আবুল মনসুর আহমদ’র সাহিত্য কর্ম
হালিমা মুক্তা
“ব্যঙ্গ সৃষ্টিতে অসাধারন প্রতিভার প্রয়োজন এ যেন সেতারের কান মলে সুর বের করা সুরও বেরু বে, তার ও ছিঁড়বে না”। হ্যাঁ এই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন কাজি নজরুল ইসলাম। কোন এক ব্যঙ্গ শিল্পিকে নিয়ে। এখন আমরা জানবো কাকে উদ্দেশ্য করে এ উক্তিটি করেছিলেন আমাদের প্রিয় কবি। হয়ত আমরা কিছুটা অনুধাবন করতে পারছি। সে আর কেউ নন আমাদের প্রিয় “ব্যঙ্গ” গল্পকার আবুল মনসুর আহমেদ। সাহিত্য ক্ষেত্রে অসামান্য অসাধারন পন্ডিতের অধিকারী আবুল মনসুর। তিনি লেখালিখির জগতে আবুল মনসুর নামেই খ্যাত। আবুল মনসুর আহমেদ বাংলাদেশের সাহিত্যের অন্যান্য শেষ্ট ব্যঙ্গ গল্পকার শুধু নয়, বাংলা সাহিত্যের ও একজন শেষ্ট ব্যঙ্গ গল্পকার। সাহিত্য শিল্পির যা প্রধান ঐশর্য ভাষা-সম্পদ, তা আবুল মনসুর আহমেদের ছিল। আবুল মনসুর আহমদ শিল্পের জন্য শিল্প নয়- জীবনের জন্য শিল্প নীতিতে বিশ্বাস ছিলেন। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি লেখালিখি করে আসছেন। মাসিক আল ইসলাম পত্রিকায় স্পেনের মুসলিম স্থাপত্যকীর্তি ওপর একটি অনূদিত রচনা প্রকাশিত হয়। এটিই আবুল মনসুর আহমদের প্রথম প্রকাশিত রচনা। আবুল কালাম শাসসুদ্দীন সম্পাদিত সাপ্তাহিক মুসলিম জগৎ-এ নিয়মিত লেখা শুরু করেন।
আবুল মনসুর হাইস্কুল থেকেই তার লেখার হাতেখড়ি শুরু। তার সাহিত্য জীবন শুরু হয় মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকেই সওগাত পত্রিকায় নিমক-হারাম নামে প্রথম তার গল্প প্রকাশ। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন ভাবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন। শেরেবাংলা ফজলুল হকের মালিকানাধীন দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় সম্পাদকের দ্বায়িত্ব গ্রহন। পেশাগত জটিলতার কারণে তিনি বেনামীতে এই দ্বায়িত্ব পালন করতেন। জানুয়ারিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় সম্পাদনায় দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন। একই বছর ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। তিনি সাহসিও বটে। তার বিভিন্ন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, শিরোনাম পড়লে আমরা বুঝতে পারি। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় ‘গোলামী সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি তারপর থেকেই সাপ্তাহিক মুসলিম জগৎ এ নিয়মিত লেখা শুরু করেন। ‘ছবি বড় তৈয়ুব নামা’ নামে পুঁথি-প্যারোড এবং সভ্য তার দ্বৈত্য শ্বাসন’ নামে দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন। আবুল মনসুর আহমদ প্রধানত গদ্য-লেখক আবুল মনসুরের দীর্ঘ একাশি বছরের জীবনের মধ্যে রচিত হয়েছে তার বিশাল সাহিত্য ভান্ডার। সব ধরনের লেখা মিলিয়ে আবুল মনসুর আহমদের শুধু পুস্তক আকারে ছাপা বইয়ের পৃষ্টাই সাত হাজারের কাছাকাছি। তার বিখ্যাত ব্যাঙ্গ গল্প গন্থের সংখ্যা চার টি। (১) আয়না, (২) ফুড কনফারেন্স, (৩) আসমানী পর্দা, (৪) গালিভরের সফর নামা। মূলত এই চারটি ব্যাঙ্গ গল্প গ্রন্থের উপরেই কিছুটা আলোক পাত করবো। আয়না সম্পর্কে অন্নদাশংকর রায় বলেন “আয়না” লিখা আবুল মনসুর আহমেদ প্রাপ্তঃস্বরনীয় হইয়াছিলেন। ফুড কনফারেন্স লিখিয়া তিনি অমর হইলেন। গল্প গুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য ব্যাঙ্গবিদ্রুপ ও পরিহাস প্রিয়তা। তবে নিছক পরিহাসই লেখকের উদ্দেশ্য নয় পক্ষান্তরে আবুল মনসুর আহমদের গল্পের পেছনে তীক্ষè সমাজ ও সমাজ কল্যান উদ্দেশ্য কাজ করেছে। তার দুঃখকে তিনি পরিহাস দিয়ে ব্যক্ত করেছেন। সমাজের অসংগতি লেখকে পিড়া দিত। তাই তার প্রত্যেকটি কর্মে তার পরিস্কার ছাপ পরস্ফুটিত হয়। লেখক সম্পর্কে সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক আবু জাফর শামশুদ্দিন বলেন “তার জীবন বৈচিত্রময়, আমি তাকে ক্ষুরধার প্রতিভাশালী লেখকরুপে আজীবন শুদ্ধ করে এসেছি। “আয়না” তার অবিস্বরনীয় কীর্তি”।
ফুজ কনফারেন্স গল্পে লেখক ব্যঙ্গ করে বলেছে এইসব রাস্তায় আগে গাউন শাড়ি পরা পরীর ভিড় হতো আর আজি কিনা সেখানে অসুন্দর, অসভ্য, কুৎসিত, অর্ধোলঙ্গ স্ত্রী লোকেরা ভিড় করছে। কি অন্যায়!
“কোথাও মোটর বা ট্রেন থামলে চারদিকে হতভাগা ও হতভাগীনিরা যেভাবে গার উপর পড়ে ভিক্ষে দাও বলে জ্বালাতন করে তাতে একেবারে ঘেন্না ধরে যায়। কি উৎপাত” আমরা দেখি লেখক এ গল্পে ব্যঙ্গ করে সমাজের বড় শ্রেনীর পুজিবাদি মন কিভাবে শোষন করবে নিজেদের হাতে ক্ষমতা রাখবে কিভাবে নিজের
ভাল থাকবে এর চিত্র তুলে ধরেছেন। নিচু শ্রেনীর লোকেরা না থাকলেই যেন উচ্চ শ্রেনীর লোকেরা বেঁচে যায়। এখানে নি¤œ শ্রেনী ও উচ্চ শ্রেনীর বৈষম্যের দিক গুলো লেখক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলে ধরেছেন। লেখক গল্পের ভাবধারা ব্যঙ্গ উপমার মধ্য দিয়ে শেষ করিয়াছেন। যেমন ছাগলে- বাঙলাটা দাড়ি নেড়ে বললেন! তা হল বটে কিন্তু শেরে বাঙলা হাতীয়ে বাঙলা প্রভৃতি শুধু জানোয়ারে বাঙলাতেই আমরা বেঁেচে রইলাম । মানুষে বাঙলারা যে, সবাই মরে গেল। সকলে জয়ধ্বনি করলেন জানোয়ার-বাঙলা জিন্দাবাদ। মানুষে-বাঙলা মুর্দাবাদ।। তেমনি ভাবে আমরা দেখতে পাই গালিভরের সফর নামা গল্পটিতে লেখেক ব্যঙ্গ করে সুন্দর ভাবে বুদ্ধিমান ও নিরবুদ্ধিতার উত্তাপন করে গেছেন। লেখক গালিভরের সফর নামাই বিরাট সত্য উদঘাটন করেছেন। সাহসের সাথে তিসি লেখার মাধ্যমে সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। চোখে আঙ্গুল দিয়ে তিনি আমাদের সমাজের অসংগতি দেখিয়ে গেছেন। লেখক যদি আর কোন সাহিত্য কর্ম সৃর্ষ্টি নাও করতেন তবুও তিনি এই চারটি ব্যঙ্গ গল্প গন্থের জন্য বাংলা সাহিত্য অমর হয়ে থাকতেন। গ্রন্থ গুলোতে ভাব ছাড়াও অন্যান্য রস-রচনাও রয়েছে। “ফুড কনফারেন্স মোট নয়টি ব্যঙ্গ গল্পের সমাহার ঘটেছে। গালিভরের সফর নামাই নাট্য চিত্র দুটো, ব্যাঙ্গ গল্প সাতটি। আসমানী পর্দা’র মোট দশটি রস-রচনার মধ্য তিনটি প্যারোডি-কবিতা, দুটো নাট্য চিত্র এবং পাঁচটি ব্যঙ্গ গল্প রয়েছে। আয়নার সাতটিই ব্যঙ্গ-গল্প”।
১. আবুল মনসুর আহমেদের ব্যাঙ্গ গল্পের পটভূমি মূলত তিনভাগে ভাগ করা যায়। (১) ধর্মীয়, (২) রাজনৈতিক, (৩) আর্থ-সামাজিক।
(১) ধর্মীয়ঃ তিনি এই ধরনের গল্প গুলোতে ধর্মান্ধত, ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্মের নামে ভন্ডামি এবং ধর্ম-ব্যবসায়ের মুখোস উম্মোচন করেছেন।
(২) দ্বিতীয় ভাগের গল্প গুলোতে তিনি সমকালীন রাজনীতি ও রাজনীতিক নেতাদের অন্ধাকার দিক ব্যাঙ্গের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। যেমন গালিভরের সফর নামা।
(৩) আর্থ-সামাজিকঃ পর্যায়ের ব্যঙ্গ গুলোতে তিনি প্রধানত বাঙালি সমাজও বাঙালি চরিত্রের অসংগতি বা দোষত্রুটি সমূহ বার বার প্রয়াস করেছেন। আবুল মনসুর আহমেদ কে আমরা একজন প্রখর দৃষ্টি সম্পন্ন শক্তিমান ব্যঙ্গকার হিসাবে দেখতে পাই। আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গ গল্পে দুটো মুখ্য বিষয়। (ক) রস-রচনা হিসাবে এর সার্থকতা বা রস বিচার এবং (খ) এই ব্যঙ্গের পিছনে লেখকের সমাজ-দৃষ্টি। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন ভাবে লিখেছেন। ব্যঙ্গ বিদ্রুপের আঘাতে সমাজ ও দেশের চৈতন্য জাগরোন তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো। হাসতে হাসতে কাঁদতে যাওয়ার মতো ব্যাপার ও তার রস-রচনার ক্ষেত্রে পরিদৃষ্ট হয়। ‘তার আদু ভাই একটি জমৎকার হিইমার চরিত্র।
২. তার উপন্যাস জীবন ক্ষুধা, আবে হায়াত প্রকাশ হয়। ১৯৭৫ : আল কোরআনের নসিহৎ নামে কোরআন শরিফের বিষয়ভিত্তিক সংকলন প্রকাশ। ১৯৭৮ : আত্মকথা প্রকাশিত হয়। (১) ১৯৩৫ : গল্প গ্রন্থ আয়না প্রকাশ। ২। ১৯৪৪ : গল্প গ্রন্থ ফুড কনফারেন্স প্রকাশ। ৩। ১৯৫৭ : গল্প গ্রন্থ আসমানী পর্দা প্রকাশ। ৪। ১৯৫৯ : গল্প গ্রন্থ গালি ভরের সফর নামা প্রকাশ। আবুল মনসুর সাহিত্যর মাধ্যমে সমাজ সংস্কার করতে চেয়েছেন। অকুতভয় এক যোদ্ধার নাম ছিলো আবুল মনসুর আহমদ। ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন সময়ে তার সাহসী উচ্চারনে আমরা অভিভূত হয়ে পড়ি। নন্দিত এই ব্যাক্তি আয়নার মতো গল্প গ্রন্থ লিখে যে, সৎ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যি বিস্ময় কর ব্যাপার। হুজুর কেবলা নায়েবে নবী বা মুজাহেদীনের মতো গল্প লিখতে এবং তা প্রকাশ করতে কতটা সৎ সাহসের প্রয়োজন আজকের দিনে তা কল্পনা করা অসম্ভব। এমনি গুনি মানুষের লেখা ও জীবন চিন্তা আধুনিক সমাজে আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। তাকে নিয়ে ব্যাপক গবেষনার প্রয়োজন বোধ করি। তিনি ছোট গল্পের জন্য বাংলা একাডেমীতে পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর সমকালীন সমাজের অন্ধকার দিকের উন্মোচনে লেখকের বড় সাফল্য। ছাত্র বয়সেই তিনি কবিতা ও প্রবন্ধের জন্য পুরস্কৃত হন।