ডুমুরের ফুল
নেহাল অর্ক
আমার স্বামীরে ওরা মাইরা ফালাইছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। তহন কিছু বুঝি নাই; নইলে কী তারে যুদ্ধ করতে দিতাম! আমাগো কি লাভ হইছে কিছু? যা হইবার হেগু হইছে। বলতে বলতে ভগীরথী বাজারে যাচ্ছে। সংসারে আয়-রোজগার নাই; একটা গাভীর দুধ বিক্রি করে কোনোরকম চলছে জীবন। যৌবনের চঞ্চলতাকে সে বিসর্জন দিয়েছে একাত্তরের সাথেই।
মাসি কী নিতে বাজারে এলে? সজল, একজন ব্যবসায়ী, জিজ্ঞেস করতেই ভগীরথী কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের কথা বলে। ভগীরথী তার কাছ থেকেই সওদা করে কখনও নগদ দেয়; কিছুটা বাকিও থাকে। নগদ বাকির দেনা-পাওনার মাঝেই নিঃসন্তান ভগীরথী কখন যৌবন পেরিয়ে স্বামীর ঘর ভালোবেসে দত্তপুর গ্রামে পড়ে আছে তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু তার এই ত্যাগের মূল্য কই? ক’জনই জানে ক্ষুধা আর জীবনের চাহিদা তাকে যে পরাজিত করে দিয়েছে তার কাহিনী? সজল বাবার কাছ হতে ভগীরথীর কাহিনী শুনে চোখের জলও ফেলেছে; কিন্তু এ পর্যন্তই। একদিন দোকানে বসে ভগীরথী বলেছিলো, রেডিওতে শেখ সাহেবের ভাষণে কিভাবে মোহিত হয়ে নবযৌবনের কোল হতে তার স্বামীকে ছেড়ে দিতেও সেদিন কুণ্ঠাবোধ করেনি। এসব গালগল্পের মাঝেই কেউ একজন বললো, সজল কেমন আছো?
স্যার ভালো আছি; বলেই সজল চেয়ারটা এগিয়ে দেয় জব্বার সাহেবের দিকে। উনি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। জব্বার সাহেবকে দেখেই ভগীরথী চলে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একাত্তরের সময়ের কথা বলতে থাকে জব্বার সাহেব। স্যারের মুখের দিকে চেয়ে সজল বলে, লোকমুখে শুনেছি ইদন চাচার ঘরে নাকি অনেক হিন্দু পরিবার স্বাধীনতা সংগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলো? আয়ুব আলীর গোষ্ঠীর লোকজন নাকি পাকিস্তান বাহিনীর কাছে হিন্দুদের সব তথ্য দিতো?
ঠিকই বলেছো সজল; এরা এখনও দাপট নিয়ে চলছে। এইতো কদিন আগে তাদের গোষ্ঠীর লোকজন একটা মেয়েকে ধর্ষণ করে; কিন্তু উল্টো মেয়েকেই শাস্তি পেতে হলো।
ঠিকই বলেছেন স্যার, বলেই সজল ও স্যার ভগীরথী ও সমকালীন ঘটনার পূর্বাপর আলাপ করতে লাগলো; আরও দুএকজন এসে যোগ দিলো। এই আলোচনার শুরু হয়; শেষ হয় না। জব্বার সাহেব বাহিরে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, কেউ একজন বিড়বিড় করে বলে ভগীরথীরা আজ খেতে পায় না ঠিকমতো; অথচ রাজাকার ও তাদের দোসররা আজ রাষ্ট্রীয় সুবিধা কুক্ষিগত করছে। জব্বার সাহেব মাথা নাড়ে আর বলে, নদীর ¯্রােতের মতোই সময়ের ডানায় চড়ে স্বাধীনতা পঞ্চাশ বছরের জন্মের ইতিহাস পেরিয়ে এলো; কিন্তু ক’জন এর সুফল পেলো? ভগীরথীর মতো আরও অনেক দরিদ্র মানুষ বঞ্চনা বুকে ধরে ক্ষুধার আর্তনাদে চটফট করছে। তাদের কাছে স্বাধীনতার সুখ ডুমুরফুলের মতোই দুর্লভ ; যা আজন্মকাল অধরাই থেকে যায়।
হবিগঞ্জ।