বাংলা সাহিত্যের নীললোহিত
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে পৃথিবীর সকল বাংলা ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক ধরে বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে খুব জনপ্রিয় একজন কথাশিল্পী হিসেবে নিজের একটা পাকাপোক্ত জায়গা নিয়ে রেখে ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও রোমান্টিক। তাঁর কবিতার বহু পংক্তি সাধারণ মানুষের মুখস্থ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লেখালেখির জগতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন। কখনো ‘নীললোহিত’, কখনো ‘সনাতন পাঠক’ আবার কখনো ‘নীল উপাধ্যায়’ ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। তবে তিনি ‘নীললোহিত’ ছদ্মনামে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। তাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বাংলা সাহিত্যের নীললোহিত হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নিলেও সাহিত্য অঙ্গনে একজন ভারতীয় বাঙালী লেখক হিসেবে পরিচিত। তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশের প্রতি তিনি বরাবরই একটা অকৃত্রিম টান অনুভব অনুভব করতেন। বাংলাদেশের লেখকদের সাথে তাঁর ছিল খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। দুই বাংলার লেখকের মাঝে একটা সুন্দর মেলবন্ধন সৃষ্টিতে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আধুনিক বাংলাকে এবং ভারত ও বাংলায় শিল্পায়নের প্রভাব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। গ্রামীণ এবং নগর জীবনের ছোট-বড় নানা সমস্যা তিনি তাঁর গল্পে, উপন্যাস ও কবিতায় স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি সচেতন ছিলেন। আর সে কারণেই তার সৃষ্টিকর্মে প্রেম কিংবা সামাজিক সমস্যা শক্তিশালীরূপে ফুটে উঠে। এছাড়াও রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদি। স্বনামে ও নানা ছদ্মনামে লেখনীর অসাধারণ জাদুশক্তি দিয়ে তিনি এপার-ওপার বাংলার সাহিত্যপ্রেমীদের গল্প, কবিতা, উপন্যাসের রসে মাতিয়ে রেখেছিলেন। বহুমাত্রিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন যেমন একজন অসাধারণ লেখক, তেমনি ছিলেন দয়ালু এবং সেইসাথে উষ্ণ হৃদয়ের একজন প্রাণবন্ত আড্ডাবাজ মানুষ। ১৯৫৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’ এবং ১৯৬৬ সালে প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশিত হয়। তারপর তিনি কবি, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গোয়েন্দা সিরিজ, ঐতিহাসিক, ভ্রমণকাহিনী, শিশুতোষ গল্পসহ দুশোরও বেশি বই লিখেছিলেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম বাংলাদেশের বৃহত্তর ফরিদপুরের (বর্তমানে মাদারীপুর জেলা) মাইজপাড়া গ্রামে ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ সালে। তাঁর পিতার নাম কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায় ও মাতার নাম মীরা গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি জন্মের পর মাত্র চার বছর বয়সেই পিতামাতার সাথে কলকাতায় চলে যান। সেখানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ, দমদম মতিঝিল কলেজ ও সিটি কলেজে লেখাপড়া করেন। কলেজের পাঠ চুকানোর পর ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি নেন। এরই মধ্যে লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ততা গড়ে ওঠে সুনীলের। তবে এর পেছনেও আছে একটা গল্প। ছাত্র জীবনে সুনীলের পিতা তাকে টেনিসনের একটা কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বলেছিলেন, প্রতিদিন এখান থেকে দুটি করে কবিতা অনুবাদ করবে। এটা করা হয়েছিল এই জন্য যে, তিনি যেন দুপুরে বাইরে যেতে না পারেন। বন্ধুরা যখন সিনেমা দেখত, বিড়ি ফুঁকত, সুনীল তখন পিতৃ-আজ্ঞা শিরোধার্য করে দুপুরে কবিতা অনুবাদ করতেন। অনুবাদ একঘেয়ে হয়ে উঠলে তিনি নিজেই লিখতে শুরু করেন। মূলত সেই থেকে লেখালেখির জগতে হাতেখড়ি নেন। ১৯৫৩ সাল থেকে তার সম্পাদনায় প্রকাশ হতে থাকে সাহিত্য পত্রিকা কৃত্তিবাস। আর এই পত্রিকাই পরবর্তীতে হয়ে ওঠে নতুন কাব্যধারার অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সেই সময় ভারতে ‘হাংরিয়ালিজম’ নামের সাহিত্য আন্দোলনে যারা যুক্ত হয়েছিলন, সুনীল ছিলেন তাদেরই একজন। ১৯৫৪ সালে স্নাতক ডিগ্রি নেয়ার পর ইউনেস্কোর বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্পে কাজ শুরু করলেও মাত্র তিন মাসের মাথায় তিনি সেখানে ইস্তফা দেন। ওই বছরই নিউ ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্স কোম্পানিতে ট্রেইনি অফিসার হিসেবে যোগ দিলেও কিছু দিনের মধ্যেই কাজের ধরণ পছন্দ না হওয়ায় সেটাও ছেড়ে দেন। এরপর শুরু হয় প্রাইভেট টিউশনি। টিকে থাকার সংগ্রামে দীর্ঘদিন ছাত্র পড়িয়ে উপার্জনই ছিল তাঁর একমাত্র আয়ের উৎস। এরপর ১৯৭০ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় সাব-এডিটর হিসেবে সাংবাদিকতার জীবন শুরু হয় এই কথাশিল্পীর। সর্বশেষ তিনি ‘দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে স্বাতী বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ওই বছরই তাদের একমাত্র সন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম।
কবিতা ছিল তার প্রথম প্রেম, তবে অনেক বেশি পাঠকপ্রিয় হয়েছেন কথাশিল্পের ‘জাদু’ দেখিয়ে। পেশায় ছিল সাংবাদিকতা, লিখতে হয়েছে প্রবন্ধ-কলাম। এক জীবনে যখন যাই করেছেন, কবিতাই ছিল সুনীলের অনেকটা জুড়ে। সে কথা তিনি লিখে গেছেন তাঁর কবিতায়। সুনীল বলেছেন, ‘শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম/ শুধু কবিতার জন্য কিছু খেলা/ শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা/ ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য।’ কবিতাকে মানুষের মুখের ব্যবহারের ভাষার কাছাকাছি নিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিরন্তর চেষ্টা করেছেন। প্রেম, বিরহ, হৃদয়ের জটিলতা, আবেগ, উচ্ছ্বাস, প্রকৃতি ও সময়ের সমস্যাগুলো তুলে ধরেছেন তিনি তার কবিতায়। ইতিহাস এবং ইতিহাসের নানা ঘটনাকে আশ্রয় করে সুনীলের লেখনী শুধু পাঠক হৃদয়কেই আন্দোলিত করেনি, সমাজ সচেতনতাও তৈরি করেছে ব্যাপক পরিসরে। তাই বাংলার আকাশে, পূর্ব-পশ্চিমে সুনীল চিরদিন উজ্জ্বল থাকবেন। তাঁর রক্তে যেন কেউ প্রেমের বীজ বুনেছে কৈশোরেই। জীবনে আসা প্রেমিকাদের কথা লিখেছেনও নানাভাবে। নীরা তো মিথ হয়ে আছে সুনীল সাহিত্যে। নীরাকে নিয়ে তাঁর আবেগ ও উচ্ছ্বাসের কোন কমতি ছিল না। নানাভাবে তাঁর সেই আবেগ ও উচ্ছ্বাসের প্রকাশ করতে তিনি লিখেছিলেন, ‘নীরার অসুখ/ নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে/ সূর্য নিভে গেলে পর, নিয়নের বাতিগুলি হঠাৎ জ্বলার আগে জেনে নেয়/ নীরা আজ ভালো আছে?’ এছাড়াও ‘মিনতি’ কবিতায় কবি প্রেমিক ও প্রেমিকার সম্পর্ককে অমলিন রাখার জন্য প্রকৃতির কাছে আহবান জানিয়েছেন। প্রেমিকা যখন তার প্রেমিকের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে, তখন ঝড়-বৃষ্টির আগমনে পরিবেশ যেন কলুষিত না হয়। একটা বিষয় পরিষ্কার, কবির প্রগাঢ় মানবতাবোধ ছিল। ‘উত্তরাধিকার’ কবিতায় কবি গরিব পরিবার ও রাস্তায় বাস করা অসহায় শিশুদের প্রতি তাঁর অপার স্নেহ ব্যক্ত করেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি উত্তরাধিকার নামক উপন্যাসও রচনা করেছেন। তিনি তাঁর কথা রেখে গিয়েছিলেন পাঠকদের কাছে কিন্তু অগত্যা কথা না রাখার অনেক অভিযোগ ছিল সুনীলের মনে। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই শুরু করে সারাটা জীবন জুড়ে তাঁর মনে অনেক কিছুই না পাওয়ার হতাশা ছিল। সেই হতাশা থেকেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’। এই কবিতার শেষাংশে ব্যর্থ প্রেমিকের অনুযোগে লিখেছিলেন, ‘বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল/ যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে/ সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!/ ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি/ দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়/ বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম/ তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ/এখনো সে যে-কোনো নারী/ কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলোর মধ্যে ‘সুন্দরের মন খারাপ’, ‘মাধুর্যের জ্বর’, ‘সেই মুহূর্তে নীরা’, ‘স্মৃতির শহর’, ‘সুন্দর রহস্যময়’, ‘আমার স্বপ্ন’, ‘আমি কি রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘ভালোবাসা খ-কাব্য’, ‘নীরা হারিয়ে যেও না’, ‘অন্য দেশের কবিতা’, ‘ভোরবেলার উপহার’, ‘সাদা পৃষ্ঠা তোমার সঙ্গে’, ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ কাব্যগ্রন্থগুলো এখনো পাঠকপ্রিয়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তিনি আলোচনায় চলে আসেন। প্রথম উপন্যাসেই সাহিত্য অঙ্গনে ও পাঠকমহলে সাড়া ফেলে দেন। আক্রমণাত্মক ও সোজাসাপ্টা কথা বলার ঢংয়ের কারণে সে সময় বেশ বিতর্কের জন্ম দেয় এই উপন্যাস। সুনীল পরে নিজেও স্বীকার করেন, বিতর্কের মাত্রা দেখে আতঙ্কে তিনি কয়েক দিন কলকাতার বাইরেও কাটান সে সময়। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র তরুণ ‘সুনীল’ একজন ভবঘুরে। কলকাতায় বেড়ে ওঠা এই ব্যতিক্রমী চরিত্রের তরুণকে ঘিরেই গড়ে ওঠে উপন্যাসের জমিন। নীললোহিত, নীল উপাধ্যায় আর সনাতন পাঠক ছদ্মনামে লিখেছেন অসংখ্য গল্প, উপন্যাস ও নাটক। তবে তাঁর নীললোহিত ছদ্মনামটিই বেশি বিখ্যাত। নীললোহিত নামে তিনি যে উপন্যাস বা গল্পগুলো লিখেছেন, সেগুলোর অধিকাংশের নায়ক নীললোহিত নামে সাতাশ বছরের এক তরুণ। যার পায়ের তলায় শক্ত মাটি নেই, অনিশ্চিত তার ভবিষ্যত ও গন্তব্য। সে জীবনকে দেখে খোলা চোখে, খোলা মনে। অনেকেই হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত হিমু চরিত্রের সাথে নীললোহিতের মধ্যে কিছুটা সাদৃশ্য খুঁজে পান। আবার কেউ কেউ বলেছেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীললোহিত চরিত্রটি থেকেই হুমায়ূন আহমেদ হিমু চরিত্র সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত হন। তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং বাঙালি জাতির প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা পালন করেছেন অনন্য চারটি ক্ল্যাসিক উপন্যাসের মাধ্যমে। ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’, ‘একা এবং কয়েকজন’ এবং ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাসের মূল পটভূমি পশ্চিম বাংলা হলেও বাঙালির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের ধারা এতে পরিস্ফূট হয়েছে। তাঁর ‘সেই সময়’ উপন্যাসে ১৮৩০-১৮৭০, ‘প্রথম আলো’তে ১৮৭০ থেকে বিশ শতকের প্রথম দশক, ‘একা এবং কয়েকজন’- এ ১৯২০-১৯৫০/৫২ এবং ‘পূর্ব পশ্চিম’-এ ১৯৫০-বিশ শতকের আশির দশকের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। চারটি উপন্যাসেরই মূল নায়ক সময়। সময়ের গতিতে ক্রমপরিবর্তনশীল সমাজ উপন্যাসগুলোর মূল উপজীব্য। একা এবং কয়েকজন ছাড়া অন্য তিনটি উপন্যাসে ইতিহাসখ্যাত মানুষরা এসেছেন উপন্যাসের চরিত্র হয়ে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাভাষী পাঠকের হাতে উপহার দিয়েছেন ক্ল্যাসিক সাহিত্য থেকে তুলে আনা কয়েকটি কাহিনীর নিজস্ব ভাষ্য। প্রাচীন কাহিনীর সৌরভ সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন রেখে তিনি তাতে দিয়েছেন ভিন্ন ব্যঞ্জনা। এই ধারায় লেখা তার উল্লেখযোগ্য বই হলো, ‘রাধাকৃষ্ণ’, ‘শকুন্তলা’, ‘স্বপ্ন বাসবদত্তা’ ও ‘সোনালি দুঃখ’। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈনিক নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকে নিয়ে সুনীল লেখেন ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী’। ঐতিহাসিক পটভূমি নিয়ে ‘শাজাহান ও তার নিজস্ব বাহিনী’ এবং ‘আলোকলতার মূল’ নামে দুটি গল্পগ্রন্থও রচনা করেছিলেন। ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ ও ‘রাশিয়া ভ্রমণে’ তুলে এনেছেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। সুনীলের বিখ্যাত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। আর লালনকে নিয়ে লেখা সুনীলের ‘মনের মানুষ’ এর চলচ্চিত্রায়ন করেছেন গৌতম ঘোষ। অপর্ণা সেনের ‘ইতি মৃণালিনী’ চলচ্চিত্রে গান হয়ে দর্শকের কানে বাজে সুনীলের কবিতা ‘স্মৃতির শহর’। কাকাবাবু সিরিজের দুটি কাহিনী নিয়েও চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে।
ভারতের জাতীয় সাহিত্য আকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর আকাদেমির সভাপতি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সাহিত্যে সার্থকতার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮২ সালে বঙ্কিম পুরস্কারের পাশাপাশি ১৯৭২ ও ১৯৮৯ সালে দুই বার আনন্দ পুরস্কার পান। ২০১১ সালে দ্য হিন্দু লিটারেরি পুরস্কারসহ জীবনভর বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন সুনীল। বরেণ্য এই কথা সাহিত্যিককে ২০০২ সালে অতি সম্মানজনক পদ ‘কলকাতার শেরিফ’ হিসাবে নিয়োগ দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সুনীল নানাভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছেন। বাংলাদেশ-ভারতের নানা ইস্যুতে সুনীল বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছিলেন। এমনকি তার মুখে ভারত সরকারের প্রতি উচ্চারিত হয়েছে, ‘বাংলাদেশ যা চায়, তা-ই দিয়ে দাও’। এ থেকে বোঝা যায় তিনি বাংলাদেশের কতো বড় স্বজন ছিলেন। ২৩ অক্টোবর ২০১২ সালে হৃদযন্ত্রজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পশ্চিম বঙ্গ সরকারের ব্যবস্থাপনায় ২৫ অক্টোবর তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
এই কথাটা আমাদের জন্য নির্মম বাস্তব সত্য, তিনি আমাদের মাঝে আর নেই। সুনীল বিহীন সাতটি বছর কেটে গেছে চোখের পলকে। তবে তাঁর অনন্য সৃষ্টি গুলোর মাঝে আমরা তাঁকে বারবার ফিরে পাই। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ, ঢাকা