গল্প : একজন শ্রমিকের গল্প




একজন শ্রমিকের গল্প
কবির কাঞ্চন

পিনাকী দু'হাতে অনবরত মেশিন ঘুরাচ্ছে। গা থেকে অবিরম ঘাম ঝরছে। তবু গায়ের কষ্ট একদম মুখে বোঝা যাচ্ছে না। ওর মুখে জুড়ে সারাক্ষণ হাসি থাকে। সিনিয়রদের আদেশ যথাযথভাবে পালন করে। আবার বয়স ও উচ্চতায় সবার চেয়ে ছোট হওয়ায় ফ্যাক্টরীর সবাই ওকে খুব আদর করে।
ও যেদিন প্রথম এই ফ্যাক্টরীতে চাকরি নিতে আসে, সেদিন থেকে ওর প্রতি ম্যানেজমেন্টের লোকজনের স্নেহের দৃষ্টি আছে।
ওকে যেখানে শিশু বলে চাকরিতে নিচ্ছিলেন না, সেখানে এখন সবাই ওর ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে।
ওর মায়ের শারীরিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করে। ওর পড়াশুনা চালিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা জোগায়।

এক সময় পিনাকীর জীবনকাল বেশ ভালোই কাটছিল। তখন ওর বাবা, অপু চৌধুরী একটি স্কুলের সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি করতো। বেসরকারি স্কুলে মাসে যে সামান্য বেতন পেতেন তা দিয়ে নিয়মের মধ্যে থেকে ভালোই এগুচ্ছিলেন। পিনাকীর মা ছিলেন পুরোপুরি ঘরমুখো মহিলা। কোনদিন ঘরের বাইরে তার পদচিহ্ন পড়েছে বলে মনে হয় না।
পিনাকীর বাবা ছেলেকে নিয়ে উচ্চস্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ছেলেকে দুরন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তৈরি করতে চাইলেন তিনি। পিনাকীও সেপথে এগুচ্ছিল। পঞ্চম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ সহ ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করে সে।
এরপর বুকভরা আশা নিয়ে তাকে নিজের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করালেন। ষষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় ও প্রথম স্থান লাভ করে। স্কুলের সব শিক্ষক পিনাকীর প্রশংসা করেন। বাবা হিসেবে পিনাকীকে নিয়ে ওর অপু চৌধুরীরও গর্ব হয়।
সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে নিয়মিত ক্লাস করতে থাকে সে।
কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষার ঠিক দুইদিন আগে অপু চৌধুরী
বাসায় এসে ভাত খেয়ে শুতে গেলেন। মিনিট পাঁচেক পর " বুক ব্যথা! বুক ব্যথা! " বলে তিনি চিৎকার করতে লাগলেন। পিনাকী ও ওর মা দৌড়ে তার কাছে ছুটে আসে।
অপু চৌধুরী তখনও অনবরত ঘামছেন। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
- বাবা, পিনাকী আমার আরো কাছে এসো।
এরপর পিনাকীকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
- আমার হাতে মনে হয় আর বেশি সময় নেই। বাবা, বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হবে। সব সময় সৎপথে চলবে। আর একটা কথা, কখনও কারো সম্পদের দিকে লোভ করো না। নিজের যেটুকু রবে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থেকো।
এবার অপু চৌধুরী স্ত্রীর দিকে মায়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
- আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, মনিকা। আমি তোমাদের জন্য তেমন কিছুই রেখে যেতে পারলাম না। তোমরা আমায় ক্ষমা করো।
এরপর পিনাকীর হাতটা আলতো করে ওর মায়ের হাতে দিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন অপু চৌধুরী।
হঠাৎ তার চোখ দু'টো বন্ধ হয়ে গেল। নিথর দেহ মেঝেতে পড়ে আছে। হাতদু'টো জড়বস্তুর ন্যায় পড়ে রইলো। কোন নড়াচড়া নেই। বাবাকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে পিনাকী বাবার হাতদু'টো ধরে টানতে টানতে বলল,
- বাবা, এখন ঘুমিয়ে গেলে কেন? উঠো, আমাদের সাথে কথা বলো।
পিনাকীর মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বুকফাটা আর্তনাদ শুরু করেন।
মাকে কাঁদতে দেখে পিনাকীও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।

পিনাকীর বাবার সৎকার করার সাথে সাথে যেন ওদের সব সুখেরও সৎকার হয়ে যায়। স্বামীর জন্য চিন্তা করতে করতে দিনেদিনে অসুস্থ হয়ে পড়েন পিনাকীর মা।

পিনাকীর বাবা মারা যাবার পর প্রথম প্রথম অনেকেই এগিয়ে এসেছিল। সবাই সমবেদনা জানিয়েছে।
কেউ কেউ সাহায্যের হাতও বাড়িয়েছিল। কিন্তু সময় যতোই গড়াচ্ছিল ততোই কেটে পড়ছিল সবাই।

দিনেদিনে পিনাকীর বয়সও বাড়ছে। অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষার পর ফল বের হলো। পিনাকী এবারও জিপিএ-৫ পেয়েছে।
পিনাকীর মা স্বামীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পিনাকীর পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
স্বামীর রেখে যাওয়া সামান্য সম্পদের ওপর ভর করে এতোদিন চলেছেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে বিছানার সঙ্গী হওয়ায় এখন আর সংসার খরচও চলে না।
তার ওপর নিজের জন্য ঔষধ কেনার টাকাও নেই। ইত্যাদি ভেবে ভেবে তিনি খুব দিশেহারা হয়ে পড়েন। একসময় পিনাকীদের জীবনে নেমে আসে চরম দারিদ্র। সব আশা নিরাশায় পরিণত হলে পিনাকী চাকরির জন্য এই ফ্যাক্টরীতে ছুটে আসে।

একদিন পিনাকীদের ফ্যাক্টরীর মালিক, রাতুল চৌধুরী কাউকে কোন কিছু না জানিয়ে ফ্যাক্টরীর প্রোডাকশন সেকশনে চলে আসেন। তিনি ধীরপদে ঘুরে ঘুরে সবার কাজ দেখছেন। যারা মালিককে আগে থেকে চিনতো তারা বসা থেকে উঠে নিচুগলায় সালাম দিলে তিনি সবাইকে শব্দ না করে কাজ করার ইঙ্গিত করেন।

পিনাকী তখনও গভীর মনযোগ দিয়ে মেশিনে কাজ করছে। রাতুল চৌধুরী ওর সামনে এসে বেশ কিছু সময় ধরে নির্বাক  দাঁড়িয়ে থাকেন। হঠাৎ আগন্তুক ব্যক্তিকে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে মেশিনে হাত চালাতে চালাতে বলল,
- আসসালামু আলাইকুম, স্যার।
- তোমার নাম কি?
- ‎পিনাকী।
- ‎কত বছর ধরে এখানে কাজ করছো?
- ‎এই দুই বছর হবে।
- ‎এত অল্প বয়সে চাকরি করছো কেন?
- ‎সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য।
- ‎ঠিক বুঝলাম না। খুলে বলবে?
পিনাকী কাজ বন্ধ করে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
- আমার দরকার ছিল বলে চাকরি নিয়েছি। আর আপনি আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না, পি¬জ। আমার হাতে এখন অনেক কাজ।
- ‎তুমি চাইলে তো কাজে ফাঁকি দিতে পারো।
মুখে বিরক্তির ছাপ এনে পিনাকী বলল,
- আপনি কে? আমি তা জানি না। তবে একটা কথা জেনে রাখবেন, মাস শেষে আমার মালিক আমাকে আমার ন্যায্য বেতনভাতা দেন। আমি আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে আমার মালিকের লাভ হবে না। আর মালিকের লাভ না হলে এক সময় ফ্যাক্টরী বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তখন আমরা চাকরি করবো কোথায়?
- ‎তবুও----।
এই কথা শোনে পিনাকী লোকটার ওপর রেগে গিয়ে বলল,
- আপনি এখন যান তো। আমার কাজের ডিস্টার্ব হচ্ছে।
পিনাকীর লাইনের সুপারভাইজার এগিয়ে এসে কিছু বলতে চাইলে মালিক তাকে চোখের ইশারায় নিষেধ করেন।
এরপর পিনাকীর মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি বাইরে চলে যান।
লাইন সুপারভাইজার পিনাকীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- এই পিনাকী, তুমি উনাকে চিনতে না!
- ‎না, কে উনি? অনেকক্ষণ ধরে আমার কাজের ডিস্টার্ব করছিলেন।
- ‎তুমি উনার সাথে যেভাবে কথা বলেছো তা একদম ঠিক হয়নি। আগে তোমার বোঝা উচিত ছিল, মন চাইলেই বাইরের যে কেউ এখানে আসতে পারেন না। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই আসতে হয়। তাছাড়া যারা আসেন তারা সবাই কর্তৃপক্ষেরই লোক।
আমার মনে হয় আজই তুমি চাকরিটা হারাবে।
- ‎কেন? উনি কে ছিলেন?
- ‎উনিই আমাদের ফ্যাক্টরীর মালিক। রাতুল চৌধুরী। খুব ভালো মানুষ। শ্রমিকদের মনে কোনরূপ অসন্তুষ্টি আছে কিনা তা জানতে স্যার প্রায়ই এভাবে স্বশরীরে ফ্যাক্টরী ভিজিটে আসেন।

পিনাকী চিন্তিত হয়ে ভাবতে লাগলো- আমি তো স্যারের সাথে অন্যায়মূলক কোনকিছু বলিনি। স্যার রাগ করে আমায় চাকরি থেকে বাদ দিবেন কেন? আল¬াহ কপালে যা রেখেছেন তা-ই হবে।
লাইন সুপারভাইজার বললেন,
- আবার কী ভাবছো?
- ‎না, কিছু না।
পিনাকী আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। আরও দুই ঘন্টা পর মধ্যাহ্নভোজের বিরতি হলো। পিনাকী  সবার সাথে একসাথে লাঞ্চ করছে।
এই ফাঁকে পিনাকীর লাইন সুপারভাইজারের কাছে অফিস থেকে একটা চিরকুট এলো।
দুপুর ২:০০ ঘটিকায় পিনাকীকে ফ্যাক্টরীর মালিকের কক্ষে ডাকা হয়েছে।
লাইন সুপারভাইজার সেই প্রথম থেকেই ওর কাজে সন্তুষ্ট ছিলেন। পিনাকীর বয়স কম হলেও তার লাইনের সবচেয়ে একটিভ ছেলে পিনাকীই। যদি ওর চাকরি চলে যায়, তবে আমিই মালিকের হাতে-পায়ে ধরে হলেও ওকে আবার কাজে নিয়ে নেবো।

এরিমধ্যে আবার সবাই যার যার আসনে গিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
লাইন সুপারভাইজার পিনাকীর কাছে এসে বললেন,
- পিনাকী, তোমাকে মালিকের কক্ষে ডাকা হয়েছে। কোন চিন্তা করো না। মালিক যা বলবেন, বুঝে শুনে সুন্দরভাবে জবাব দিও।
- ‎জ্বি, তাহলে আমি আসছি।
এই কথা বলে পিনাকী মালিকের কক্ষের দিকে পা বাড়ায়।
ফ্যাক্টরীর ম্যানেজমেন্টের সাথে মিটিং-এ  বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর নেন রাতুল সাহেব। এক পর্যায়ে
তিনি ম্যানেজারের ওপর রেগে গিয়ে বললেন,
- আমার ফ্যাক্টরীতে শিশুশ্রমিক কেন? আপনাদের কতো করে বলেছি, ফ্যাক্টরীতে কোন শিশুকে যেন চাকরি দেয়া না হয়। সরকার ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা শিশুশ্রম বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে দেখছে।
পিনাকীর মতো আর কতজন আছে?
- ‎না, স্যার, পিনাকী ছাড়া আর কোন শিশুশ্রমিক নেই। ওকে চাকরিটা মানবিক দিক বিবেচনা করে দেয়া হয়েছে।
- ‎মানবিক বিবেচনায় মানে!
- ‎ছেলেটার বাবা মারা গিয়েছে। তার ওপর মাও অসুস্থ, মৃত্যু পথযাত্রী। ও খুব মেধাবী। পিএসসি ও জেএসসিতে এ+ পেয়েছে। শুধু অর্থের অভাবে মায়ের চিকিৎসা ও নিজের পড়াশুনা চালিয়ে নিতে পারছিল না। মূলতঃ এইসব বিবেচনা করেই ওকে চাকরিতে নেয়া হয়েছে। তাছাড়া ওর কাজের রিপোটেশনও ভাল।
- ‎ও কি এখন পড়াশুনা কন্টিনিউ করছে?
- ‎জ্বি স্যার, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ফ্যাক্টরী থেকে ফিরে গিয়ে বাকী সময়টা ও পড়াশুনাতেই কাটায়। আবার পরীক্ষার সময় এলে ছুটি নিয়ে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে।

দুপুর ২:০০ টা। পিনাকী সালাম দিয়ে অনুমতি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। রাতুল চৌধুরী পিনাকীর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন,
- তুমি আমাকে আগে কখনও দেখোনি?
পিনাকী নম্রগলায় বলল,
- না, স্যার, আমি এর আগে আপনাকে কখনও দেখিনি। তাই চিনতে পারিনি। কাজের ব্যস্ততায় আমি আপনার সাথে সুন্দর করে কথা বলিনি। আপনার মনে কষ্ট দিয়েছি। আমায় ক্ষমা করুন, স্যার। দয়া করে আমাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করবেন না। এ চাকরিটা আছে বলে, মায়ের চিকিৎসা করাতে পারছি। আমার পড়াশুনাও চালিয়ে যেতে পারছি। চাকরি না থাকলে তো আমার সব শেষ হয়ে যাবে।
- ‎আজ থেকে এই ফ্যাক্টরীতে তোমাকে  চাকরি করতে হবে না।
পিনাকী কেঁদে কেঁদে বলল,
- দয়া করে আমাকে চাকরি থেকে বাদ দিবেন না, স্যার।
পিনাকী উপস্থিত সবার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথানিচু করে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।
রাতুল চৌধুরী আবার বললেন,
- তুমি মাস শেষে কত টাকা বেতন পাও?
- ‎স্যার, ৯৫০০টাকা।
- ‎তাতে কি হয়?
- ‎জ্বি, কোনমতে হয়।
- ‎চাকরি চলে গেছে বলে খুব ভয় পেয়ে গেলে?
- ‎স্যার, পি¬জ আমাকে মাফ করবেন।
এই কথা বলে ফ্যালফ্যাল করে কাঁদতে থাকে পিনাকী। ততক্ষণে রাতুল চৌধুরী চেয়ার থেকে উঠে এসে পিনাকীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
- আমি তোমার আচরণে খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। সবাই তোমার মতো কাজ করলে আমাদের ফ্যাক্টরীর সমৃদ্ধি হতে বেশি সময় লাগবে না। আগামীকাল থেকে তুমি নিয়মিতভাবে স্কুলে যাবে। ফ্যাক্টরীতে আসবে প্রতি মাসের এক তারিখে। শুধু বেতন নেয়ার জন্য। আর হ্যাঁ, তোমার মায়ের চিকিৎসার খরচও আমি দেবো। কী,এখন খুশি তো?
পিনাকী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মালিকের মুখের দিকে পরম কৃতজ্ঞতায় তাকিয়ে রইলো।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট