সীমন্তিনীর বিবৃতি





সীমন্তিনীর বিবৃতি
পুষ্পিতা দাস পিউ


দেখো!  দেখো!  সূর্যের আলো তোমার মুখে পড়েছে অন্ত !। আমি জানালায় দু’পাশ খুলে দিয়েছি। চারদিকে কেমন যেন মায়ায় আবছানি, তারই উপর তোমার মুখম-ল এর ঝলসানো মিষ্টি হাসি, এ যেন সোনায় সোহাগা আমার।
কী সুন্দর করেই না আত্মতৃপ্তির মৃদুস্বরে ডেকেছিল সীমান্ত, তবুও অন্তু চোখ খোলেনি সহজে।
উফ! সীমান্ত...! ডাকছো কেন আমায়? আমি ঘুমাবো বলে চেচাচ্ছিল অন্তু । সীমান্ত আহ্লাদ করে বলেছিল -ওঠো সোনা, বেলা গড়িয়ে এলো।
প্লিজ!  যাও তো সীমান্ত, শুধু শুধু বিরক্ত করোনা।
এবার সীমান্ত ভারী গলায় বলল, অন্তু সোনা; তুমি উঠবে না তো? আমি কিন্তু সত্যিই চলে যাবো, আর ডাকতে আসবো না কখনোই....।
অন্তু ঘুম চোখে বলে উঠলো.. এতো বড় স্পর্ধা তুমি কোথায় পেলে সীমান্ত? বলবে কি?
এসো এদিকে এসো...!
আসবো কেন বলো?  তুমি তো এখনো চোখ খোলোনি। আদরের সহিত সীমান্তকে ডেকে বলছে, আসোই না একবার, ধরো একটিবার আমার হাতখানা। সীমান্ত বললো, এসেছি সখা, এবার তোমার আঁখি খুলো। অন্তু হাতে হাতে ধরে বলল-
‘তুমি আমার প্রতিটি ভোরের আলোকিত সূর্য, আমি তোমাতেই সপিতে চাহি আমার দেহ। তোমাতেই চাহি বিসর্জনের অর্জন, তোমাতেই দেখিয়া শুরু যেন হয় আমার দিন, তোমাতেই যেনো আমি ডুবিয়া  মরি।’              
মা অন্তু, সকাল হয়ে গেলো যে, উঠ মা... তোর বাবা বাজার করে নিয়ে আসলো, আর তুই এখনো ঘুমে?? অন্তু বিরক্তিবোধ স্বরে বলে উঠলো, দিলে তো আমার সুন্দর স্বপ্নখানা ভেঙ্গে।

সকাল ১০ টা বেজে ঘড়িতে, ভোরবেলার স্বপ্ন নাকি সত্যি হয় মা? আমি তো কত স্বপ্নই দেখেছি ভোরবেলা, কই একটা ওতো পূরণ হয়নি!  বলে অন্তু চা’য়ের কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে দিলো...।
কিছুক্ষণ পর  অন্তুর মা বলে উঠলো- কি রে, এখনো বসেই আছিস, ভালো করে স্নান করে নে; ওনারা আজ আসবেন তো। অন্তু গলা চেঁচিয়ে দাঁতে দাঁত রেখে ওর ছোট বোনকে বলল, আমার জন্য একটা প্যারাসুট নারিকেল  তেলের বোতল নিয়ে আয়, আমি মাথায় তেল দিবো !
অন্তুর মা অন্তুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, মা এমন করিস না, তোর বাবার খুব পছন্দ হয়েছে ছেলেকে। ছেলে এমবিবিএস কমপ্লিট  করে এখন সার্জারি ডিপার্টমেন্টে আছে। অন্তু ওর মা’কে বুঝিয়ে বলল, মা এখুনি কেন? এসব কেন করছো তুমি? আমি একটা চাকুরী পেয়ে যাই, তারপর না হয়....! অন্তুর মা প্রতিউত্তরে বলে উঠলো, মেয়েদের তো বিয়ে একসময় দিতেই হয়, আর এখন তো পারফেক্ট সময়, সবসময় ভালো ছেলে পাওয়া যায় না। অন্তু দু’ফোটা চোখের জল গড়িয়ে বলল, যাচ্ছি মা। অন্তু ওর বাবার প্রতি এতটাই  দুর্বল ছিলো যে একটি কথাও বলতে পারেনি। অন্তু সীমান্তকে নিয়ে কতই না ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতো.. কিন্তু সীমান্ত....!
এতক্ষণে অন্তু স্নান করে ভিজা চুলে দর্পনের সম্মুখে এসে বসেছে, আর নিষ্পলক হয়ে তাকিয়ে আছে দর্পনের প্রতিচ্ছবিতে....!
তখন অন্তু কেমন যেন কল্পনায় ভাবালুক হয়ে বলেছিল, সীমান্ত! তুমি এসেছো?  হুম, অন্তু! এই যে, আমি তোমার পাশে.....।
অন্তু ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো, মিথ্যে বলো না, ছলনা করছো তুমি?
সীমান্ত অন্তুর ঠোঁটপৃষ্টে আঙ্গুল দিয়ে বলল, চুপ করো অন্তু!! শশশশশশ!  কি হয়েছে আমার অন্তু সোনার? চোখের নিচে এতো কালি যে, কেঁদেছো বুঝি? অন্তু ভারীকন্ঠে বলে উঠলো, হুম কেঁদেছি।
তাতে তোমার কিছু এসে যায় বলো? তুমিতো আমায় কবেই ছেড়ে চলে গিয়েছো। কেঁদো না অন্তু.....আমার যে আর কোন অনুভূতি নেই। বলে সীমান্তের অদৃশ্য দর্পীয়মান দেহ অস্পৃশ্য হয়ে গেল। তারপর অন্তু হুম বলে, ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো।
আজ কার্তিক মাসের শেষ দিন, সংক্রন্তি। আবার কার্তিক পূজার আয়োজন ও চলছে। সন্ধ্যা ৭ ঘটিকায় পূজা শুরু হবে, তারপর ওনাদের আগমন হবে।
আদরের সহিত অন্তুর বাবা বলে উঠলেন, মা অন্তু, আজ তুমি তুলসীর বেদিতে এই ঘি এর প্রদীপখানা জ্বালিয়ে দিয়ে প্রণাম করে আসো। তোমার জীবনে মঙ্গল বয়ে আসুক। অন্তু প্রদীপ জ্বালিয়ে দিলো।  ঐ দিকে ঠাকুর মশাই এসে গেলেন। আস্তে আস্তে পূজার মন্ত্রপাঠ শুরু হলো।
মা অন্তু, শাড়িখানা পড়ে নে, এবার ওনারা চলে আসবেন তো, তোর বাবাকে ফোন দিয়েছিল। অন্তু চোখ লাল করে বলে উঠলো, মা, আমি শাড়ি পড়বো না। পাশের রুম থেকে অন্তুর বাবা শুনে বলছে, এ কেমন কথা মা.. ওনারা আসবেন আর তুমি শাড়ি পড়বে না, এটা কেমন করে হয় মা। যাও পড়ে নাও, শাড়িই তো, ছোটবেলা একা একা কত সুন্দর করেই না শাড়ি পড়তে, বউ সাজতে।

অন্তুর চারদিক স্তদ্ধকার হয়ে আসছিল, লালের উপর কালো রঙের ডোরাকাটা সিল্কের শাড়িটি অন্তকে খুব মানিয়েছিল  সেদিন। চোখে কাজলের গাঢ় আর নাকে নথ, গোলাপি ঠোঁটে লালের আবছানি আর কপালে একখানা ছোট্ট কালো টিপ। অনেকক্ষণ ধরেই অন্তু খালি ঘরে চুপ করে বসেছিল। তারপর ওর বিবাহিত মেজদি অন্তুকে বললো, চল অন্তু! ওনারা তোকে ডাকছেন।
এবার যেতে হবে। আর শোন, যা জিজ্ঞেস করবে সুন্দর করে উত্তর দিবি বুঝলি।
পাশ থেকে অন্তুর মা বলে উঠলো, তোর বাবার মান সম্মান  এর ব্যাপার, বিন্দুমাত্র বিরক্তিবোধও যেন না দেখি আর তোর মধ্যে ওনাদের সামনে। তারপর অন্তু মাথা নেড়ে মেজদির সহিত হাটা শুরু করলো !
তারপর অন্তু একে একে সবাইকে প্রণাম করলো, শুরু হলো শ্বশুর মশাইয়ের একের পর এক প্রশ্ন। তুমি কি চাকুরী করবে? তোমার নামের অর্থ কি? তোমার উচ্চতা কত?
এক পর্যায়ে বলে উঠলো, তোমার বন্ধু তালিকায় কতজন বন্ধু?  অন্তু মনে মনে ভাবছে, এ কেমন প্রশ্ন?? শ্বাশুড়ির খুব পছন্দ হয়েছিল অন্তুকে। উনি অন্তুকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়েছিল।
মনে মনে এমন ভাব যেন আজই নিয়ে যাবে।
পরদিন সকালে শ্বশুড় মশাইয়ের ফোন, অন্তু বাবাকে বলল, অন্তুর নাম্বারটা দেন। অন্তুর বাবা খুশি হয়ে নাম্বার দিলেন, তারপর অন্তুকে শ্বশুর মশাই ফোন দিয়ে বলল, মা কেমন আছো তুমি? আমি তোমার...!

অন্তু মিথ্যে হাসিতে বলে উঠলো, নমস্কার!  ভালো আছি, আপনি? ওপাশ থেকে শ্বশুর মশাই বলে উঠলো, ভালো আছি মা, আচ্ছা তুমি দুপুর বেলা ঘুমাও? অন্তু আঁতকে উঠে বলে, না! মানে! হঠাৎ হঠাৎ ঘুমাই আবার নাও। শ্বশুর মশাই বললো, ও আচ্ছা! আজ তোমায় রাজদ্বীপ ফোন দিবে, নাম্বারটা লিখে রাখো, কেমন?

অনেকক্ষণ পর, কাক্সিক্ষত সেই ফোনের বেল বাজলো... ওপাশ থেকে কেউ একজন বলল, হ্যালো আমি রাজদ্বীপ! চিটাগাং থেকে বলছি, আপনি কি অন্তু??
সময়, পরিস্থিতি, ঋতু গুলো মানুষকে অবেলায় পরিবর্তন করতে বাধ্য করে অজানাতেই।
একজন নারী তার সমস্ত বেদনাকে অস্পৃশ্য করে দেয় বাস্তবতাকে বিচার করতে গিয়ে । তবুও সমাজ সীমন্তিনীদের নিয়ে কট্টাক্ক করে চলে দিনের পর দিন। আর তারা সহ্য করতে করতে নিজের ইচ্ছাগুলোকে দাফন করে ফেলে।
বছর খানেক পর, ঠিক বেলা দুপুর ২ টা বেজে ঘড়িতে। বাসার কলিং বেলটা বেজে উঠলো,
মা-অন্তু, দেখ তো! কে আসলো এই অসময়ে, বলে অন্তুর মা চলে গেলেন ।
দেখছি মা বলে, অন্তু দরজা খুললো। অদৃশ্য আবছা ঘেরা একখানা মুখ, বহু পরিচিত সেই মুখম-ল, যার চরিত্রের লোমহর্ষক ছোঁয়া দর্পনেও ঝলঝল করতো।
অন্তু মাথা বাড়িয়ে বলল, কে?
তখন পিছন পাশ মোড়ে বলল, অন্তু! আমি সীমান্ত ! চিনতে পেরেছো?
খানিকক্ষণ পর, অন্তু শাড়ির পাড় দিয়ে চশমার ভেজা গ্লাসগুলো মুছে। তারপর চোখে সযতœ করে চশমাখানা দৃষ্টিগোচর করে বলল, কে আপনি?
আমি চিনতে পারছি না যে!
কোথাও ভুল হচ্ছে মনে হয়। আপনি এবার আসতে পারেন।


 

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট