স্বপ্নের প্রীদিম
শরীফ সাথী
গ্রামের ছেলে ফিনাল। এবার উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন তাঁর দুচোখে। উঁকি দেয় ভবিষ্যতের স্বপ্নের স্বর্ণালী আয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ভর্তিযুদ্ধে রীতিমত নামতে হচ্ছে তাকে। কৌশলী হতে হচ্ছে সর্বদিক দিয়ে। সুদূর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে নতুন চমক আসে তাঁর মনে। শহুরে পরিবেশ তাকে সবকিছুই আপ্লুত করে তুলছে। রেলওয়ে ষ্টেশন যে এতা বড় হয়, সৌন্দর্য কারুকার্য দুচোখকে অন্য জগতে নিয়ে যায়। হোষ্টেলে থাকা অভ্যাস নেই। সিট ভাড়া রুমে একাকী থাকা ঘুমহীন রাত। গ্রামের বাড়িতে মা বাবা ভাইবোন মিলেমিশে একসাথে মহব্বতি থাকা খাওয়া। আর এখানে সঙ্গহীন কেমন কেমন ভীতি ভীতি মনে বেড়ানো, হোটেলে খাওয়া দাওয়া। ভাবনার সাগর অসীম গহীনে ঢেউ তোলে। কী জানি কি হয়? বাবা মায়ের টাকা পয়সা খরচ করে এসে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এলাম। ঠিকমত পরীক্ষা দিতে পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারি এমান আশা ভরসা। মা বাবার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আশা আমাকে নিয়ে। আমাদের ছেলে ফিনাল ভার্সিটি পড়বে? সে এখন ভার্সিটির ছাত্র? বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ করে ফিরেছে... কত না অনুভব অনুভূতি দোলা দেয় হোষ্টেলের বেডে রাত জাগা ফিনালের মনে। পড়াশুনার দিকে খুবই ঝোঁক ফিনালের। উচ্চ শিক্ষিত হবো, মানুষের মত মানুষ হবো। কৃষক বাবা গর্ব করে বলবে, আমার ছেলে ফিনাল ভার্সিটি পড়া শেষ করে শিক্ষিত, ন¤্রভদ্র, সামাজিকতায় গড়া এক জীবন্ত ইতিহাস। ভাবনার অতলে ডুবে থাকা ফিনাল বুঝতেই পারিনি গভীর রাত পেরিয়ে ভোরের আগমনী বার্তা মুয়াজ্জিনের চিরচেনা আযানের কণ্ঠধ্বনী তাঁর কর্ণে ভেসে এলো। বেড থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে পাখির কিচিরমিচির কলতানে বিমুগ্ধ রবির হাসির প্রতীক্ষায় ফিনাল। সকালে খাবার হোটেলে ডাল দিয়ে দুপিচ পরোটা খেয়ে ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্রে উপস্থিত হতেই দেখতে পেল হাজার হাজার পরীক্ষার্থীর উপস্থিতি। মনে সাহস থাকতে ভীতি বিরাজ করছে।
এতো পরীক্ষার্থীর মাঝে টিকবো তো? আমার তো কোন নামীদামি স্বজন নেই। সহযোগিতা কিংবা আশ্বাস দেবার মত কেউ নেই। আশা আর আমার লেখাপড়ার অভিজ্ঞতার ভা-ার অপার করুণাময়ের কৃপা হলে নিশ্চয় ভাল ফলাফলের সৌভাগ্যতা অর্জণ করবো। পরীক্ষা দিয়েই ফিরতে হবে। বেশি দিন থাকা হবে না। থাকলে পদে পদে খরচ। পকেটের দিকে লক্ষ তো রয়েই যায় ফিনালের।
ভালো মত ঠিকঠাক পরীক্ষা দিয়ে ফিনাল ফিরছে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যদিও স্বপ্ন ছিল রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী পদ্মার পাড়, পার্কসহ দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার। ট্রেনে উঠে নিজ আসনে বসে জানালার কাঁচ তুলে বাহিরের প্রকৃতির দৈনন্দিন দৃশ্যের ইচ্ছেগুলো নয়ন ভরে দেখছে ফিনাল। ষ্টেশনে কংক্রিট পাথরের বিস্তৃর্ণ অনুরাগ ছোঁয়ায় একের পর এক রেল লাইন। প্লাটফর্ম গুলোর দিক নির্দেশনা কার কোন দিকে গন্তব্য মাইকিং। আশপাশের বিভিন্ন ভবনের সমাহার। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছাড়তেই সাইড এর খোলা গ্লাচ ক্লোজ করে বসে আনমনে ফিনাল উপরের দিকে তাকাতেই ব্যাগ লাগেজ রাখা হ্যাঙ্গারের তলে লম্বা সুদূর ঝকঝকে গ্লাচ কাচের মাঝে জ্বলজ্বলে পরিচ্ছন্ন হাসিমাখা সুন্দরীর মুখ দেখতে পেল। সম্মুখীন সিট বিশেক দূরের সিটে মেয়েটি সামনাসামনি বসা। গ্লাসের আয়নায় দুজনের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ও হেসে উঠল। ফিনাল মুচকি হাসি দিয়ে লজ্জা বরণ চেহারায় তাকাতেই দেখতে পেলো ওর ঝলমলে মসৃণ ঠোঁটের মাঝে হাসির ফোয়ারা চকচকে গ্লেস বর্ণ দাঁতসমূহ। স্কাট দিয়ে মাথার কেশ কালো লম্বা চুল গুলো ঢেকে মুখম-ল আরও আয়নার সামনে তুলে ধরলো। টেনশনে জর্জরিত ফিনাল সুন্দরী লাবণ্যভরা মায়াবী চেহারার মুখয়ব দেখে তৃপ্তির ছোঁয়া খুঁজে পেলো। অনুভবে আনন্দ অনুভুতির প্রথম যৌবন ফুঁটে উঠল ভালোলাগার অপার বাস্তবতায়। ফিনাল ভাবতেই পারিনি এত দূরে দুজন বসে থাকা সত্ত্বেও মাথার উপরের এই হ্যাঙ্গারের গ্লাস আয়নায় এভাবে দুজন দুজনের দেখে দেখে হেসে হেসে এত দূরত্ব এত সন্যিকটে আসে। ভালোই লাগছে, মন্দ না? সময় কাটছে। ট্রেন চলছে ট্রেনের ছন্দময় গতিতে। মেয়েটির দৃষ্টি নন্দিত নয়নের সুদৃষ্টির কাছে বারবার পরাজিত সৈনিক এর ন্যায় মাথা নিচু করছে ফিনাল। আবার চোখ মেলতেই মুখ অবয়বে ফোঁটা সৌন্দর্যের বাঁধ ভাঙা সীমাহীন তারণ্য দ্বীপ্ত সমুজ্জ্বল মায়াবতীর পরিস্ফুটিত রূপের রঙে চেতনালব্দ জ্ঞান পিপাসু আবেগ ভালবাসার মোহনা খুঁজছে। এত রূপবতী শোভাবর্ধনকারি ফুলেল ছোঁয়া বিমুগ্ধ ধোঁয়া বিস্তারকারি যৌবনবোধের জীবন্ত প্রতিভা প্রকাশ। কই মনে পড়ে না দেখেছে নয়ন কোথাও কি? তুমি কে গো? তোমার হাস্যোজ্বল গোলাপী বরণ, তৃষ্ণার্ত ডাগর আঁখির নীল নয়নাভিরাম পলকহীন দৃষ্টি, প্রেমময়ী বৃষ্টি আভাসে, বাতাসের কুঞ্জনে গুঞ্জনে শিহরিত স্পন্দনে একাকার। মাঝে মাঝে তুলতুলে নরম হাতের টার্চ মোবাইলে খেলা, বহিঃপ্রকাশে আনন্দ মেলা দিচ্ছে দোলা মনে। হৃদপি- কম্পিত হচ্ছে। দুয়ার খুলছে নতুন অধ্যায়ের। ফিনালের ইচ্ছে ছিল রাজশাহী টু চুয়াডাঙ্গা আসার পথে ট্রেনে জানালার ফাঁক দিয়ে বিভিন্ন লোকেশনের চিত্র, মিত্র করবে দুচোখে। একের পর এক ষ্টেশনগুলো নোট বুকে লিপিবদ্ধ করার। মাঠ ঘাট বন বনানী পেরোনো দৃশ্য দেখে দেখে চলন্ত ট্রেনের ঝকঝকাঝক শব্দ দুকর্ণ চেতিয়ে শুনবে। কিছুই হলো না। কখন যে চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে পোঁছে গেল ট্রেন। হুড়োহুড়ি নামার তোড়জোড়। প্লাটফর্মে নেমে পিছে ট্রেন রেখে হাঁটা শুরু করলো ফিনাল। এমন সময় মেয়েটি ঘাড়ে হাত দিল। ফিরে চাইতে মুচকি হেসে মেয়েটি বলল, আমি রিমঝিম। তুমি তো বেশ বসেছিলে ট্রেনে। পরীক্ষা কেমন দিলে?
ফিনাল অবাক চোখে চেয়ে বলল, মুটামুটি। তবে কি হবে জানি না?
রিমঝিম বলল, তোমার রোল নম্বর এবং মোবাইল ফোন নম্বর দাও?
রিমঝিমের হাতে দিতেই রিমঝিমের বাবা ডাক দিল তাড়াতাড়ি আসার জন্য। অম্লান করে চেয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল চোখের আড়ালে। চাওয়াকে অমলিন করে ফিনাল ফিরে এলো গ্রামে।
বেশ অনেক দিন পর হঠাৎ ফিনালের ফোন বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করতেই সুমিষ্ট আবেগী কণ্ঠে ভেসে এলো কেমন আছো ফিনাল?
আলহামদুলিল্লাহ বলতেই মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, ভর্তি হচ্ছো তো? তুমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছো? ভর্তি হতে কবে যাচ্ছো রাজশাহী ফিনাল?
হতবাক হয়ে ফিনাল বলল, রিমঝিম বলছো? সত্যি বলছো?
হ্যা। দেখা হবে ভার্সিটি প্রাঙ্গণে। ভাল থেকো...।