অনুতপ্ত
এমএ ওহাব মণ্ডল
কারণে অকারণে লতিফ সাহেব খালেদা বেগমের গায়ে হাত তোলেন। অশ্লীল ভাষায় বকাবকি করেন। যা মাত্রাতিরিক্ত। খালেদা বেগম স্বামীর এমন অনাকাক্সিক্ষত আর অপ্রত্যাশিত অত্যাচারে অতিষ্ট। তবু কিছু বলেন না বা করেন না। কেননা, এটি অধিকাংশ বাঙালি নারীদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। স্বামী সংসারের প্রতি দায়িত্ব বা মমতা অনেক বেশি। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই স্বামীর সব অবিচার হজম করে চলেছেন বেচারি খালেদা বেগম।
প্রায় দশ বছরের দাম্পত্য খালেদা বেগমের। দশ বছরের সংসারে একটি কন্যা সন্তান দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা।। নাম লাবিবা। খালেদা বেগমের বিয়ের পাঁচ বছরের শেষান্তে শ্বশুর ইন্তেকাল করেন। খালেদা বেগমকে পুত্রবধূ হিসেবে পেয়ে মোখলেছ সাহেব ভীষণ খুশি এবং গর্বিত। এমন ধৈর্যশীলা মেয়ে সমাজে খুব নগন্য। মোখলেছ সাহেব খালেদা বেগমের শ্বশুর। পুত্রবধূর ওপর ছেলের অমানবিক আচরণের কারণে তিনি খালেদা বেগমকে মাঝেমধ্যে পরিতাপ করে বলতেন- ‘মা তুমি বাপের বাড়ি চলে যাও।’ পুত্রবধূর দাম্পত্যের কষ্টে তিনি কাঁদতেন। নিজের বাবা-মাকে হারিয়ে শ্বশুরালয়ে খালেদা বেগম বাবা-মা না থাকার সেই শূন্যতা কোনো দিনও অনুভব করেননি। খালেদা বেগমের বাবা-মা অনেক আগেই পরলোকে চলে গেছেন। তাঁরা মৃত্যুকালে লতিফ সাহেবকে বার বার হাতজোর করে মিনতি করে বলে গেছেন-
‘বাবা, আমার মেয়েকে তুমি দেখে রেখো। বড্ড আদরের মেয়ে। ওকে মারধর যেন করো না। ছোট বেলা থেকে খুব যতœ আর ভালবাসার ভেতর থেকে ও বড় হয়েছে।’ মৃত্যুর পূর্বে এই কথা গুলোই বারবার লতিফ সাহেবকে খালেদা বেগমের বাবা-মা বলে গেছেন। কিন্তু তাতে কোনো ফলাফল আসে না। ইচ্ছে করলে উনারা তালাকের ব্যবস্থা করে খালেদা বেগমকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা সেই কাজটি করেননি। তাঁরা ভেবেছেন-দ্বিতীয় জায়গায় সুখী হবে সেটারও তো নিশ্চয়তা নেই। এই ভেবে মেয়েকে বারবার সান্তনা দিয়েছেন। আর বলেছেন-কপালে সুখ থাকলে তা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। ভাগ্যের প্রতিও বিশ্বাস থাকতে হয়।
‘বাবা আর মেরো না, ছেড়ে দাও মাকে। তোমার পা ধরে বলছি-মা মরে যাবে বাবা।’ কথা গুলো লাবিবা ওর বাবা লতিফ সাহেবকে কাঁদতে কাঁদতে বলছে। কিন্তু সন্তানের এমন আহাজারিতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই নির্মম লতিফ সাহেবের। মার খেতে খেতে একসময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে খালেদা বেগম। লাবিবা নিথর মাকে জড়িয়ে গগনবিদারী কাঁন্নায় ডুকরাতে থাকে। খালেদা বেগমের অবস্থা বেগতিক হওয়ায় দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা আর ডাক্তারের নিবির পর্যবেক্ষণে সুস্থ্য হয়ে ওঠেন খালেদা বেগম।
প্রায় পনেরো দিন পরের কথা। একমাত্র বোনের ওপর পাশবিক নির্যাতনের কথা শুনে নূও হোসেন খালেদা বেগমের বাড়িতে আসেন। খালেদা বেগমের একমাত্র বড় ভাই নূর হোসেন। নূর হোসেন লতিফ সাহেবকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন-
‘তুমি খালেদার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানোর কারণ কী? বিয়ের পর থেকে তুমি খালেদার ওপর অবিচার করে আসছো। শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদেরও তুমি পছন্দ করো না। তোমার বাড়িতে কেউ এলে বাড়তি অশান্তি করো। যে কারণে তোমার বাড়িতে শ্বশুর বাড়ির কেউ আসেও না। আজ আর স্থির থাকতে পারলাম না। আমাকে আসতে বাধ্য হতে হলো। কি পেয়েছো তুমি?
লতিফ সাহেব কোনো কথা বলেন না। মাথা নিচু করে আছেন। নূর হোসেন আবার বললেন-
‘কথার উত্তর দিচ্ছো না কেন? কোনো মানুষ যদি নিজের ইচ্ছেয় ভালো না হয় তাহলে সারা জীবন তাকে মেরেও ভালো করা যায় না। যদি মানুষকে মেরে ভালো করা যেতো তাহলে তোমাকে অনেক দিন আগেই পিটে গায়ের চামড়া তুলে দিতাম। তোমার লজ্জা করে না সন্তানের সামনে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে? স্ত্রীকে মেরে কী খুব মহৎ পুরুষ হওয়া যায়? তোমারও তো একটা কন্যা সন্তান আছে। লাবিবাকে যদি ওর বর ভবিষ্যতে এমন নির্যাতন করে মেনে নিতে পারবে? যদি তোমার বোনকে কেউ এমন পাশবিক নির্যাতন করতো তাহলে কী তুমি তা মেনে নিতে পারতে? তোমার সংসারে আমার বোনকে না রাখলে কী হবে? আসলে তোমাকে ভালবাসাটা বেশি হয়ে গেছে। এই বয়সে তোমার এমন আচরণ দেখে আমি নিজেই রীতিমতো লজ্জ্বা পাচ্ছি। মানুষ এক সময় মন্দ থাকে। সন্তান হলে বা বয়স বাড়লে আচরণের পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু তোমার ভেতর কোনো পরিবর্তন নেই। তোমার গায়ে কখনো হাত তুলিনি। তুলতেও চাই না। তুমি খালেদাকে ডিভোর্স দেও। আজই। এক্ষুণি।
খালেদা বেগম ভাইয়ের এমন কথা শুনে ভাইকে বলেন-
‘ভাইজান, তুমি ডিভোর্সের কথা বলো না। লাবিবার কী হবে। ও তো পরিচর্যাহীন হয়ে পড়বে। আমার নিজ হাতে সাজানো সংসার। বড্ড মায়া জমে আছে এই সংসারের প্রতি। আমি আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারি না।
খালেদার মুখের কথা শুনে নূর হোসেন লতিফ সাহেবকে বলেন-
‘শুনলে, শুনলে তো খালেদার মুখের কথা। সংসার, সন্তানের প্রতি একজন মায়ের দায়িত্ব কত বড় দেখলে। এই দায়িত্ব কেবলই খালেদার নয় তোমারও থাকা উচিত। অথচ, তোমার সে বিষয়ে কোনো জ্ঞানই নেই। যে নারী তোমার পাশবিক নির্যাতনে আহত হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেও তোমার সংসারকেই জীবনের নিরাপদ আশ্রয় মনে করছে। কী করে তুমি সেই নারীকে আঘাত করো? বিয়ের পর যে নারী তাঁর স্বামীর ঘরে নিরাপদ নয় সে নারী পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো জায়গায় নিরাপদ হতে পারেন না। খালেদা ঠিকই একজন আদর্শময়ী স্ত্রী এবং মমতাময়ী মা হতে পেরেছে। কিন্তু তুমি আজো আদর্শবান বাবা কিংবা যোগ্য স্বামী হয়ে ওঠতে পারোনি। এ তোমার জীবনের চরম ব্যর্থতা। মাথা নিচু করে কথা গুলো শুনে যান লতিফ সাহেব। কোনো প্রতিউত্তরের সাহস হয়নি আজ।
দু দিন পরের কথা। রাত এগারোটা বাজে। লাবিবা ওর ঘরে ঘুমাচ্ছে। বাইরে মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। লতিফ সাহেব খালেদা বেগমকে পাশে ডেকে বলে-
‘খালেদা, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। নূরু ভাই এর কথা গুলো আমি হজম করতে পারছি না। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।
খালেদা বেগম স্বামীর মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে শিহরিত কন্ঠে বলে ওঠেন-
‘এ তুমি কী বলছো লতিফ। ক্ষমা চাইতে হবে না। তুমি যদি তোমার ভুল গুলো শুধরে নিতে পারো তাহলেই আমি ধন্য হবো।
: আমি খুব গভীর ভাবে নূরু ভাইয়ের কথা গুলো চিন্তা করলাম। সত্যিই তো, কোনো নারী যদি স্বামীর ঘরে নিরাপদ না হয় তাহলে দ্বিতীয় কোথায় নিরাপদ হবার কথা নয়। দু টো ভাত আর কাপড় দিতে পারলেই স্বামী হওয়া যায় না। অকারণে তোমাকে অনেক নির্যাতন করেছি। কিন্তু তুমি কখনোই আমাকে, আমার সন্তানকে মোট কথা আমার সংসার ছেড়ে যেতে চাওনি। এই গুনাবলী কোনো সাধারণ মেয়ের হতে পারে না। তুমি সত্যিই একজন মহিয়সী নারী। প্রতিবেশী আর দশজন নারীর মতো তোমার জীবনাচার নয় সেটা গভীর ভাবে উপলব্ধি করলাম। আমি আর কখনো তোমার প্রতি নির্যাতন করবো না খালেদা। আমাকে অন্তত এবার একজন যোগ্য স্বামী হয়ে ওঠতে হবে। অতঃপর আদর্শবান বাবা।
স্বামীর মুখে এমন অপ্রত্যাশিত কথা গুলো শুনে খালেদা বেগমের চোখ জলে অশ্রুসিক্ত হয়। লতিফ সাহেবের ভেতর জাগ্রত হয় অনুশোচনা। খালেদা বেগম ফিরে পান তাঁর জীবনের কাক্সিক্ষত দাম্পত্য। হঠাৎ বজ্রধ্বনিতে আকাশ গর্জন দিয়ে ওঠে। খালেদা বেগম চমকে ওঠে লতিফ সাহেবের বুকে মাথা লুকায়। পরম মমতায় লতিফ সাহেব খালেদা বেগমকে জড়িয়ে ধরেন। দীর্ঘ দশ বছর পর এমন গভীর সান্নিধ্য খুঁজে পেয়ে ধন্য হোন খালেদা বেগম।