আমাকে নিয়ে ঘর বেঁধো না
হাসনাত আসিফ কুশল
রামপুরায় ছোট একটি ভাড়া বাসায় থাকে সৃজন, শুপন দুই ভাইবোন। তারা প্রায়শই ভালো ফ্ল্যাটে থাকতে চায়। নিজের পছন্দের গাড়িতে ঘুরতে চায়। দুই ভাইবোনের মধ্যে সৃজন বড় ভাই আর শুপন ছোটো বোন। মূলত ভাইবোনের মধ্যে চিরন্তনভাবে সখ্যতা গড়ে উঠলেও তাদের মধ্যে সদ্ভাব-সম্প্রতি ছিলো না। দুজনই দুজনকে খোঁচাতে থাকে আর তাই প্রতি রাতে দুজনই আলাদা ঘরে শোয়।
শুপন মাঝে মধ্যে বাসার বাইরে রাত পর্যন্ত কাটিয়ে দিতো বন্ধুদের সাথে। কখনো আড্ডাবাজি, কখনো নাইটক্লাব। আড্ডাবাজির জন্য মাঝেমধ্যেই যায় হাতিরঝিলে। সৃজন একটি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ছাত্র। চমৎকার লিড লেখে। যেকোনো ঘটনার বিবরণও চমৎকার তার। সিজিপিএ তাই আউটস্ট্যান্ডিং। বন্ধুদের সাথে ততটা যুক্ত না সে। পড়াশুনার পাশাপাশি সে কয়েকটি অনলাইন পত্রিকার সাথেও যুক্ত। কোনো বিশেষ নিউজ সে করলেই সেটা দ্রুত ছড়ানোর জন্য নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে শেয়ার করে দেয়।
সৃজনের একজন ভালো বন্ধু ছিলো। তার সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটাতো। বাসায় এসেও মোবাইলে কিছুক্ষণ পর পর কথা বলতো। মূলত ছেলেরা অবচেতনভাবে মেয়েদের প্রতি দূর্বল। সৃজনের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু ঘটে নি। সে সবসময় নোরার প্রতি অনুরক্ত । নোরা অবশ্য তার চেয়ে দুই বছরের ছোট ।
বেশ কয়েকদিন আগে নোরার সাথে সৃজন পাঠক সমাবেশে গেছিলো । একসাথে ঘুরতে গেলে নোরার ভালোই লাগে । তবে বেশিরভাগ সময় নোরাই বলে কোথাও ঘুরতে যেতে । সৃজনের এসব ভালো লাগে না । সৃজন ঘরকুনো প্রকৃতির মানুষ। সুতরাং সে এসব বুঝতে চায় না ।
নোরা ও সৃজন যখন পাঠক সমাবেশে যাবে তখন নোরার ছোটভাই ফোন করে বলেছিলো কয়েকটি বই কেনার কথা। সে খুব বই পড়ে। অনলাইনে প্রায়ই লেখে। এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে।
যেদিন তারা পাঠক সমাবেশে গেছিলো, সেদিন সৃজনের ঘুম ভাঙতেই চাইছিলো না। তখন ফোন করল নোরা। সৃজন অবশ্য বিরক্ত হয়। নোরাও ছেলেমানুষ। সে কোনোকিছু চাইলে তা দিতেই হবে। তাই সে বায়না করেই চলেছিলো। এক পর্যায়ে সৃজন যেতে রাজি হয়েছিলো।
নোরা: হ্যালো।
সৃজন: (কোনো কথা নেই)
নোরা: এই যে। এখনো ঘুমায় মানুষ ?
সৃজন: হুম।
নোরা: বহুদিন একসাথে কোথাও যাই নি। আজ একসাথে যাই ?
সৃজন: কোথায় যাবে ?
নোরা: শাহবাগে। টিএসসির মোড়ে। চলো না প্লিজ।
সৃজন: নাহ। আজ আর যেতে ইচ্ছা করছে না। আরেকটু ঘুমাই ?
নোরা: তোমার ঘুমের কিছু করি। তাড়াতাড়ি ওঠো। আমি যা বলছি তাই করতে হবে।
সৃজন: আজ ইচ্ছা করছে না।
নোরা: বুঝেছি। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। এই বেয়াদব ছেলে, ওঠো। আজ আমরা ঘুরতে যাবো।
সৃজন: আজ না। আরেকদিন।
নোরা: তোমার কোনো কথাই শুনবো না। আজকে মানে আজকেই....
...এই হচ্ছে নোরা। সবকিছু তার সাথে সাথেই চাই। সুতরাং সেদিন সৃজনকে ঘুম থেকে উঠে আধা ঘণ্টার মধ্যে তার মটর বাইকে করে টিএসসির মোড়ে যেতে হয়েছিলো। মানিব্যাগে নিয়েছিলো দেড় হাজার টাকা। সারা দিন ঘোরাঘুরিতে সব শেষ।
তাদের দেখা হয়েছিলো সেদিন বুয়েট কলেজের সামনে। টিএসসির মোড়ে খুজে খুঁজে কোথাও পেল না নোরাকে। কোথায় গেল। ও তো এখানেই দাঁড়াবে বলেছিলো। আধা ঘণ্টা খোঁজাখুজি করলো সৃজন । ফোন করলে জানা গেল সে বুয়েট কলেজের সামনে আছে।
তখন কিছু তো বলা যায় না । মটর বাইকে দ্রুতবেগে গেল বুয়েট কলেজের দিকে । ততক্ষণে নোরা বুয়েটের কাছে । ওর এক বন্ধু এসেছে বিদেশ থেকে । বন্ধুর নাম চঞ্চল ।
এদিকে বুয়েট কলেজের সামনে গিয়ে সৃজন ফোন করলো নোরাকে । নোরা ফোন ধরলো না ।
চঞ্চলের সাথে অনেক গল্প হলো আজ ।
চঞ্চল: আচ্ছা তোমার আইইএলটিএস এর কি হলো ? বাবা তো বলছিলো সামনে মাসে বিয়ে করার জন্য ।
নোরা: উম, এখনই বিয়ে ? নাহ দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে । আমি আগে গ্রাজুয়েশন শেষ করে নেই ।
চঞ্চল: আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয় ? এখন বিয়ে করে নাও । বিয়ের পর পড়াশুনা করা যাবে না হয় ।
নোরা: আমি তাতে সম্মত নই ।
হঠাৎ খেয়াল ব্যাগের ফোন বাজছে অনেকক্ষণ ধরে । নোরা চঞ্চলকে থামিয়ে বললো, এক মিনিট ।
‘কতক্ষণ ধরে ফোন করছি । ফোন ধরো না কেন ?’
‘ওহ সরি, সরি। এ্যই শোনো, একটু বুয়েটের সামনে আসো ।’
‘আচ্ছা’
বিরক্ত হয়ে আবার মটর বাইকে স্টার্ট দেয় সে । বুয়েটে সামনে এসে নোরাকে পেল সে ।
নোরা: ওহ । সৃজন, (সৃজনের দিকে তাকিয়ে) ও হচ্ছে চঞ্চল । আমার বাবার বন্ধুর ছেলে । (চঞ্চলের দিকে তাকিয়ে) চঞ্চল, ও
হচ্ছে সৃজন । আমরা খুব ভালো বন্ধু ।
চঞ্চল: (সৃজনের দিকে তাকিয়ে) নাইস টু মিট ইউ ।
চঞ্চল ও সৃজন দুই জন হ্যান্ডশেক করলো । এরপর তিন জন মিলে ঘুরতে বের হলো । হাঁটতে হাঁটতেই গেল । সৃজন তার মটর
বাইক পরিচিত এক বড় ভাইয়ের কাছে রেখে গেল ।
নোরা: সৃজন কিন্তু খুব অলস । ওকে আজ সকালে ফোন করেছি এখানে আসার জন্য । ও আসবেই না । আমি জোর করে এখানে
নিয়ে এসেছি ।
সৃজন: সেই সাথে অনেক ঘুরেছি । তোমার দঁড়ানোর কথা ছিলো টিএসসির মোড়ে । তুমি একবার বুয়েট কলেজের সামনে যাও,
একবার বুয়েট ক্যাম্পাসে চলে আসো ।
নোরা একটু হাসলো । চঞ্চলও হাসছে । হাঁটতে হাঁটতে পাঠক সমাবেশ পর্যন্ত এসে নোরা বলল, আচ্ছা আমার কয়েকটা বই কেনা লাগবে । চঞ্চল একটু না করছিলো তবে সৃজন উৎসাহ দিলো । বললো, চলো তাহলে।
চঞ্চলকেও তাই যেতে হলো । বই নেওয়ার ট্রেতে করে কয়েকটি বই নিয়ে আসলো নোরা। তারপর যখন পে করার কথা বললো সেলসম্যান তখন নোরা পার্সব্যাগে দেখলো পাঁচশো টাকার নোটটি নেই । তাড়াহুড়া করে বাসায় ফেলে এসেছে ।
নোরা তাই সৃজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কাছে পাঁচশো টাকা আছে ? আমি ভুল করে বাসায় পাঁচশো টাকার নোট ফেলে এসেছি । আমি পরে তোমাকে ফেরত দিয়ে দেবো ।
সৃজন বললো, ওহ শিউর । (মানিব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে দিয়ে দিলো)
নোরা বললো, থ্যাংকস ।
আরেক দিনের কথা নোরা আর সৃজন সেদিন একসাথে বেরিয়েছে । নোরা বললো, জানো, আমি তোমার মধ্যে আমার ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি । আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি ।
সৃজন বললো, রিয়েলি ?
নোরা বললো, হানড্রেড পারসেন্ট সত্যি । আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি ।
সৃজন পাত্তা দিলো না । বললো, চলো সামনের দোকানে যাই ।
দোকানে যাওয়ার পর দুজন অনেক কথা বললো ।
সৃজন: তোমার ছোটভাই পড়াশুনায় কেমন ?
নোরা: একদম ভালো না । সারা দিন অনলাইনে হাবিজাবি লেখে ।
সৃজন: (হেসে) লেখালেখিও তো পড়াশুনা । পড়াশুনা না করলে কি লেখালেখি করা যায় ?
এই নিয়ে দুজনের মধ্যে তর্ক হয়ে গেল । একজন বলে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার কথা, আর একজন বলে অপ্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার
কথা। খাওয়া দাওয়া মাথায় উঠলো ।
তিন দিন তাদের কোনো কথা হলো না । দুজনই দুজনের উপর রেগে আছে । ফেসবুকে যোগাযোগের কোনো সম্ভাবনা নেই । কেউ কারও পোস্টে লাইক পর্যন্ত দেয় না । সৃজন ফেসবুকে পোস্ট দিলো, অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন এদেশে অনুভূত হয় না । মানুষ শুধু পাঠ্যবইকেই প্রাধান্য দেয় । হ্যা পাঠ্যবইয়ের প্রয়োজন আছে কারণ তা আমাদের জীবিকার খোরাক যোগাবে। তবে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষারও প্রয়োজন আছে । কেননা অপ্রাতিষ্ঠানিক গ্রন্থাগার একটি প্রতিষ্ঠান । জীবিকার তাগিদে বিদ্যালয়ের প্রয়োজন থাকলে অবচেতন মনের উনড়বতির জন্য গ্রন্থাগারের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি ।
সেখানে একজন মন্তব্য করলো, বেশ খাসা বলেছেন ভাই । তবে এরকম চিন্তা আর কেউ করে না ।
আরেক জন লিখেছে, একমত ।
আরেক জন লিখেছে, না ভাই । একমত হতে পারলাম না ।....
অনেকেই লিখেছে । সৃজনের ধৈর্য নাই এত মন্তব্যের উত্তর দেওয়ার । এমনিতেই মেজাজ খারাপ । আবার একেকজন একেক রকম পা-িত্য দেখাচ্ছে ।
নোরা লাইক না দিলেও পোস্টটি হয়ত দেখেছে । সেকারণে সেও আবার একটি পোস্ট দিয়েছে । ......অনেকেই আছেন যারা গ্রন্থাগার
প্রতিষ্ঠার কথা বলেন তারা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায় কতটুকু এগিয়ে এসেছেন জানতে ইচ্ছা হয় ।
এই পোস্টটি সৃজনের চোখ এড়িয়ে গেছে । সৃজনের আর ভালো লাগে না ।
নোরা চঞ্চলের প্রতি দূর্বল হয়ে উঠছে। বাবার বন্ধুর ছেলে বলে কথা। নিউইয়র্কে নামকরা একটি বিউটি পাল্লারে কাজ চঞ্চল। চঞ্চলের বাবা কোনো একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক। সেই খুশী নোরার মা-বাবা কোথায় রাখবেন ভেবে কুল পাচ্ছেন না ।
বারবার মেয়েকে ভাগ্যবতী বলে সম্বোধন করছেন । তবে মনে মনে সে সৃজনকে ভালোবাসে । কিন্তু বলতে পারে না। কি করবে ?
একটু যদি সৃজনকে পাওয়া যেত! তবে এই কথাটি বলা যেত ।
এদিকে সৃজন নোরার সাথে কথা হচ্ছে না দেখে হতাশ, তখন তার এক বন্ধু তাকে বিভিনড়ব ওয়াজে নিয়ে যেতে থাকে । টিভিতে জাকির নায়েকের লেকচার হয় । প্রতিদিন শুনতে পরামর্শ দেয় সৃজনকে । ফেসবুকে তারা অ্যাড হয় । ইউটিউবের অনেক লিংক এবং বিভিনড়ব
ইসলামী ব্লগের লিংক তাকে দিতে থাকে । নিয়মিত নামাজ ধরা দেখে অবশ্য তার পরিবারের কেউ না করে নি । কারণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে শুরু করলে কে না খুশী হয় । কিন্তু আড়ালে আড়ালে যে নষ্টের উপাখ্যান রচনার প্রচেষ্টা চলছে তা তো আর কেউ জানে না ।
তো যাই হোক, নোরাও জানে না সৃজনের এই অধঃপতনের সংবাদ । যদি কখনো জানতে পারে তখন কি হবে এটা নিয়ে এখন ভাববো না । নোরার মধ্যে টানাপোড়েন । কাকে বেছে নেবে সে জীবনসঙ্গী হিসেবে । সৃজন নাকি চঞ্চল ?
সৃজন পরামর্শ পেয়েছে মেয়েরা বেদআতের ঝরণা। তাই মেয়েদের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। কোনো ধরণের নারী সং¯্রবে না আল্লাহ-রাসূলের জিহাদি রাস্তায় চলে আসছে যা ভুল পথ। সৃজন এতকিছু জানে না। সৃজন শুধু সরল মনে ওর বন্ধুর কথা বিশ^াস করেছে। মাঝেমধ্যে দুই বন্ধু একসঙ্গে সাইদুল মাস্টারের বাসায় যায়। সাইদুল মাস্টার ভালো হাদিস জানেন। বোমাও বানাতে জানেন। সে-ই এখন তাদেরকে বোমা বানানো শেখাচ্ছে। অনেক মানুষকে টার্গেট করে রেখেছে তারা।
সৃজন আর ওবায়দুর খুব ভালোভাবে এগুলো শিখে নিচ্ছে । তারা বিশ^াস করে এই পথ তাদেরকে পূণ্যের পথে নিয়ে যাবে । সুতরাং তারা সবকিছু শিখছে । সাইদুর মাস্টার আগে তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন । পরে সেখানে শিক্ষকতাও করেছেন । কিন্তু মাদ্রাসার নীতিবিরোধী কাজে যুক্ত থাকার জন্য বহিষ্কৃত হয়েছেন । এখন বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন ইসলামী পরামর্শ দিচ্ছেন ঘরে বসেই । তার আত্মীয়রাও তার নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত । ছেলেমেয়েরা অবশ্য বলে থাকে তিনি কারগিল যুদ্ধের মুজাহিদ ছিলেন । তবে অনেকে আবার বলে থাকেন উনি তালেবানের সাথে যুক্ত ছিলেন । অনেকে বলে থাকেন তিনি আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু । এরকম নানা বিশেষণ তার সম্পর্কে শোনা যায় ।
সৃজনের এসব শেখা হয়ে গেছে সাইদুল মাস্টারের কাছে। বাসায় এখন পিস টিভি ছাড়া কোনো চ্যানেলই চলে না। চালাতে দেয় না।
ছোটবোন শুপন স্টার প্লাস দেখতে গেলে সৃজন বলে, তুই জানিস না ওরা আমাদেরকে শোষণ করছে । তারপরেও এসব দেখবি ?
এখন সৃজন ছোটবোনের সাথে আর তর্ক করে না । বরং বোরকা পরতে বলে । বাইরে বের হতে দেয় না । বাইরে যেতে চাইলেই বোরকার প্রসংগ তোলে । শুপন পাত্তা দেয় না এসব । ভাবে পাগলামি । শুপন না বলে কোথাও বেরিয়ে গেলে সে তখন অনেক রাগ করতে থাকে । বোরকা ছাড়া বের হলে তো রক্ষা নেই ।
শুপন প্রাইভেট থেকে ফিরলে সৃজনের সাথে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল । শুপন ক্লান্ত হয়ে কেবল বসেছে । এর মধ্যে সৃজন বললো, ‘বাইরে যেতে হলে অনুমতি লাগে না ?’
শুপন বললো, ‘কিসের অনুমতি ? আমাকে কি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখে বাইরে যেতে হবে ?’
সৃজন তখন ভয়ংকর রেগে আছে । বোনের গায়ে হাত উঠাতে গিয়ে থেমে গেল ।
শুপন বললো, ‘তুমি তো আগে এরকম ছিলে না । এখন এমন করছ কেন ?
সৃজন বললো, ‘তোমার দোষে’
সোফায় বসে পড়লো সে । আর কথা বললো না সে । শুপন এখন অনেক ভয় পায় সৃজনকে । ছোটভাই হওয়া সত্ত্বেও । এখন প্রতিদিন বোরকা পরে কলেজে যায় । কোচিংয়ে যায় । এখন আর তাই সৃজন কিছু বলে না । একদিন হঠাৎ করে নোরা সৃজনের বাসায় চলে আসে । সৃজন তখন বাসায় ছিলো না । শুপনের কাছ থেকে সব জানতে পারে নোরা ।
নোরা: তুমি শুপন, না ?
শুপন: জ¦ী, আমিই শুপন । কাকে চাচ্ছেন ?
নোরা: আমি সৃজনের বন্ধু । আপনার কথা আমি ওর কাছে প্রায় শুনি ।
শুপন: ওহ ভিতরে আসুন । আসুন ।
নোরা ভিতরে চলে আসে । পুরো ঘরটিতে একবার তাকিয়ে দেখে ।
শুপন: সৃজন এখন বাইরে গেছে । কোথায় যায় না যায় ঠিক নাই । এখন তো পুরো পাল্টে গেছে ও ।
নোরা: পাল্টে গেছে মানে ?
শুপন: এখন তো ওর জন্য আমি বাইরেই যেতে পারি না । বাইরে গেলেই বলে ওঠে বোরকা পরো বোরকা পরো।
নোরা: বুঝছি । ওর সাথে তো আমাদের অনেক বছরের বন্ধুত্ব ছিলো । মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হলো । গ্যাপ সৃষ্টি হলো । আচ্ছা ভালো কথা, তুমি ওর নম্বর দাও তো । ওর সাথে কথা বলবো ।
শুপন মোবাইল বের করে সৃজনের মোবাইল নম্বরটি দেয় এবং বললো, ওকে ফোন করলে তো বিপদ । ওর আবার মেয়েদের সাথে আড়াল থেকে কথা বলছে ইদানিং । আমার তো সন্দেহ হয় ও ভুল পথে চলে গেল না তো ।
নোরা বললো, এই ব্যাপার তাহলে । আচ্ছা আমি আজ তোমাদের বাসায় থাকবো । তুমি ওকে বলবে না । আমি লুকিয়ে শুনবো ও আমার সম্পর্কে কি বলে ? তুমি খুব কৌশলে ওকে আমার কথা জিজ্ঞেস করবে ।
শুপন বললো, আচ্ছা তাই হবে ।
শুপন এখন নোরার কাছ থেকে অন্য জায়গায় চলে গেল । মাগরিবের আযানের পর সৃজন আসবে । নোরা ততক্ষণ অপেক্ষা করতে থাকলো ।
যথারীতি মাগরিবের আযানের সময় সৃজন এসে ওযু করে নামাজে দাঁড়িয়েছে । নোরা মনে মনে খুব খুশী হলো যে তার বন্ধুর এতদিনে
বোধোদয় হয়েছে । মাগরিবের নামাজ শেষ হলে কিছুক্ষণ বসলে শুপন কিছুক্ষণ পর আসলে সৃজন ইঙ্গিত দেয় । তাতে শুপন বুঝে যায় যে সরে যেতে হবে । একটু হেসে সরে গেল । তারপর মাথায় কাপড় দিয়ে বললো, নোরা নামের একটি মেয়ে এসেছিলো । তোমার বন্ধু বলছিলো ।
সৃজন ক্ষেপে গিয়ে বললো, মেয়েদের নাম আমাকে বলবে না । তাদের নাম শুনলে গুনাহ হবে । আর নোরা, এই মেয়েটা না জানি কার কার সাথে শুয়ে এসেছে । এখন এসে হম্বিতম্বি করছে ।
শুপন বললো, কেন গুনাহ হবে ? দুপুরে কথা হলো ওর সাথে । ভালোই তো ।
সৃজন বললো, এইসব মেয়ে ছলাকলা জানে । কিছু বাগাতে এসেছে । আমি নিশ্চিত লিখে দিতে পারি ।
শুপন বললো, তুমি লিখে দিলেই হবে ?
সৃজন বললো, হানড্রেড পারসেন্ট ।
নোরা পর্দার আড়াল থেকে সবকিছু শুনছিলো । এই কথা শুনে তার খুব মন খারাপ হয়ে গেল । কানড়বায় ভিজে উঠলো দুই চোখ । আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না । পর্দার কোণ থেকে আত্মপ্রকাশ করলে শুপন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ওঠে ।
নোরা: (কাঁদতে কাঁদতে) তুমি আমাকে এইভাবে চেনো ? আমরা তিন বছর ধরে যে প্রেম করলাম তা কি শুধুই অভিনয় ।
সৃজন: (অবাক ও রাগান্বিত হয়ে) আশ্চর্য তোমাকে আমি ভালো বন্ধু বলে গ্রহণ করি নি কখনো ।
নোরা: (একটু থেমে) তাহলে কি আমাদের সম্পর্ক কি মিথ্যা ?
সৃজন: হ্যা । মিথ্যা । কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি নি কখনো ।
শুপন: আচ্ছা সৃজন থাম । অনেক হয়েছে ।
নোরা কাঁদছে । শুপন নোরাকে ধরে রেখেছে । নোরা তখন শুপনকে বলছে, আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করছে না । আমার দমবন্ধ লাগছে ।
হঠাৎ করে নোরা হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো । সে সৃজনকে বিয়ে করবেই । যতই ঝড়তুফান আসুক । এই কথা শোনার পর সৃজন নোরাকে টেনে ধরে দরজার বাইরে বের করে দিলো । - আর কোনোদিন যদি আসিস এখানে ।
দরজা বন্ধ করার পর শুপন বললো, এ কি করলি । যে মেয়ে তোমাকে বিনা সংকোচে ভালোবেসে গেছে সেই মেয়েকে তুমি এভাবে প্রত্যাখান করতে পারলে ?
সৃজন বললো, ‘আমি যা জানি তা নিশ্চয় তুমি জানো না ।’
এই বলে নিজের ঘরে চলে যায় । নিজের ঘরে গিয়ে কোরআন পড়া শুরু করলো। শুপন কিছুই বললো না। ভাবলো শুভবুদ্ধির উদয় হচ্ছে।
পরদিন সকালবেলা। সৃজন অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। ভোর চারটা পর্যন্ত কোরআন শরীফ পড়েছে সে। ফজরের নামায পড়ে ঘুমিয়েছে। শুপন অবশ্য এসবের মধ্যে নেই। বোরকা পরে সৃজনের ভয়ে। স্বেচ্ছায় চলতে চাইলেও চলতে পারে না। সৃজন সকালে উঠেই গোসল করে নিয়েছে। এখন কাকরাইল মসজিদে যাবে। উবায়দুল্লাহর সাথে তাবলীগ করবে।
কাকরাইল মসজিদে তাবলীগ করার সিদ্ধান্তটি ইতঃপূর্বেই বাতিল করে দিয়েছে উবায়দুল্লাহ। সৃজন সেটা জানে না। সৃজন উবায়দুল্লাহর কাছে গিয়ে বললো, ‘চলো, যাই।’
উবায়দুল্লাহ বললো, ‘ওখানে না। চলো আমরা ওয়াজ শুনে আসি।’
সৃজন: কার ওয়াজ ?
উবায়দুল্লাহ: নারায়ণগঞ্জে মাওলানা হেকমত আলীর ওয়াজ হবে। চলো সেটা শুনে আসি। তাবলীগ করে কাজ নেই।
সৃজন: আচ্ছা। চলো।
যেতে পথে অনেক গল্প হয় দুজনের। গল্প করতে করতে কখন যে পৌঁছে যায় নিজেরাই জানে না। নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে ২০ কিলোমিটার একটা অটো নিয়ে তারা এগোতে থাকে।
উবায়দুল্লাহ: বুঝছ, যারা মেয়েদের বিরক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের জিহাদে নামতে হবে।
সৃজন কিছু বলে না। সায় দেয় খালি।
উবায়দুল্লাহ: যারা নাস্তিক, তাদের হত্যা করা ওয়াজীব। এই সমস্ত কুলাঙ্গারদের জন্যই আমাদের দেশের অবস্থা ভালো হয় না।
সৃজন: মনে হয় পৌঁছে গেছি।
চারপাশে তাকায় উবায়দুল্লাহ। তারপর অটো থামিয়ে টাকা দেয় সে। দুজনই অটো থেকে নেমে যায়।
ওয়াজ শোনা শেষ হলে পথে সৃজন আর উবায়দুল্লাহর মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। সাথে সাথেই সৃজন উবায়দুল্লাহর সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেয়। বাসায় গিয়ে বোনকে সব খুলে বলে। সব শুনে শুপন বলে ওঠে, ‘কি মারাত্মক কাজ করেছিস তুই ! তাই বলি তুই এত ধর্মপ্রাণ হলি কিভাবে।’
গভীর রাতে বাসায় ফিরে সৃজন শুপনকে বলে ওঠে, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
শুপন এখন আর বাইরে যেতে হলে সৃজনের কাছে অনুমতি নেয় না। স্বেচ্ছায় সবকিছু করে। বোরকাও পরে না। মাথায় কাপড়ও দেয় না। তাকে অনেক সুন্দর দেখায় আগের চেয়ে।
ঘরে ঢুকে সৃজন জানতে পারে নোরার সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। নোরা নিজেই এসে বিয়ে ঠিক করে গেছে।
সৃজন শুধু একটাই কথা বললো, ‘কাজটা ভালো করলে না।’