ওগো বাদলের পরী
যাবে কোন্ দূরে ঘাটে
বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী
মোস্তফা কামাল গাজী
গ্রীষ্মের প্রচ- রোদ্দুর আর তাপদাহের পর ঘন গৌরবে নব যৌবনে আসে বর্ষা। জরাজীর্ণ প্রকৃতি সিক্ত হয় আল্লাহর বর্ষিত বৃষ্টিজল দিয়ে। বাংলাদেশের প্রকৃতিতে আষাঢ় ও শ্রাবণ বর্ষাকাল। এ দুমাস বর্ষাকাল হলেও এর ব্যাপ্তি আরো বেশি। ষড়ঋতুর লীলার মাঝে বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যে বর্ষাকাল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। বসন্তকে ঋতুরাজ বললেও রূপের গৌরব ও প্রকৃতির সৌন্দর্যে বর্ষাই প্রকৃতির রাণী। বর্ষার আগমনে খাল-বিল জলমগ্ন হয়ে যায়। জনজীবনে নেমে আসে আনন্দঘন পরিবেশ। মেঘেরা ডেকে যায় ‘গুড়–ম গুড়–ম’ শব্দে। কালো মেঘের ভেলা ভেসে যায় পশ্চিম দিগন্তে। আকস্মিক বিদ্যুৎ রেখা চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আকাশ ছাপিয়ে নামে বৃষ্টি। আল্লাহর নেয়ামত সে বৃষ্টি প্রবাহিত হয় ফসলের মাঠ, নদীনালা, খালবিল সবখানে। একটানা রিমঝিম শব্দের দ্যোতনায় উদাসী বনে যায় মন। টাপুরটুপুর বৃষ্টিফোঁটা পত্রপল্লবে দিয়ে যায় সজীবতার ছোঁয়া। ধুয়ে দেয় তরু-মহীরুহের সকল পঙ্কিলতা। ঝুম বৃষ্টি পুকুরজলে পড়ে ঝুমুরঝুমুর শব্দ তোলে। মনে হয় যেনো নূপুর পায়ে কিশোরী পুকুরজলে নৃত্য করছে।
বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায় খাল-বিল, নদী-নালা। চারদিকে থৈ থৈ করে নতুন পানি। গ্রামগুলোকে তখন মনে হয়, বিশাল সমুদ্রে ভাসছে ছোট ছোট কয়েটা দ্বীপ। নতুন পানি পেয়ে আনন্দে ভেসে বেড়ায় নানান প্রজাতির মাছ। গাঁয়ের বিলকে অনিন্দ্য আর বাহারি রূপে সাজায় সাদা শাপলা। ছোট ছেলেমেয়েরা কলাগাছের ভেলায় চড়ে তুলে আনে শাপলা, শালুক। পরিষ্কার জলে ডুব সাঁতার দিয়ে হার মানায় পানকৌড়িকেও। জেলেরা জাল ফেলে ধরেন ছোট-বড় অনেক মাছ। বর্ষায় জেলেদের আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে ওঠে এই মাছ শিকার। চাষিরা ফলান আউসের ধান। উদাস হয়ে পল্লীবধূ ঘোমটা পরে রাঙামুখ টেনে ছই নৌকোয় বাপের বাড়ি নাইয়র যায়। চারদিকে বয়ে চলে রংবেরঙের পালতোলা নৌকো। মাঝি আনন্দসুখে গলা ছেড়ে গান ধরেন। ঘরের দাওয়ায় বা জানালর পাশে বসে বৃষ্টির ঝরে পড়া দেখতে বেশ ভালই লাগে। এ সময় দাদা-দাদিরা ছোটদের সামনে গল্পের ঝুলি খুলে বসেন। বিকেলে আয়োজন হয় চালভাজা ও মুড়ি-মুড়কির। বাড়ির বউ-ঝিরা তখন নিজেদের মনের কল্পনাগুলো ছড়িয়ে দেন নকশীকাঁথায়। পুকুরপাড়ের কদমগাছে ফোটে হাজারো কদম ফুল। মনে হয় যেনো কয়েকশ ঝাড়বাতি কেউ ঝুলিয়ে রেখেছে গাছে।
গ্রামের মতো শহরে বর্ষার সৌন্দর্য খুব একটা ফুটে ওঠে না। তবুও ইট-পাথরে ঘেরা শহুরে লোকজনও বর্ষার সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঝুম বৃষ্টিতে কেউ কেউ গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায় বর্ষার পরশ পেতে। কেউ ছাদে উঠে বৃষ্টির ছোঁয়া নিয়ে জুড়িয়ে নেয় দেহ-মন। কেউ ফিরে আসেন গ্রামে।
বাংলা ভাষায় এ পর্যন্ত বৃষ্টির রিমঝিম মিষ্টি সুরে রচিত হয়েছে শত শত ছড়া, কবিতা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,
‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।/কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।/রাশি রাশি ভারা ভারা/ধান কাটা হল সারা,/ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।/কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।’
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘ওগো বাদলের পরী!/যাবে কোন্ দূরে ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী!/ওগো ও ক্ষণিকায়, পুব-অভিসার ফুরাল কি আজ তব?/পহিল ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন্ দেশ অভিনব?’
কেবল রবীন্দ্রনাথ বা নজরুন নন, যুগে যুগে অনেক কবি-সাহিত্যিক মানুষের হৃদয়ানুভূতিকে মেঘে সঞ্চারিত করেছেন, বৃষ্টির জলধারায় করেছেন সিঞ্চিত। শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীতে বর্ষা পেয়েছে এক চিরায়ত মর্যাদা।
বাংলাদেশের প্রকৃতিতে এই মেঘ-বর্ষার একটি পৃথক রূপ আছে। এই বৃষ্টি আর মেঘ মানুষের মনকে করে তোলে উদাস ও ব্যাকুল। মন হয়ে ওঠে চঞ্চল, স্মৃতিভাবাতুর। মনে হয় যেন বহুযুগের ওপার হতে নেমে আসছে এই বৃষ্টি। ভাবুক মন হারিয়ে যায় কেবল কোন দূর অজানায়।
বর্ষার সৌন্দর্য অতুলনীয় হলেও কোনো কোনো সময় বর্ষাকাল হয়ে ওঠে মানুষের জন্য চরম দুর্ভোগের। বৈরি আবহাওয়া আর অতিবৃষ্টিতে বন্যার সৃষ্টি হয়। ফসলাদি তলিয়ে যায়। কৃষক আর হতদরিদ্র মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না তখন।
মানুষ তবুও বর্ষাকে আপন করে নেয়। কারণ, বর্ষাকালের সঙ্গে কৃষির রয়েছে গভীর সম্পর্ক। বর্ষার প্রকৃতিতে ¯্রষ্টার পরিচয় সহজেই ধরা দেয় মানুষের কাছে। বর্ষা প্রকৃতিকে যেমন সতেজ ও গতিময় করে তোলে, তেমনি মানুষের মনকেও করে তোলে সহজ, সরল ও ছন্দময়। সৃষ্টিশীল চেতনাকে করে সুচারু ও তীক্ষ্ম। একজন ভাবুকের জন্য স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে নিয়ে ভাবার উপযুক্ত সময় এটা। বর্ষার নির্মেদ প্রকৃতি ফুরফুরে অনুভূতি সৃষ্টি করে প্রতিটি অন্তরে। উচ্ছ্বাস ও ভাবাবেগে তাড়িত করে সকলকে। বর্ষার প্রকৃতি জাগ্রত করে উদার, প্রেম ও ভালোবাসার সরল অনুভূতি।