ধারাবাহিক উপন্যাস : অনিঃশেষ অন্ধকার : আবুল কালাম আজাদ : পর্ব : ০১




অনিঃশেষ অন্ধকার
আবুল কালাম আজাদ



এক.
সে বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান।
বাবা উকিল। উকিল হিসাবে মোটামুটি নাম কামিয়েছেন। উকিলদের ব্যস্ত জীবনের কথা সবারই জানা। আর এই উকিলের ব্যস্ততা যেন আরও একটু বেশি। তার মূল ঠিকানা কোর্ট আর চেম্বার। বাসায় যান শুধু ঘুমাতে। কোর্ট বা চেম্বারে যদি ঘুমানোর ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে তার বাসায় যাবার কোনো দরকারই হতো না।
মা সরকারি চাকুরে। নয়টা-পাঁচটা অফিস। অফিস থেকে ফিরে অনেকটা সময় তিনি ক্লান্ত।
তবে একমাত্র মেয়ের প্রতি তাদের যথেষ্ট কেয়ার আছে। সাজানো-গোছানো একটা রুম দিয়েছেন মেয়েকে। ভালো পোশাক-আশাক, ভালো খাবার-দাবার। শিক্ষা সামগ্রী না চাইতেই হাজির। কোচিং বা শিক্ষকের বাসায় ঘুরে পড়তে গেলে সময় নষ্ট হবে, তাই অধিক টাকায় একাধিক গৃহ শিক্ষক রেখেছেন। বাসার কুটোটাও তাকে নাড়তে হয় না। বলা যায়, কাজের মেয়েটা সব সময় তার সেবায়ই নিয়োজিত।
একটা জিনিস দেয়া বাকি ছিল মেয়েকে। সেটা হলো সেলফোন। মেয়েও এ ব্যাপারে কিছু বলেনি কখনো। একটা ঘটনার পর বাবা-মা বুঝতে পারেন, একটা সেলফোন ছাড়া এই আধুনিক যুগে একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে চলা নিরাপদ নয়। বিশেষ করে বাবা-মা যখন কর্মজীবী।
তখন সে ক্লাশ নাইন-এ। স্কুল ছুটি হয়েছে। সে গেটের বাইরে অপেক্ষা করছে কাজের মেয়েটার জন্য। কাজের মেয়ে কুলসুম বয়সে তার চেয়ে তিন/চার বছরের বড় হবে। সে সকালে তাকে স্কুলে রেখে বাসায় ফিরে যায়। বাসার কাজ-কর্ম সেরে আবার তাকে নিতে আসে।
আমাদের রাজনৈতিক আপদ সেদিন গিয়ে উঠে তাদের স্কুলের সামনে। সেদিন স্কুল গেটের অদূরে রাস্তায় পর পর দুইটা ককটেল ব্লাস্ট  হয়। লোকজন এলোমেলো ছুটতে থাকে। সেও ভয় পেয়ে ছুটে যায় এক গলির মধ্যে। কুলসুম সেখানে গিয়ে তাকে আর পায় না। উপরন্ত লোকজনের ছুটোছুটি আর পুলিশের আগমন দেখে কুলসুম নিজেও ভয় পেয়ে যায়। ভয় পেয়ে ছুটে পালায় অন্য এক গলিতে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে বেশ একটু সময় লাগে। কিন্তু পরবর্তীতে সে কুলসুমকে খুঁজে পায় না, কুলসুমও খুঁজে পায়না তাকে। নিজের কাছে ফোন না থাকায় সে যোগাযোগ করতে পারে না বাবা-মায়ের সাথে। সে খুব ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়ে। মূলতঃ এরকম বিরূপ পরিবেশের মুখোমুখি সে এর আগে আর কখনোই হয়নি। সে স্কুল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হা-হুতাশ করতে থাকে। স্কুলের দারোয়ান তার বাবা-মাকে ফোন করে ঘটনা অবহিত করে।
বাবা-মা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, মেয়েকে সেলফোন কিনে দেবেন, যাতে ইমার্জেন্সি যোগাযোগ করা যায়। আর ফোন যখন দেবেনই, তখন ভাল দেখেই দেয়া যাক। মেয়ে লেখাপড়ার অবসরে সময় কাটাতে পারবে। একা থাকে সারাদিন। নামি কোম্পানীর দামী একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিলেন মেয়েকে। ফোনটার পেছনে আধ খাওয়া একটা আপেলের ছবি।
ক্লাশ নাইন-এর পুরো সময় ফোনটা প্রায় অব্যবহৃতই থেকেছে। বাসায় পড়ে থাকতো তার টেবিলের উপর, আর স্কুলে ব্যাগের ভেতর। বন্ধুদের অনেকে জানতোই না যে, তার পার্সোনাল সেলফোন আছে। সে স্কুলে থাকার সময় ফোনটা বাজতো কালে-ভদ্রে। ফোন আসে দুইটা মাত্র নাম্বার থেকে।
হয়তো বাবা জানতে চাইলেন, স্কুল ছুটি হয়েছে মা?
মাত্রই ছুটি হলো বাবা।
কুলসুম গেছে ?
জি বাবা।
রিকশা পাচ্ছো তো ?
জি বাবা, অনেক রিকশা। রিকশাওয়ালারা সামনে এসে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে-আফা, আসেন, কই যাইবেন আফা ? আমারটায় আসেন। বাবা, ওরা এমন করে কেন? আমার দরকার পড়লে তো আমিই ওদেরকে ডাকবো।
এটা কম্পিটিশনের যুগ মা। সবাই আগে যেতে চায়। ওরা যেমন প্যাসেঞ্জার নিয়ে টানাটানি করে, আমরাও তেমন মক্কেল নিয়ে টানাটানি করি। তুমি দেখে-শুনে বাসায় যেও।
আচ্ছা বাবা।
বাসায় থাকলেও সেই দুই নাম্বারের কোনোটা থেকেই ফোন আসে।
হয়তো মা ফোন করেছেন, বাসায় ফিরেছো মা?
জি মা।
কোনো সমস্যা হয়নি তো ?
না মা, কোনো সমস্যা হয়নি।
খাওয়া-দাওয়া করেছো ?
¬জি মা, কুলসুম মাংসের মধ্যে এত মরিচ দিয়েছে যে, ঝালে আমার নাক-মুখ জ্বলে যাবার অবস্থা। এখনও মুখ দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দ বের হচ্ছে। তুমি কি শুনতে পাচ্ছো মা ?
ওকে এত করে বলি তরকারিতে ঝাল কম দিতে, তাও শিক্ষা নেয় না। আচ্ছা, আজ আবার বকে দিবো।
কখনও কখনও কুলসুম এসে পড়ে। সে টান দিয়ে ফোন নিয়ে বলে, আফায় মিছা কতা কইছে আম্মা। খাওয়ার সময় আমারে কি গাইলই না দিলো-বাসায় মরিচ নাই? তুই রান্নার সময় মরিচ দিস না কেন?
মা কুলসুমকে আদোর মাখা কন্ঠে বলেন, এই বোকা মেয়ে, আমি কি তোকে এ ব্যাপারে কিছু বলেছি কখনো?
রোজ রোজ মিছা কতা কইবো ক্যান? মিছা কতা কইলে হায়াত কাটা যায়।
ফোনে কথা বলার কিছু থাকে না তো তাই।

দুই।।
ক্লাশ টেন-এর প্রথম থেকেই তার ফোনটা অধিক ব্যবহৃত হতে শুরু হলো। তখন বন্ধুদের কাছ থেকে প্রায়ই এটা-ওটা জানার দরকার হয়। ক্লাশ টেস্ট, মডেল টেস্ট, সাজেশন ইত্যাদির ব্যপারে কথা বলতো সে। আর তখন সে নিজেও বুঝতে পারলো, আধুনিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটা সত্যিই খুব দরকারি। সে যখন ইংরেজি রচনা ‘গিফট অব মডার্ন সায়েন্স’-এ পড়তো-মডার্ন সিভিলাইজেশন ইজ দ্যা গিফট অব সায়েন্স, তখন তার চোখ চলে যেতো ফোনটার দিকে। মডার্ন সিভিলাইজেশনের অন্যতম একটা অংশ সেলফোন। সেলফোন ছাড়া দ্রুত কমিউনিকেশন অসম্ভব।
বন্ধুদের পেরিয়ে তার নাম্বারটা যেতে থাকল আত্মীয়-পরিজনের কাছে। সে প্রায়ই মামা-মামী, খালা-খালু, চাচা-চাচী এদের সাথে কথা বলত। সমবয়সী কাজিনদের সাথেও কথা বলত।
এক রাতে ফোন করল এক কাজিন। তার বড় খালার বড় ছেলে। নাম নিলয়। সে জেলা শহরে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। নিলয়ের ফোন পেয়ে সে অবাক হল খুব। কেননা, সে তাকে ফোন নাম্বার দেয়নি। কাউকে ফোন নাম্বার না দিলেও যে তার নাম্বারটা কারও কাছে চলে যেতে পারে, সেটা বোধহয় সে জানত না।
নিলয় বলল, সুমাইয়া, তুমি যে ফোন নিয়েছো তা আমাকে একবারও জানালে না ?
আমি তো আপনার নাম্বার জানতাম না নিলয় ভাই।
জানার ইচ্ছা থাকলেই জানতে পারতা। আমি তোমার নাম্বার জানলাম কিভাবে?
সরি নিলয় ভাই, এক্সট্রামলি সরি, আপনি কেমন আছেন নিলয় ভাই ?
ভাল, তোমার লেখাপড়া ভাল চলছে তো ?
হ্যাঁ, খুব ভাল চলছে। আশা করি জিপিএ ফাইভ পাবোই পাবো।
তা তো পেতেই হবে, নাহলে ভাল কলেজে চান্স পাবা না। ভাল কলেজে চান্স না পেলে ইন্টারেও ভাল রেজাল্ট হবে না। তখন বুঝবা কত গমে কত আটা, কত আটায় কত রুটি। কত আখে কত গুড়, কত গুড়ে কত শরবত।
মানে?
আমাকে দেখতেছো না? ঢাকায় ভাল কোনো কলেজে চান্স পেলাম না বলে ইন্টারেও ভাল রেজাল্ট হল না। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলাম না। এসে ভর্তি হলাম জেলা শহরের এই কলেজে। কলেজ মানে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সেশন জটের এই নৌকা শেষ পর্যন্ত ঠেলতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। সুযোগ খুঁজছি, অষ্ট্রেলিয়া চলে যাব।
সেশন জট কি নিলয় ভাই ?
এখন বুঝবা না, কলেজ শেষ করো তারপর বুঝবা সেশন জট কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি। লেখাপড়া ছেড়ে দিবা তবু ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাইবা না। কারণ, লেখাপড়া শেষ করে দেখবা বিয়ার বয়স নাই।
হি-হি-হি। আপনি সব সময় মজা করে কথা বলেন নিলয় ভাই।
আমি তো মজার লোক।
সত্যিই আপনি অনেক মজার লোক।
আচ্ছা, ফোন নিয়েছো যখন, তখন মাঝে মাঝে ফোন-টোন দিও।
দিবো, আপনিও দিয়েন।
আচ্ছা, আমি দিবো। কিন্তু তুমি কি সব সময় ফোন দিতে পারবা?
কেন পারব না নিলয় ভাই?
তোমার ফোনে যদি ব্যালেন্স না থাকে?
আমার ফোনে সব সময় ব্যালেন্স থাকে নিলয় ভাই।
শোন, তোমার ফোনে সব সময় আমিই ব্যালেন্স দিয়ে দিবো।
না না, আপনি কেন আমার ফোনে টাকা দিবেন?
অসুবিধা কি? আমি তোমার খালাতো ভাই না? তোমার প্রতি কি আমার কোনো দায়িত্ব নাই? ক্লাশ টেন-এ উঠেছো। স্কুলের সবচেয়ে বড় ক্লাশ। এখন নিজেও বেশ কিছুটা বড় হয়েছো। এটা-সেটা কেনার দরকার পরে না? আমি ফোনের ব্যালেন্স দিলে খালা-খালু যেটা দিবেন সেটা দিয়ে নিজের মতো কিছু কিনতে পারবা।
আমার যা দরকার হয় চাইলেই তা পাই।
তারপরেও.....। শোন, আসল কথা তো বলাই হয় নাই। গত মাসে আমি বাইক কিনেছি। দাম দুই লাখ আশি হাজার। প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাই, বাসে ঝুলে বাড়ি যাওয়া যায় বলো? বেড়াতে এসো, বাইকে করে ঘুরাবো। সবাই বলে, আমি খুব রিস্কি বাইক ড্রাইভার। বাইক যখন চালাবোই তখন অতো পুতুপুতু করে লাভ আছে বলো?
পুতুপুতু কী নিলয় ভাই?
তোমার পুতুপুতু বোঝার দরকার নাই। সত্যি কথা হল, জন্মিলে মরিতে হইবে।
তাই বলে সাবধানে চালাবেন না ?
সাবধানীরা মরে বেশি। আমার চাচাকে চোনো না ? জনমের সাবধানী। ব্যবসা করবেন, রিস্ক নেবেন না। দশ হাজার টাকা ইনভেস্ট করতে বুক কাঁপে। তার লাভ কত হবে বলো? আর আমার বাপজান? নো রিস্ক নো গেইন-এই থিমের ওপর ব্যবসা করে যাচ্ছেন। এখন তার বড় ভাইকে ত্রেত্রিশ বার কিনতে পারবেন। আমি সেই বাপের ছেলে। এখন রাখি। মন দিয়ে লেখাপড়া করবা। এ ব্যাপারে কোনো রিস্ক নিতে যেও না যেন।
নিলয় বড়লোক বাপের একমাত্র সন্তান। গ্রামের হাট-বাজারে তার বাবার নানারকম ব্যবসা। গ্রামের হাট-বাজার ছাড়িয়ে জেলা শহরেও তার বাবার ব্যবসার বিস্তৃতি ঘটেছে।
এরপর থেকে প্রতি রাতেই নিলয়ের সাথে তার কথা হয়। অপ্রয়োজনীয় কথা। খুনসুটি। হাসাহাসি। ব্যপারটা তার কাছে যেমন মজার তেমন আনন্দের। ফোনে কথা বলার মধ্যে যে এতটা আনন্দ, এতটা ভাল লাগা আছে সে তা আগে বুঝতে পারেনি।
রাত বারোটা বাজলেই সে পড়ার টেবিল থেকে উঠে যায়। গিয়ে বসে খাটের কোণায়। পিঠের নিচে একটা বালিশ গুজে দেয়। কোলের পড়ে টেনে নেয় একটা। তারপর অপেক্ষা করে নিলয়ের ফোন আসার জন্য। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিলয়ের ফোন এসে যায়। কথা চলে রাত একটা কি দেড়টা পর্যন্ত। কত কথা!
চুপচাপ টাইপের মেয়েটার মধ্যে যে মধুর স্বরে এত মধুময় কথা লুকানো ছিল নিলয় তা কল্পনাও করতে পারেনি। নিলয়ের কথাই বা কি বলবো, নিজের কথার পরদর্শীতায় সে নিজেই অবাক হতে থাকে। সে মনে মনে ধন্যবাদ দেয় ফোনটাকে। ফোনটা না থাকলে সে জানতেই পারতো না যে, সে এত সুন্দর করে এত কথা বলতে পারে।
প্রথম মিথ্যা বলা।
বাবা বললেন, তুমি কিন্তু বেশ কিছুদিন হলো তোমার ফোনের জন্য টাকা নিচ্ছো না। ফোনে কি টাকা আছে?
জি না বাবা।
কেন নেই ? ইমার্জেন্সি প্রয়োজনে ফোন করবে কিভাবে? মনে করো, স্কুল থেকে ফেরার সময় পথে এ্যাটম বোমা ব্লাস্ট হলো, লোকজনের ছুটোছুটি, রিকশা পাচ্ছো না। তখন........?
এ্যাটম বোমা! স্কুলের পথে এ্যাটম বোমা ব্লাস্ট হবে কেন?
এ্যাটম বোমা বলেছি? প্যাট্রল বোমা বলতে গিয়ে এ্যাটম বোমা বলে ফেলেছি। শোন, এরকম করবে না বুঝলে। সব সময় ফোনে ব্যালেন্স রাখবে।
বাবা মানি ব্যাগ খুলে পাঁচশ টাকার একটা নোট তার হাতে দিলেন। টাকাটা নেবার সময় তার হাত একটু কেঁপেছিল। তার মনে পড়েছিল, তার ফোনের ব্যালেন্স তখনও ৫৫০ টাকা। নিলয় গতকালও ৫০০ টাকা পাঠিয়েছে।
পরদিন সে স্কুলে গিয়ে প্রিয় বন্ধুদের নিয়ে ফুসকা আর লাচ্ছি খেল। তারপরও কিছু টাকা তার হাতে থাকল।
স্কুল থেকে ফেরার পথে সেই প্রথম তার স্কুল থেকে অন্য কোথাও যাওয়া। স্কুলের পাশেই একটা শপিংমল। সে কুলসুমকে বলল, তুই সব কাজ শেষ করে এসেছিস তো?
কাম ফালায়া আবার কবে আইলাম ?
তাহলে চল, একটা নেইলপলিশ কিনে নিয়ে আসি।
আপনের ক্ষিধা লাগে নাই ?
না, আমি ফুসকা আর লাচ্ছি খেয়েছি।
তায়লে লন যাই।
শপিংমলে কয়েকটা দোকান ঘুরে সে হালকা খয়েরি রঙের একটা নেইলপলিশ কিনলো। নেইল পরিস্কার করার জন্য একটা রাবার কিনলো।
বাসায় ফিরে বিকেলে বারান্দায় বসে খুব যতœ করে রাবার দিয়ে ঘষে ঘষে নেইল পরিস্কার করল। নেইলগুলো একেবারে চকচকে হয়ে উঠল। তারপর চকচকে নেইলগুলোতে সে নতুন কেনা নেইলপলিশ লাগাল। নেইলপলিশ লাগাতে লাগাতে ভাবল, মাঝে মাঝে এভাবে কিছু টাকা নিলে মন্দ হয় না। বন্ধুদের সাথে মজা করে খাওয়া যায়, এটা-ওটা কেনাও যায়।
তারপর থেকে তার মিথ্যা বলতে আর ঠোঁট কাঁপে না। মিথ্যা বলে টাকা নিতে আর হাত কাঁপে না। সে নিজেকে বোঝায়-বাবা-মা-ই তো। সে তো আর অন্যের পকেট থেকে টাকা চুরি করছে না।
সকালে বাবার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নেয়। বিকেলে বাবার অনুপস্থিতিতে মায়ের কাছ থেকে নেয় ৫০০ টাকা। যাতায়াত খরচ থেকে টাকা বাঁচে। টিফিন খরচ থেকেও বাঁচে। তারপরও কলম, খাতা, ইন্সট্রুমেন্ট বক্স ইত্যাদি কেনার কথা বলে প্রায়ই টাকা নিতে থাকে। বাবা-মা এ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামান না। মেয়ে বড় হচ্ছে। এস.এস.সি পরীক্ষা দেবে। নিজের টুকটাক দরকারি জিনিস সে কিনতেই পারে।
দেখা যায়, তার হাতে সব সময় ভাল পরিমাণ টাকা থাকে। এ পরিমাণ টাকা তার ক্লাশে আর কারও হাতেই থাকে না। আগে তার বন্ধু ছিল গুটি কয়েক। রাতারাতি ক্লাশের সবাই তার বন্ধু হয়ে যায়। সে হয়ে যায় ক্লাশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেয়ে। সে এই জনপ্রিয়তাকে খুব উপভোগ করে। সে এটা ধরে রাখতে চায়। তাই প্রায় প্রতিদিনই একে-ওকে নিয়ে খাবার দোকানে, শপিংমলে তাকে যেতে হয়।
কাজের মেয়ে কুলসুম তার সঙ্গী থাকে। তার প্রথম প্রথম ভয় হতো, কুলসুম আবার বাবা-মাকে কিছু বলে দেয় কিনা। কিন্তু না, কুলসুম বিশ্বাসঘাতক না। অথবা সে বিশ্বাসঘাতক হতে সাহস পায় না। পাছে আবার নিজেই বাড়তি কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে যায়। সে কুলসুমের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়। মনে মনে ভাবে, মাঝে মাঝে কুলসুমকেও কিছু দেয়া উচিত।
একদিন বলে, তুই কিছু কিনতে চাস কুলসুম?
আমি আবার কি কিনুম ?
কিনতে চাইলে বল, কিনে দেবো।
আমি কি আপনের নাহাল নেলপালিশ, লিপিসটিক মাখি নাকি ?
আহ! অন্য কিছু কিন। কত কিছুই তো আছে কেনার মতো। 
দিতে চাইলে একটা জিনিস দিতে পারেন।
কী জিনিস বল ?
আফনের বন্দুগো সামনে..........।
তুই কি বোমা বা ককটেল জাতীয় কিছু কিনতে চাস যে, ওদের সামনে বললে ওরা পুলিশকে খবর দেবে?
না মানে...........।
মানে-টানে বাদ দে’। ওরা কি ছেলে মানুষ? অতো ভনিতা না করে যা বলার বলে ফেল ?
আম্মা আর চাচাজান সবই দেয়, খালি একটা জিনিস দেয় না। চাচাজানের কাছে তো আর সেইটা চাওয়া যায় না। আম্মারও খেয়াল হয় না। খালি জামা পড়ি, কেমন ঢলঢল করে.....।
বুঝেছি, চল কিনে দেই।
দোকানে যেতে যেতে সে বলল, তোর সাইজ কত জানিস ? আমার তো ৩৪।
আমারও মনে হয় তাই হইবো।
বললি এক কথা। তোর ৪০ এর কম না।
পরে দেখা গেল কুলসুমের সাইজ ৪২। কুলসুমের জন্য ৪২ সাইজের ২টা ব্রা কেনার পর সে নিজের জন্যও ৩৪ সাইজের ২টা কিনলো। যখন সে ৪টার দাম দিতে যাবে তখন কুলসুম বলল, আফা, ২ প্যাকেট মোনালিসা নিয়া যান।
মোনালিসা কি?
আপনে দেখি কিছুই বোঝেন না।
তোর কথা সব বোঝা যায় না। ভাল করে বল।
আপনের তো ৩/৪ দিনের বেশি থাকে না। আর আমার শুরু হইলে ৭ দিনের আগে যায় না।
দোকানী মহিলা মুখে মিটিমিটি হাসি টেনে মোনালিসা নামের ২ প্যাকেট প্যাড বের করে দিল। তার বন্ধুদের মুখেও হাসি। একজন বলল, সে আছে সব দরকারি জিনিস কেনার তালে।
[চলবে...]

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট