কবিতার কবিতা
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
সারাদিন কবিতা কবিতার বইয়ের মধ্যে বুদ হয়ে থাকে। কি একটা অন্যধরণের আনন্দ সে কবিতার মধ্যে পায়। কবিতা পড়তে পড়তে ঘুমে চোখ বুজে আসে তার পরও চোখের পাতাকে ধরে রাখার চেষ্টা। আজকের দিনটা আর দশটা দিনের মতো কবিতার মনে হচ্ছেনা, কেমন যেন একটা মন হারানোর দিন মনে হচ্ছে। বাইরে ঘন্টার পর ঘন্টা রিমঝিম করে বৃষ্টি পড়ছে। টিনের চালে বৃষ্টিটা যখন একসাথে পেয়েছে তখন তার শব্দে মনটা আরও হালকা বাতাসার মতো হয়ে যাচ্ছে। বাইরে হালকা বাতাস। গাছের পাতাগুলো যেন নুপুর পড়ে হেলেদুলে বৃষ্টির গানে প্রাণ জুড়িয়ে নাচছে। সেই ছন্দময় দোলায় কবিতার খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বাতাসে উড়ছে। কবিতার বইটা হাতে নিয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সে খুব জোরে জোরে কবিতা পড়ছে। কেমন যেন একটা জেদ ভিতরে ভিতর কাজ করছে। বৃষ্টির শব্দকে সে হার মানাবে। পাশের ঘর থেকে মা ডাকেন "কবিতা, এদিকে একটু আয় তো মা।" খুব রাগ হয় কবিতার। খুব কষ্টের একটা কবিতা পড়ছিলো সে। চোখ থেকে তখনও টপ টপ করে বৃষ্টির মতো পানি পড়ছে। আর কষ্টটা যেন বৃষ্টির মেঘ হয়ে গেছে। কবিতার কোনো সারা শব্দ না পেয়ে মেয়ের কাছে মায়েই চলে আসেন। চোখ গড়িয়ে গাল বেয়ে কান্নার পানি দেখে মা বলেন, "পাগলী মেয়ে আমার, তুই কি বড় হবিনা"। কিন্তু মায়ের মনও ভিতরে ভিতর কাঁদে। মেয়েটার জন্য খুব কষ্ট হয়। আহা, কচি পাতার মতো মেয়েটার জীবনে কত বড় ঘটনা ঘটে গেছে। মা সব জানেন, বুঝেন কিন্তু তারপরও পাথরের মতো মনকে শক্ত করে ধরে রাখেন। মেয়েটা ছাড়া তার জীবনে তো আর কিছুই নেই। মা কবিতাকে নিয়ে বারান্দায় আসেন। খুব বড় লম্বা চুল। খুব আদর করে মা চুলগুলোকে এক জায়গায় এনে খোঁপা করে দেন। কবিতার এদিকটায় যেন কোনো খেয়াল নেই "একটার পর একটা কবিতা পরেই চলেছে।" বৃষ্টিটা থেমে যায়। নীরবতা নেমে আসে চারিদিকে। কবিতা চিৎকার করে মাকে ডাকে, "মা, মাগো দেখে যাও কত সুন্দর রংধনু আকাশে উঠেছে।" মায়ের মনও মেয়ের আনন্দে হেসে উঠে। একটা মৃদু আশা মায়ের মনে দোল খেয়ে যায়, "আহা রংধনুর মতো মেয়েটার জীবনটাও যদি আবার রঙে ভোরে যেত।"
সন্ধ্যা হলেই কবিতা মাকে খুব বিচলিত হতে দেখে। অস্থির হয়ে এপাশ থেকে ওপাশে মা পায়চারি করেন। এরপর প্রতিদিন ঠিক সন্ধ্যা ৭ টায় মোবাইলের রিং বেজে উঠে। ফিসফাস করে মা কার সাথে যেন দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। দরজাটাও বন্ধ থাকে। আগে ফোনের কথাগুলো শুনবার জন্য কবিতা দরজায় কান লাগিয়ে থাকতো। এখন কেমন গা সোয়া হয়ে গেছে। ভাল্লাগেনা, আড়ি পেতে শুনার আগ্রহটাও হারিয়ে ফেলেছে সে।একদিন কবিতাদের বাড়িতে একজন বিদেশি লোক আসেন। ধপধপে ফর্সা গায়ের রং। কবিতা অবাক হয় লোকটাকে দেখে। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারে লোকটা। এই প্রথম কাউকে কবিতা তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতে দেখলো। এর আগে কেউ তো কোনোদিন কবিতাদের বাসায় আসেনি। পাড়াপড়শিরাও কবিতাদের এড়িয়ে চলে। কবিতার মা লোকটাকে ঘরে নিয়ে যায়। লোকটার কান্না শুনতে পায় কবিতা। লোকটা ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, তোমার মেয়েটার কি হবে। খুব কষ্ট হয় ওর জন্য। এখন তো সে অনেক বড় হয়েছে ওকে আমার দেশে নিয়ে যাই। কবিতার মা কিছু বলেননা। শুধু লোকটার কথা শুনে যান। এসব দেখে শুনে কবিতা আর কিছুই ভাল্লাগেনা। এমন সময় কবিতাদের বাইরের দরজা থেকে করা নাড়ার শব্দ আসে। দৌড়ে কবিতা দরজাটা খুলে দেয়। রাজপুত্রের মতো একটা ছেলে কবিতার সামনে দাঁড়িয়ে। কবির কবিতার রূপকথার রাজপুত্রের সাথে হুবহু চেহারার মিল। কবিতা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে কাকে চান। ছেলেটা বলে কবিতাকে। কবিতা অবাক হয়। যার সাথে তার কোনোদিন দেখা হয়নি, কথা হয়নি সে নাকি চায় কবিতাকে। কবিতা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে কেন কি দরকার তাকে। ছেলেটা বলে খুব দুঃখী মেয়ে কবিতা। তার জীবনে যা ঘটেছে তা আর অন্য কোনো মেয়ের জীবনে ঘটেনি। তার অতীত নিয়ে, তার বর্তমান আর ভবিষ্যত নিয়ে আমি গবেষণা করে একটা বই লিখতে চাই। কবিতার মাথা আর চোখগুলো যেন ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়। সে এতো দুঃখী, তার জীবনে অনেক কিছু নাকি ঘটেছে আর সে কিছুই জানেনা। লোকটাকে ধরে পিটাতে ইচ্ছা করে কবিতার। কবিতাদের কথাবার্তা শুনে কবিতার মা ও লোকটা বেরিয়ে আসে। মা কবিতাকে কাছে ডাকেন। এরপর ছেলেটা ভিতরে ঢুকতে বলেন। বাইরে লোকজনের হৈ হুল্লোড় শুনতে পায় কবিতা। মনে হচ্ছে তাদের বাড়ির বাইরেই লোকজন হট্টগোল করছে। লোকজন চিৎকার করে বলছে অনেক সহ্য করেছি আমরা। আর নয়। কবিতার জীবনটা কেন এমন হলো আমাদের জবাব দিন, কেন মেয়েটার জীবনে এমন ঘটনা ঘটলো যা আগে কেউ কখনো ভাবেনি। এরাই মনে হয় পাড়া পড়শি। এবার হুড়মুড় করে লোকগুলো কবিতাদের বাড়ির ভিতরে চলে আসে। কবিতার মা আর লোকটাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। কবিতা এতো মানুষ দেখে ভয়ে ঘরের ভিতরে চলে যায়। ভাবে আর ভাবে। কবিতার পাতাগুলো উল্টে পাল্টে দেখে কিন্তু কিছুই ভালো লাগেনা। সে কিছুই জানেনা আর তাকে নিয়ে এত্তোসব। কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা সে। বিদেশি লোকটা কবিতা, কবিতার মা আর ছেলেটাকে নিয়ে পিছনে দরজা দিয়ে বের হয়ে আসে। একটা দামি সাদা রঙের জীপ গাড়িতে করে রওনা হয় সবাই। কবিতা কিছুতেই কিছু মিলাতে পারেনা। গাড়িটা ফার্মগেটে হয়ে গুলশানের দিকে এগিয়ে যায়। একটা রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। গাড়িটার হর্ন শুনে একটা বৃদ্ধা মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে আসে। বুক চাপড়িয়ে আহাজারি করতে থাকে দুনিয়ার এতো মানুষ থাকতে আমার কবিতা জীবনটা কেন এমন হয়ে গেলো। কবিতা শুধু অবাক আর অবাক হয়। যাদের সে চিনেনা, জানেনা তারা কিনা তাকে নিয়ে কি সব কথাবার্তা বলছে। বাড়িতে ঢুকতেই চমকে উঠে কবিতা। এ কি দেখছে কবিতা? কবিতার সামনে কবিতা। মাথাটা ঘুরে উঠে কবিতার কিন্তু নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে। মা নতুন কবিতাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। কবিতার খুব হিংসে হয়। নতুন কবিতাও কবিতাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আর আর্তনাদ করে বলতে থাকে কেন তোমার জীবনটা কবিতা এমন হয়ে গেলো যা অন্য কারো জীবনে কখনো ঘটেনি। কবিতা ভাবে আর ভাবে কিন্তু কোনো কুল কিনারা পায়না। তার মতোই অবিকল দেখতে আরেকজন। অদল বদল করলেও কেউ বুঝতে পারবেনা। কবিতা মাকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছিল তার জীবনে। মা কিছুই বলেন না শুধু অচল দিয়ে চোখ মুছেন। অচেনা লোকগুলো সম্বন্ধে জানতে চায় কবিতা। মা অনেকটা ধমকের স্বরে বলে উঠেন, এটা তোমার জানার প্রয়োজন নেই। আরও বড় হও, জীবনকে আগে বুঝতে শেখো, তোমার উত্তরগুলো তুমি পেয়ে যাবে। কবিতার সবকিছুই কেমন যেন সন্দেহ লাগে। তার কবিতার বইটাও সে আনতে পারেনি। কবিতা মার কাছে আবদার নিয়ে বলে, মা, মাগো, ওগো মা কবিতার কয়েকটা বই চলো মার্কেট থেকে কিনে নিয়ে আসি। মা ও কবিতার মতো দেখতে দেখতে মেয়েটার সাথে বেরিয়ে পড়ে নীলক্ষেতের বইয়ের মার্কেটে। একটা কবিতার বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। মা বলেন এটা আমাদের নিজেদের দোকান। কোন কোন বই নিবে বলো। দোকানের বইগুলো পিছন দিক হয়ে একটা মেয়ে পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখছে। কবিতাদের দিকে তাকানোর যেন সময় নেই। এবার কবিতার অপেক্ষার বাঁধ ভেঙে যায়। একটু উঁচু গলায় বলে উঠে, এই মেয়ে আমাদের কবিতার বইগুলো দেখাও না। দোকানের মেয়েটা এবার গলা ঘুরিয়ে কবিতাদের দিকে তাকায়। কবিতা অবাক হয়ে যায়। পা থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে কবিতার। আবার সে দেখছে কবিতার সামনে কবিতা। একজন পাশে, আরেকজন সামনে। কবিতা মায়ের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে কেননা সে জানে এর উত্তর মা দিবেন না। অনেকগুলো সুখের আর আনন্দের কবিতার বই নিয়ে মেয়েটা কবিতাটা দেখতে দেখতে বলে, কবিতা কেন তোমার জীবনটা এমন হয়ে গেলো যা অন্য কারো জীবনে কখনো ঘটেনি। চোখ মুছতে মুছতে মেয়েটা বলতে থাকে আর কষ্টের কবিতা পড়োনা। জীবনে অনেক কষ্ট তোমার এখন আনন্দ, সৃষ্টি আর প্রেমের কবিতা পড়ো। কবিতা খুব অবাক আর শংকিত হয়; সে জানেনা তার জীবনে কি ঘটেছে আর অন্যেরা সব জানে। অবাক আর অবাক হয়। তার মতো দেখতে অনেকগুলো মেয়ে কে তারা, তাদের সাথে কি তার কোনো সম্পর্ক আছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। সাগরের ¯্রােতের মতো ধাক্কা খায় আর তলিয়ে যায় ভাবনা থেকে ভাবনায়।
অনেক অজানা প্রশ্ন আর কৌতূহল নিয়ে আবার গুলশানের ঐ বাসায় ফিরে আসে কবিতা। বইগুলো হাতে নিয়ে চিৎকার করে করে কবিতা পড়তে থাকে। মনে হচ্ছে আজ যেন আকাশ বাতাস তোলপাড় হয়ে যাবে। মেজাজটাও বিগড়ে উঠে কবিতার। তার মাথায় ঘুরপাক খায় তার মতোই তিন জন কবিতা। ওরা কারা? কেন তারা তার মতোই দেখতে? তার জীবনের সবকিছ তারা কিভাবে জানে? এলোমেলো হয়ে পড়ে কবিতা। রাত আসে। তিন কবিতায় এক বিছানায়। চোখে ঘুম আসেনা কবিতার কিন্তু ওরা গভীর ঘুমে। একসময় ভূমিকম্পের মতো নড়ে উঠে দালানটা। সব কিছু যেন ভেঙে পড়ছে। মানুষের হৈ চৈ। বাঁচাও বাঁচাও আওয়াজ। তারপর গভীর নিস্তব্ধতা। কবিতা খুব আসতে আসতে চোখ খুলে। মনে হয় অনেকদিন পরের চোখ খোলা। তীব্র আলোটা চোখে যেন আঘাত করছে। কবিতার চারপাশে এপ্রোন পড়া বুড়ো বুড়ো ডাক্তাররা। ফিস ফিস করে ওরা বলছে ২ মাস পর কোমা থেকে ফিরে এসেছে মেয়েটা। মিরাকেল। ওর তো বাঁচার কথা ছিলোনা। ডাক্তাররাও ফিস ফিস করে বলছে, খুব কষ্ট করেছে মেয়েটা জীবনের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে উঠেছে কিন্তু হারিয়েছেও অনেক কিছু। বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনে কবিতা। এপাশ ওপাশ তাকাতেই দেখে দুটো একই চেহেরার বাচ্চা। তার মতোই হয়েছে তারা। একজন খুব বুড়ো কপালে ভাঁজ পড়া ডাক্তার কবিতার সামনে এসে বলে. মা, মাগো তোমার দুটো যমজ সন্তান। দেখতে ঠিক তোমার মতোই হয়েছে। মাগো একটু মনে করার চেষ্টা করো সেদিনের ভূমিকম্পের কথা, তোমার পিছনে ফেলে আসা জীবন।
এবার কবিতার সব কিছুই ধীরে ধীরে মনে পড়তে থাকে। কবিতার বাবা ছিলেন একজন বিদেশি। এদেশে চাকরি করতে এসে ভালোবেসে বিয়ে করে তার মাকে। খুব আনন্দের জীবন ছিল বাবা মায়ের। মায়ের গর্ভে কবিতা আসে। কবিতা তার মায়ের কাছে শুনেছিলো কবিতার জন্য কবিতার বাবা পৃথিবীর সব খেলনা যেন এনে বাড়ি ভর্ত্তি করে দিয়েছিলো। কবিতা তখন মায়ের গর্ভে। এরপর কবিতার পৃথিবীতে আসার সময় হয়। ১০ তোলার একটা অপারেশন থিয়েটারে কবিতা যখন ঠিক জন্ম নিচ্ছে। কবিতার বাবা হাসপাতালের নিচ্ছে লিফটের দশ তোলার বাটন চাপ দিয়ে উপরে উঠে আসছে। ঠিক দশ তলায় লিফটের ভিতরের দরজা খোলার অপেক্ষা আর কবিতার পৃথিবীতে আসার কান্না। হঠাৎ করেই লিফটে ভেঙে পড়লো। রক্তাত্ব নিথর দেহ হয়ে গেলো কবিতার বাবা। অতৃপ্ত আত্মারা পাখি হয়ে উড়ে গেলো হয়তো আকাশে। কবিতার জন্মই যেন হয়ে গেলো আজন্ম পাপ। সবাই বলতো সর্বনাশী, ওর বাপ টাকে খেলো। মায়ের আদরে বড় হতে থাকে কবিতা। প্রেম হয় একজন কবির সাথে। এরপর বিয়ে। ভাগ্যটা বুঝি খারাপই কবিতার। হঠাৎ করে কবিতার শশুরের বুকের বা পাশটায় ব্যথা উঠে, প্রচন্ড থেকে প্রচন্ড হয়। বিয়ের "কবুল" বলার সাথে সাথেই হার্ট স্ট্রোক করে বিয়ের দিনেই শশুরের মৃত্যু হয়। কবিতার শাশুড়ি কবিতাকে অলক্ষুনি মেয়ে বলে অপবাদ দিতে দিতে আহাজারি করতে থাকে। কবিতার মায়ের মন ভয়ে আর আতংকে চুপসে যায়। প্রেসারটা হঠাৎ করেই দুশ্চিন্তায় বেড়ে যায়। বিয়ে বাড়িতেই কবিতার মা ব্রেন স্ট্রোক করে মারা যান। এরপর প্রতিদিন শাশুড়ির অভিশাপ আর বঞ্চনা নিয়ে সংসারকে সাজানোর চেষ্টা করে কবিতা। কবিতার স্বামী কবি। সবার থেকে আলাদা। সে এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করেনা। খুব ভালোবাসে কবিতাকে হয়তো প্রাণের চেয়েও বেশি। কবিতাকে দেখে দেখে একটার পর একটা কবিতা লিখে যায়। আর জোরে জোরে কবিতাকে শোনাতে থাকে। কবিতাকে নিয়েই যেন কবি স্বামীর গবেষণা আর অনুপ্রেরণা। স্বামী ভালো হলে শাশুড়ির অবহেলা আর অবজ্ঞা একটা মেয়ে জন্য কিছুনা। সন্তান সম্ভবা হয় কবিতা। স্বামীর আনন্দ আর ধরেনা। কবি স্বামীর মনে হয় নতুন ঝকঝকে কবিতার মতো নতুন জীবন সৃষ্টি করতে যাচ্ছে সে। সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে। সময় গড়ায় কবিতা আর কবিতার স্বামীর চোখে মুখে আনন্দরা দোল খায়। পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে কবিতার আড্ডা জমায় কবি। আর খুব জোরে হাসতে হাসতে সবাইকে বলে, আমার সন্তানের জন্য সবাই দোআ করবেন। অনেক অনেক ধরণের মিষ্টি খাওয়াবো আপনাদের। কাল পরশু সন্তান ডেলিভারি হবার সময় দিয়েছে ডাক্তার। সময় যেন ফুরায় না। আনন্দের সময়টা আসতে যেন দেরি করে ফেলে। রাতে ঘুমাতে যায় কবিতা আর কবিতার স্বামী। হৈ হুল্লোড় আর চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। খুব জোরে নড়ে উঠছে দালানটা। হয়তো ভেঙে পড়েছে। কবিতা আর কিছুই জানেনা।
কবিতা আর্তনাদ করে কেঁদে উঠে। বুড়ো ডাক্তারটা কবিতার মাথায় হাত দেয়। ডাক্তারের চোখেও পানি। সান্তনা দিতে গিয়ে কষ্ট হয় ডাক্তারের। তারপরও দেয়। মাগো, এই পৃথিবীটা একটা কঠিন জায়গা। বাস্তবতা আরো কঠিন। ঐ দিন যে ভূমিকম্প হয় তাতে তোমার স্বামী ও শাশুড়ি মারা যান। তাদের লাশগুলো এখন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তোমাদের এলাকার একটা লোকও বেঁচে নেই। শুধু ধ্বংস স্তুপের নিচে তোমাকে খুঁজে পাওয়া যায়। ধুক ধুক করে তোমার হৃদস্পন্দন তখন চলছিল। আজ দুইমাস কমায় থাকার পর তুমি ফিরে এসেছো। তোমার দুটো যমজ কন্যা সন্তান হয়েছে ঠিক তোমার মতোই দেখতে। কবিতা কাঁদতে গিয়েও কাঁদতে পারেনা, চাপা কান্নারা হয়তো বের হতে পারেনা।
এবার কবিতা তার জীবন মরণের সন্ধিক্ষণের আরেক জীবনকে মেলাতে শুরু করে। যে দুটো কবিতা সে দেখেছে, ঠিক তার মতো। তারা তার দুটো যমজ সন্তান। বিদেশি লোকটা তার লিফটের ভেঙে পড়া মৃত বাবা। তার স্বামী তো টাকে নিয়ে গবেষণা করতো। কবিতা লিখতো। যে লোকটা রাজপুত্রের মতো তাদের বাসায় এসেছিলো সে তার স্বামী। তার লেখা ভালোবাসার কবিতা গুলো কবিতার হয়ে গিয়েছিলো কষ্টের কবিতার বই। গুলশানের বাড়িতে যে বুড়িটা আহাজারি করেছিল সেটা তার শাশুড়ি। স্ট্রোক করে মারা গিয়েছিলো তার মা আর শশুর। পাড়াপড়শি যারা কবিতাকে নিয়ে হৈ চৈ করছিলো তারাতো আজ সবাই মৃত।
মেয়ে দুটো হঠাৎ করেই একসাথে কেঁদে উঠে। কবিতাটাও কেঁদে উঠে। এখনো হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে সে। দুটো ছোট ছোট কবিতা ছাড়া তার জীবনে আর কেউই নেই। ভাবতেই থাকে কবিতা। হয়তো একসময় ভাবতে ভাবতে কবিতার জীবনের কবিতাগুলো কোথায় ভেসে যাবে কেউ জানেনা। হয়তো জানবেনা কোনোদিন। তবুও কবিতা স্বপ্ন দেখে তার কবিতাদের নিয়ে। হয়তো সব হারিয়ে মৃতের মতো বেঁচে থাকতে হবে ওদের জন্য।