনরাত ছুটতে ছুটতেই এক বছর শেষ হতে চলল। এরই মধ্যে তার মেঝো কাকা ঢাকায় একটি পদে চাকরি পাইয়ে দিলেও চাচির বিড়ম্বনায় ছয় মাস করেই ছেড়ে দেয় সে। পারেনি অথচ তারই কাকা এলাকায় প্রচার করেছিল-‘ ভাতিজা কে কত ভালো একটা চাকরি দিলাম; করল না, কোন খানে পাইল্লা কালা হয় না ’ বুঝলেন ভাই। শেষ পর্যন্ত নিজের কাকা দোকান-পাটে তার অকর্মা কপালকে হাজার গালি দিয়েই তবে ক্ষান্ত হলেন। তাদের দু’গন্ডডা জমি ছিল, বোনের বিয়ের সময় এক গন্ডা বিক্রি করতে হয়েছিল । তার চাপাচাপিতে তাঁর বাবা নাকি বলেছেন একটি সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করতে পারলে বাকিটুকুও বিক্রি করে দিবেন।
আমি বেকার মুক্ত হয়েছি গত সেপ্টেম্বরে। একটি এনজিও তে চাকরি করছি। চলে যাচ্ছে কোন রকম। মানিকের। সাথে পাতলা পাতলা যোগাযোগ হতো। স্নেহের হাত বাড়িয়ে দিলাম একসময়কার আমাদের গ্রামের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটিকে। অভাবের কারনে যার সাধের মেধাকে হোচট খেতে হয়েছে বারবার, অবশ্য এতিম হলে ভিন্ন ব্যাপার । একদিন অফিসে কাজ করার সময় কল আসায় স্যার কে বলে বাহিরে গেলাম-হ্যালো,কে? - আসসালামু আলাইকুম ভাই, আমি উওর পাড়ার মানিক। -ও মানিক, কি খবর তোমার? তুমি কই আছ এখন? -ভাই বাড়িতে আছি,ভাই আপনার সাথে একটা কথা বলতাম। -হুঁ বল না ! -কবে বাড়িতে আসবেন? - বৃহঃ বার, আমাকে ঢাকায় যেতে হতে পারে, যদি ঢাকায় না যাই তাহলে ত অবশ্যই যাব। -বৃহঃ রাতে ব্রিজে গিয়ে আপনাকে কল দেব। - আচ্ছা ঠিক আছে।
লাইন কেটে কাজে মনযোগ দিলাম আবার।
২
ঢাকায় যাইনি, বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। বাসে উঠেই জানালার পাশে বসতে চাইলাম কিন্তু আজ সিটই পেলাম না। একজন মুরুব্বি কন্ডাক্টারকে সিট দিতে পিড়াপিড়ি শুরু করলে পাশের সিটের আরেকজন ব্যঙ্গ করে বলছে -‘সিট ত আছেই, খালিয়েনা নাই’। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। গ্রামের রাস্তায় হাটছি আর ভাবছি; রাত দশটা বাজতে না বাজতেই ঘুমের জন্য ছটফটানি শুরু করে দেয় গ্রাামের কাজের মানুষগুলো। ইদানিং কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। দোকানগুিিলতে নির্ববাচন আর রোহিঙাদের খবর দেখছে মন দিয়ে!
রাতে খাবার পর পুকুরের ঘাটলায় বসে আছি এমন সময় বাবা আমার মোবাইলটা নিয়ে এলেন। বাবা -অনেকক্ষন ধরে ফোনটা বাজছে, নে ধর। -মানিক হবে হয়তো। -ও তোকে বলতে ভুলে গেছি মানিকের বাবা এসেছিল গতকাল,তুই নাকি মানিকের একটা চাকরির কথা বলেছিলি তাকে? -হ্যাঁ বাবা, বলেছিলাম।হঠাৎ বাবা কেন জানি তার সাথে চলতে মানা করেন এখনো জানতে পারিনি। পরে শুনি ভাগিনা সজল তার প্রেমিকাকে তুলে নিয়ে গেছে। মামলাও হয়ে গেছে। লোকজন বলাবলি করছে আমাকেও আসামি করা হবে তাই বাবার এমন আদেশ। বাবার চিন্তা আমাকে যেন প্যাচে না আবার ফালায়। বাবা বলে কথা! -বাবাকে আশ্বন্তকরে, ঘুমানোর আগেই ঔষধ খেয়ে নিতে বলাতে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি শোবার ঘরে চলে গেলেন।
৩
গত কয়েকদিন ধরে মানিকের সাথে কথা বলতে চেষ্টা করছি কিন্তু তাঁর মোবাইল বন্ধ। একদিন বিকেলে কম্পিউটার সেন্টারে গেলাম ইমেল করার জন্য, বাবার মত বয়সী লোকটি টাইপ করে চলেছেন আর আমি পাশে বসে দেখছি (তাঁর মেশিনের মত হাতের কারিশমা দেখে মুগ্ধই হলাম)। এসময় মোবাইলে রিং বেজে উঠায় আমি সেন্টার থেকে বের হয়ে গেলাম।
-হ্যালো বলার আগেই ওপার থেকে বলল, ভাই আমি মানিক।
-ও মানিক তুমি, তোমার নাম্বার বন্ধ কেন? তুমি ভালো আছ? -ভাই এখন থেকে এই নাম্বারে কথা হবে, ঐ নাম্বারে মেম্বারের ছেলে হুমকি দেয় -গালাগালি করে তাই বন্ধ করে দিয়েছি! -তুমি এখন কই আছ? - কারো কাছে বইলেন না, আমি এখন নোয়াখালী আছি সজলের এক বন্ধুর বাসায়। -আরে না কি বল তুমি। -ভাই আপনার না একজন ক্লাসমেট আছে এডভোকেট? - সে নাকি লন্ডনে আছে বর্তমানে তাঁর পিএইচডি করার কাজে। সে আসতে দেরী হবে। -ভাই আপনি কিছু মনে করবেন না, আপনি শুধু শুধু আমার জন্য মামলা খেলেন, যে কাজ জীবনে হয়নি! -আরে না, দুএকটা মামলা না খেলে নাকি সাহস হয়না (হাহাহা)। -তারপর ও ভাই আমার সাথে চলেন বলেই তো! চিন্তা করনা, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। -আচ্ছা সজল কই? -সে কক্সবাজার আছে, ভাই শুনলাম মেম্বার রে নাকি পিটিয়ে ছে খুব ? -হুঁ, হয়তো তিনি আর ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারবেন না। এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে, সজলের নাম শুনলেই এলাকায় কেউ আৎকে উঠছে আবার কেউ কেউ তাঁর চৌদ্দগোষ্ঠীকে গালাগালি করছে। চেয়ারম্যান ও হতবাক সজল্লাইর এতবড় সাহস? তিনি নাকি দেখে নিবেন! -ছোট ভাইয়ের কাছে যা শুনলাম বুঝেছ? -তো ভাই আপনার শরীরের অবস্থা ভালো? -হ্যাঁ, ভালো। -ঠিক আছে মানিক তুমি ভালো থেকো, তোমার নাম্বারটা সেভ করে রাখলাম। -আর সজলের সাথে কথা হলে বলবে আমাকে ফোন দিতে। -আচ্ছা ভাই।
সবমিলিয়ে পাঁচটি মামলা হয়েছে সজল আর মানিকের নামে সাথে গং। চেয়ারম্যান সজল ও মানিকের বাবাকে এলাকায় অনেক হুমকি- ধামকি এমনকি মেরে ফেলার ও ভয় দেখায় মেম্বারের মেয়েকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। পরের মামলায় আমাকে আর জড়ানো হয়নি। মেম্বারের ছেলেই কাজটি করেছিল। আমাকে মামলা দেয়ার কারনে সে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল আর বলেছিল -তুমি এলাকায় আসবে, তোমার কোন সমস্যা নাই। মনে নাই তুমি একদিন আমাকে কলেজে মারের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলে? যাই হোক মানুষ মানুষের উপকার মনে রাখে না এযুগে তা ভুল প্রমাণিত হল ফিরোজের কথায়।
৪
শোনা কথা। সজল তখন ছোট ছিল, সবেমাত্র থ্রি তে পড়ে। বাজারে মসজিদের পাশে তাদের তিন শতক জায়গা ছিল। তাঁর বাবা জুতা -ব্যবসা করতেন। টাকা -পয়সার কারনে তিনি এই জায়গায় একটি ঘর ও তুলতে পারেননি। ঠিক তখনই মেম্বারের ক্ষমতার দাপটে তাদের জায়গাটা ভোগ -দখল করে আছেন ষোল বছর ধরে। বাবার প্রতি সমাজের বিচার, তাদের নিজস্ব জায়গা আর পরের! এটা কেমন বিচার? এসব জিজ্ঞাসা পোষে মনে চাপা -ক্ষোভের জন্ম হয়েছিল ষোল বছর আগে। আজ যা ঘটেছে তা ঐ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
চেয়ারম্যান গ্রাম্য -সালিশের মাধ্যমে নিজের মনমতো সমাধান করতে চেয়েছিলেন। যে সমাজ সজলদের পিষ্ট করে দিতে চায় সে সমাজ থেকে সজলরা ও অনেক কিছু শিখে ফেলে। সজল শুধু চেয়ারম্যান কে বলেছিল- মেম্বারের অবস্থা ত দেখেছেন? নতুন করে খেলতে চাইলে আমি রাজি (হাহাহা)। -চেয়ারম্যান নিশ্চুপ।
এরপর সজল তাঁর মেয়ে কে ফিরিয়ে দেয় , কিন্তু রোকছানা সজলকে সত্যি ভালবেসে ফেলে। বাজারের ঐ জায়গাটা খালি করে দিতে বাধ্য হয় মেম্বার । নিজের জায়গা এখন সত্যিই নিজের!
৫
চেনা মানুষ গুলো দুরে থাকলে মন কেমন জানি করে ওঠে। সজল আর মানিক দুজনেই ফিরেছে। গ্রামের ভালো-মন্দ বিচার করে। সময়ের পরিক্রমা মানুষকে অনেক বদলে দেয়। তাদের আজ কোন মামলা নেই ; মেম্বার কে সজল উন্নত চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তুলে। পরস্পরের কোন বিরোধ নেই। ছায়া -ঘেরা গ্রামটিতে যেন শান্তির দূত নেমে এসেছে ! বাজারের জায়গায় সজল একটি শপিংমল দেয়। ফিরোজ কে একটি দোকান একেবারেই উইল করে দিয়ে দেয়, মনিরাকে গ্রামের সকল কে নিয়ে বিয়ে করে সে। মানিককে একটি ভালো চাকরি দিয়ে দেয়। আমার জন্যে ও চেষ্টা করছে। এভাবেই কিছু মানুষ রূপী দেও অন্যায় আর ব্যাবিচার দেখা ছেলেবেলা থেকেই নিজ- ভুবনে একটি দাহ তাকে সত্যিকারের মানুষ করে তুলেছে । সমাজের এমন দাহে যেন আর কেউ না পুড়ে সেই চেষ্টাই করে চলেছে সজল। অবিচার থেকে মুক্তি পেলেই সমাজ হবে সুশৃঙ্খল, কেটে যাবে অন্ধকার। ন্যায় আর মনুষ্যত্ব জেগে উঠবেই ; মানুষের ভালোবাসাই পৃথিবীর দামী সম্পদ যা পথ খুজেঁ দেয় সমাজের নিভু নিভু আলোগুলি কে। সেই আলোর ঝলকানিতে পুড়ে যাক ঘাপটি মেরে থাকা সকল আধার মানুষের জীবনের!