সূর্য অনুরাগ
কৃপাণ মৈত্র
মা ঝাঁজালো স্বরে বললেন, কী দরকার ছিল এমন ঝুঁকি নিয়ে অন্যকে বাঁচাতে যাওয়ার । কেন ও কি তোর রক্তের সম্পর্ক? তাও যদি এক জাতের হত তো কথা ছিল।
করিশ্মা কথা বলে না । বলে না এই কারণে যে সে তার মাকে বোঝাতে পারবে না মানুষের কোন জাত হয় না। কিছু স্বার্থপর মানুষ জাত নামক এক সংক্রামক রোগ তৈরি করেছে এবং মানুষের মধ্যে এমন ভাবে ইঞ্জেক্ট করে দিয়েছে যে তার প্রভাব চলছে যুগ যুগ ধরে।
ক্ষতস্থানে ডেটল দিতে দিতে মা বললেন , নাম কী?
-জানিনা।
-থাকে কোথায়?
-বলতে পারব না।
-কিছুই যদি না জানিস তো এত দরদ উথলে উঠল কেন!
করিশ্মার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে যন্ত্রণা সহ্য করছে । চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়েছে। মুখ যন্ত্রনার প্রকাশ স্পষ্ট।
এ দৃশ্য মায়ের চোখ এড়িয়ে যাবার নয়।
-কীরে হাড় ভাঙেনি তো।
তার মা ছুটে বেরিয়ে গেলেন। করিশ্মা ভাবে তার কী বা করার ছিল ।ও জায়গা না দিলে যে বাচ্চা মেয়েটা রাস্তার ধারে গড়িয়ে পড়তো। ভাঙ্গা রাস্তার সংকীর্ণ পথ যে দুজনের দখলদারিতে বিপদ ডেকে আনবে সে তো তখন কেউ বুঝতে পারেনি। সে মেয়েটিকে আগেও দেখেছে। সম্ভবত সবে সাইকেল চড়া শিখেছে। আরেকটু রপ্ত হয়ে বেরোনো উচিত ছিল। আজ না হয় সে ছেড়ে দিয়েছে। অন্য কেউ যে রাস্তা ছেড়ে উদারতা দেখাবে তা তো নাও হতে পারে। ব্রাম্ভণ পাড়ার দিকে ওকে যেতে দেখেছে সে। কিন্তু ওর সঙ্গে আলাপ হয়নি কখনো।
রফিউল গ্রামের কোয়াক ডাক্তার। গরিব পাড়ার একমাত্র ডাক্তার। গরিবদের এফ আর সি এস। ওকে ওরা বিশ্বাস করে। ওষুধের থেকে মনের জোরে বেশি কাজ দেয়।
ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন , সম্ভবত সামান্য একটা ফ্র্যাকচার হয়েছে। একটা ছবি করাতে পারলে ভালো হতো।
মায়ের মুখে বিরক্তি এবং উদ্বেগ। মনে হল একটা পাহাড় যেন ভেঙে পড়েছে তার মাথায় ।
-কত খরচ হবে?
-দুশটাকা তো বটেই । তার সঙ্গে ওষুধ ব্যান্ডেজ আছে।
করিশ্মা চুপ করে সব শুনছে। চুরির দায়ে তার বাবা জেল খাটছে। এই কদিন আগে ছোট ভাইটার কলেরা হয়েছিল। মায়ের শেষ সম্বল কাঁসার থালা চারটি বিক্রি করে ডাক্তার ওষুধ কেনা হয়েছিল। আর তো অবশিষ্ট কিছুই নেই । ভাতের চাল বাড়ন্ত। চাচার বাড়ি থেকে এক বাটি চাল ধার করতে গিয়েছিল করিশ্মা। চাচী অনেক কথা শুনিয়েছিল। বলেছিল, তোর মা কোন খাস তালুকের বেগম রে । আমাদের সঙ্গে কয়লা কুড়াতে তোর মার শরম হয়। তবু যদি তোর বাপ না চুরির দায়ে জেল খাটত।
তোর বাবার কোনো দোষ নেই। মালিকের অনেক নষ্ট কাজের সাক্ষী তোর বাবা। মোল্লা উপযাচক হয়ে তোর বাবাকে কিছু টালি দিয়েছিল। তাতেই সন্দেহ দানা বাঁধলো। ভয় হলো মোল্লাকে বুঝি তোর বাবা সব কথা বলে দিয়েছ ।তোর বাবার কারখানার কাজ গেল ।তারপর একদিন পুলিশ কারখানায় রেড করল। মজিদের ধারণা হলো এসব তোর বাবার কান্ড। ভেতরে ভেতরে টাকা দিয়ে মজিদ সব মিটিয়ে ফেলল। চুরির দায়ে তোর বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। করিশ্মার মা হামিদা করিশ্মার চুলে চিরুনি দিতে দিতে করিশ্মার কাছে মনের ভার হালকা করেছিলেন। করিশ্মা উপলব্ধি করেছিল তার পিঠে তার মায়ের গরম শ্বাস ভেতরের পুড়ে খাক হওয়া অন্তরের ভাব আত্মজাকে তাপিত করেছিল। করিশ্মা ভাবে এই সংসারে স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মানুষ পারে না এমন কাজ নেই। অথচ ঈশ্বর তো মিলে মিশে থাকতে বলেছেন। সকলের মধ্যে তো সমান উপাদান দিয়ে তিনি মানুষ তৈরি করেছেন।
ডাক্তার চলে গেলে হামিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কী হবে বল দিকিনি। আমার কাছে যে ফুটো পয়সাও নেই।
-তুমি ভেবনা তো। ওসব কিছুই হয়নি। তুমি বরং একটু নুন তাবা দাও তো।
-তুই আমার নাড়ী ছেঁড়া ধন। তুই কিছু হয়নি বললে আমি বিশ্বাস করবো। যখন মা হবি তখন বুঝতে পারবি।
হামিদা উঠে গেলেন।
করিশ্মাদের বাড়ি রাস্তা থেকে অন্দরমহল পর্যন্ত দেখা যায়। অভাবের সাক্ষী ঘরের ভাঙা কাঠামো। ভাঙা দেওয়াল। ভোটের পর ফেলে দেওয়া ফেস্টুন খাটিয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সম্মিলিত অস্থায়ী পার্টি অফিস। একটা সংকীর্ণ পথ ধরে তাদের বাড়ি যেতে হয়। বর্ষায় দরিয়া হয়ে যায়।
কে যেন সাইকেল নিয়ে আসছে। পিছনের ক্যারিয়ারে সেই মেয়েটি।
করিশ্মাকে দেখে উল্লসিত হয়ে মেয়েটি বলল, বাবা ঐতো সেই দিদিটা।
বিস্কুট আর ফলের ব্যাগটা করিশ্মার পাশে রেখে রেখার বাবা বললেন, তোমাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। রেখার ক্ষত তুমি যে চেয়ে তোমার শরীরে নিয়েছো। ঈশ্বরের কত বড় দান হলে তবেই না এমনটা হয়।
হামিদা মাথায় একটা বড় ঘোমটা টেনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, গররিবের ঘরে উদারতা যে বড় দায়।
রেখার বাবা বললেন, কেন কেন খুব ইনজিওরড হয়েছে বুঝি। ডাক্তার কি বললেন?
-ফ্র্যাকচার হয়েছে। ছবি করা ঔষধ কেনা -সে অনেক টাকার ব্যাপার। আমরা গরিব। পাব কোথায় ?
সে তো নিশ্চয়। অনেক টাকা তো লাগবেই।
রেখার বাবা পকট থেকেএকটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে বললেন, এতে হবে না ? আমি কালকে একবার আসবো।
হামিদা কোন মতেই টাকা নিতে চান না। রেখার বাবা করিশ্মার হাতে জোর করে টাকাটা গুঁজে দিয়ে বললেন, মিস্ত্রি বউ টাকাটাই সব হল। তোমার মেয়ে যা করেছে ক’জনই বা পারে। আমরা ক’জনই বা মানুষ নামের মর্যাদা রাখতে পারি । তাই বয়স হলে বলিরেখা পড়ে। বলিরেখা তো কিছু না মনুষ্যত্ব অব্যবহারের শ্যাওলা। সেইজন্য মানুষ আয়নায় নিজের মুখ দেখতে ভয় পায়। নিজের কাছে তো নিজের ফাঁকি চলে না।
-পেট চালানো ভাতের জন্য হলে কিছুতেই নিতাম না। কিন্তু অর্থের আশায় বসে থাকলে যদি কোন অঘটন ঘটে যায়। সেই ভয়ে ঋণ হিসেবে নিচ্ছি । মিস্ত্রি ফিরে এলে সব শোধ করে দেব।
রেখার বাবা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, হামিদ ঠিক করেনি । ভালো ছেলেটাকে ফাঁসিয়ে দিলে। মুশকিল কি জানো মিস্ত্রি বউ , ওদেরও এক ঈশ্বর আছেন। আহুর মাজদা। এদের মধ্যে অবিরত লড়াই চলছে। আপাত অন্যায়ের জয় হয়। পরিণামে সত্যের জয় হয়। তাই যদি না হবে তোমার ঘরে এমন মনের মেয়ে জন্ম নেয় কি করে !
হামিদার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল । না জেনে জাত তুলে তিনি কত কথাই না বলেছেন। এখন তো আর মেয়ের জন্য রাগ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এই বিশ্ব সংসারে তাঁর থেকে ধনী কেউ নেই।
-বাবা ঘরে ডাব আছে। খাবেন?
-না থাক।
হামিদা চুপ করে গেলেন।
রেখার বাবা হামিদার মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন, না বলছিলাম, তোমাদের অভাবের সংসারে...
-না না অনেকগুলো আছে। নতুন গাছের ডাব। বামুনের সেবায় লাগলে খুশি হব।
করিশ্মা সব কথা শুনছিল । তার চোখে বাঁধভাঙ্গা জল। রেখা জামার খুঁট দিয়ে করিশ্মার চোখের জল মুছিয়ে দিলো।
পশ্চিমের সূর্যের লাল অনুরাগের আলো তখন তাদের নিষ্পাপ মুখে পড়েছে। তারা সে অনুরাগ ভাগ করে নিল।