ঝরে যাওয়া বুনোফুল




ঝরে যাওয়া 
বুনোফুল

যাহিদ সুবহান

সকাল থেকে গফুরাবাদ স্টেশনে কেমন যেন হইচই আজ একটু বেশী। প্রায় নির্জন এই লোকাল স্টেশনটা সারাদিন ফাঁকা পড়ে থাকে। যেন মরা গাছ কেটে কেউ সেই কাঠের গুড়ি ফেলে রেখেছে। একটিমাত্র লোকাল ট্রেন এই স্টেশনে থামে। আর সব ইন্টারসিটি ট্রেনগুলো থামে না। শুধু বাঁশি বাঁজিয়ে হই হই করে ছুটে চলে যায়। যাবার সময় বা হাতের বুড়ো আঙুলটা যেন খুব করে দেখিয়ে যায় স্টেশনকে। ভাবখানা এমন খুব তাড়ায় আছি ভাই; সরে যা সরে যা যেতে দে।

ব্রিটিশ আমলে তৈরী গফুরাবাদ স্টেশনে কোনো প্লাটফর্ম নেই। স্টেশন মাস্টারের অফিসটাও জরাজীর্ন। পুরোনো দালানগুলো ভগ্নদশায় পড়ে আছে। চারিদিকের পরিবেশ আর আয়তন দেখে বোঝা যায় এই স্টেশনটা একদিন খুব রমরমা ছিলো। হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখরিত হতো এই স্টেশন। ট্রেন আসার খবর হলে স্টেশন মাস্টারের অফিসের সামনে ঝোলানো ৫ ফুট লম্বা লোহার রেলিংটাতে আরেকটা লোহা দিয়ে টুংটাং শব্দ করা হয়, সবাই জানতে পারে ট্রেন আসবে। এখনো এলাকার মানুষের একমাত্র ভরসা এই লোকাল ট্রেন। অনেকের জীবন জীবীকার একমাত্র উপায়ও এই লোকাল ট্রেন। আকাশ-নদী-জল আর পাখির মতই এই এলাকার মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে এই স্টেশন। স্টেশনের আশেপাশের কয়েকটি বড় কড়ই গাছ গফুরাবাদ স্টেশনের প্রাচিন নিদর্শন ঘোষনা করছে।

আজ সকাল থেকেই পশ্চিম পাশের বড় কড়ই গাছটার নিচে বেশ জটলা দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে কারো কারো কথা বেশ স্পষ্টই শোনা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছে, ‘আহারে! অসহায় মেয়েটার এই সর্বনাশ কে করলো।’ কেউ কেউ বলছে, ‘বেশ্যার মিয়ে মরুক, ওইয়ের মরাই দরকার। ও মরলেই বাঁইচে যায়।’

একটু এগিয়ে গেলেই বোঝা যাবে যারা আহারে আহারে করছে তারা এই এলাকার মানুষ নয়; অনেক দূরের গ্রামের মানুষ। তারা কেউ লাবনীকে চেনে না। লাবনীর কষ্ট দেখে তারা সহ্য করতে পারছে না; আস্ফালন করছে। লাবনী নামের ষোড়শী মেয়েটা আজ সকাল থেকেই এই কড়ই গাছটার শেকড়ের কাছে অহস্য পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছে। বছরে দুয়েকবার স্টেশনে আসা অপরিচিত মানুষগুলোই লাবনীকে দেখার জন্য উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে ভীড় করছে সেখানে।

গফুরাবাদ স্টেশনের আশেপাশের মানুষগুলো খারাপ নয়। পাথর হৃদয়ও যে তাদের তাও নয়। লাবনীর প্রতি কোন ঘৃণার কারণে তারা লাবনীর কাছে যে আসছে না তাও নয়। লাবণীর প্রতি তাদের কোন অভিযোগ-অনুযোগও নেই। লাবনীর সাথে এই এলাকার মানুষের সম্পর্ক এমন নয় যে ঘৃণা করার মত কোন ব্যপার ঘটবে। বরং এই এলাকার মানুষগুলোই লাবনীকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। লাবনী যে তাদের তাদের চোখের সামনেই এত বড় হয়েছে। অনেক বছর ধরে লাবনীর কষ্ট এই এলাকার মানুষ দেখতে দেখতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। লাবনীর কষ্ট দেখে এই এলাকার মানুষেরই বেশী পোড়ে। লাবনীর এই  কষ্টের শেষ কোথায় তা এই এলাকার মানুষ জানে না। হয়তো মৃত্যুই এর শেষ সমাধান। তাই মানুষ ভাবে ওর মরণই ভাল। গফুরাবাদ এলাকার মানুষের প্রশ্নগুলোর উত্তর বিধাতাও দেন না। সত্যিই কি মানুষ মানুষ বিধিাতার কাছে প্রশ্নের উত্তর পায়? তাই তো মানুষ বলে ওঠে, ‘বিধাতার খেলা বোঝা বড়দায়!’

আজ থেকে ঠিক ষোল বছর আগে স্টেশনের মসজিদের পাশে মোল্লাবাড়ীর বড় খড়ের গাদার কাছে গোয়ালঘরের পাশে এক অর্ধমৃত মহিলাকে আবিষ্কার করেছিলো এলাকার মানুষ। মহিলাকে দেখা গেল একটি ফুটফুটে মেয়ে প্রসব করেছে সে। খড়ের গাদায় ময়লা-আবর্জনায় জড়িয়ে সদ্যপ্রসব করা শিশুটি শুধু চিৎকার করছিল। মহিলা কোথা থেকে এসেছে তা কেউ আবিষ্কার করতে পারে নি। তবে তার নামটি যে লাইলী তা জানা গিয়েছিল। সেদিন জন্ম নেওয়া শিশুটিই লাবনী।



মায়ের সাথে জন্ম থেকেই এই লোকাল স্টেশনটাতেই লাবনীর ঠাঁই হয়। চার বছর বয়সে মাকে হারিয়ে একদম অসহায় হয়ে পড়ে সে। এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক মহিলা তাকে কোলে তুলে নেয়। স্টেশনের পাশে পলিথিন আর খড়কুটো দিয়ে বানানো খুপরি ঘরে তারা বাস করে। এই লোকাল স্টেশেন গড়ে ওঠে লাবনীর জগৎ। স্টেশনে খালি জায়গা যেন ওর খেলার মাঠ। এই স্টেশনের গাছগুলো যেন ওর খেলার সাথী। এই এলাকার মানুষগুলো যেন তার পরম আত্মীয়। ছোটবড় সবাই লাবনীকে খুব ভালবাসে। লাবনী স্টেশনের চায়ের দোকানগুলোতে পাশের টিউবওয়েল থেকে কলসি ভরে পানি এনে দেয়। বিনিময়ে কলসি প্রতি এক টাকা করে পায় সে; এটা বাধা রেট। সারাদিন এই স্টেশনটাতে দাঁপিয়ে বেড়ায় লাবনী। ছুটোছুটি করে। চঞ্চল মেয়েটার মুখে হাসি যেন লেগেই থাকে। এই হাসি ওর অতীতের সকল ইতিহাসকে ঢেকে দেয়। ঢেকে দেয় আকাশে তুলোমেঘ হয়ে উড়ে বেড়ানো ওর জন্মের ইতিহাস। এই স্টেশনটা লাবনীকে ভুলিয়ে দেয় ওর মায়ের কথা; বাবার কথা।
আজ লাবনী খুব অসুস্থ। প্রচন্ড পেটে ব্যথা তার। ব্যথায় কাতর হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি করছে সে। ওর আত্মচিৎকারে আশপাশ ভারী হয়ে উঠছে। লাবনীর পেটের আকার বলছে সে গর্ভবতী। অবিবাহিত মেয়েটার এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা নিয়েই আশেপাশের মানুষের কৌতুহল। এখানে জড়ো হওয়া মানুষেরা লাবনীর এই অবস্থা দেখে আস্ফালন করে বলছে, ‘আহারে, অসহায় মেয়েটার এই সর্বনাশ কে করলো!’        

রোদে পুড়ে-বৃষ্টিতে ভিজে লাবনীর চেহারা কেমন যেন হয়ে গেছে। চামড়ায় ময়লার আস্তর পড়ে গেছে। চুলগুলো উসকো খুসকো। তবুও ওকে অপরূপ সুন্দর লাগে। প্রকৃতির নানা প্রতিকূলতা আর অযত্ন লাবনীর সৌন্দর্যকে একটুও ম্লান করতে পারে নি। তবে লাবনীর মুখের অবয়ব আর শারিরীক গঠন দেখলে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, সামান্য যত্ন আর একটু তেল সাবান শরীরে পরলে লাবনী হতো অপূর্ব সুন্দরী। তখন লাবনীর সৌন্দর্য ক্লিউপেট্টাকেও হয়তো হার মানাতো। অনেক সুদর্শন যুবক লাবনীর সৌন্দর্যের প্রেমে পড়তো। পড়ে নি তাও নয়। বছরখানেক আগে মোল্লাবাড়ীর ছোট ছেলে সাগর লাবনীর প্রেমে পড়েছিলো। সারাদিন শুধু স্টেশনে ঘুরঘুর করতো লাবনীকে এক নজর দেখার জন্য। লাবনীও সাগরকে দেখে মিটমিট করে হাসতো। মোল্লা সাহেব জানতে পেরে সাগরকে খুব মারধর করেছিলেন। শাসন করেছিলেন খুব।
সকাল থেকে মেয়েটা এভাবে পড়ে আছে। ওকে একটু হাসপাতালে নেওয়ারও কেউ নেই। কে-ই বা নিয়ে যাবে; ওর তো কেউ নেই! ওর সাথে যে বুড়ি থাকে সেও তো সেই ভোরে ভিক্ষা করতে চলে গেছে। সবাই বলাবলি করছে মেয়েটাকে অন্তত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু কেউই এগিয়ে আসছে না। সবাই যার যার মত ব্যস্ত।

লাবনীর চিৎকারের আঁওয়াজ বাড়ছে। কয়েক ঘন্টা পর দেখা গেল লাবনীর চিৎকার থেমে গেছে। কী হল কোন ঠাওর করা গেল না। কেউ হয়তো ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। কিন্তু কড়ই গাছের শেকড়ের কাছে মানুষের জটলা রয়েই গেছে। দেখা গেলা ধূলোয় পড়ে আছে লাবনীর নিথর দেহ। কেউ কেউ বলছে, ‘আহারে! অসহায় মেয়েটার এই সর্বনাশ কে করলো। মেয়েটা মরেই গেলো!’ গফুরাবাদ স্টেশনের স্থানীয় লোকজন বলতে লাগলো, ‘বেশ্যার মিয়ে মরেছে ভাল হইছে, ও মইরেই বাঁইচে গেল!

পাবনা


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট