অতিথি আসন
শফিক নহোর
রাইপুর বাসস্ট্যান্ডে আমি দাঁড়িয়ে আছি গাড়ির অপেক্ষায়। চোখের পলকে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ালো। আমি পা সামনে বাড়িয়ে দিলাম। তখন একটি অটোরিকশা এসে আমার পথ বাঁধাগ্রস্তকরল। গাড়িটি আর একটু সামনে এগিয়ে গেল। আমি হাত উচিয়ে হেলপারকে ইশারা করলাম। গাড়ি থেমে গেল।
গাড়িতে উঠে একটি অষ্টাদশী মেয়ের চোখে আমার চোখ আটকে গেল । নির্লজ্জ বেহায়ার মতো আমি আবারও তার চোখের দিকে তাকালাম। অবশ্য মেয়েটি তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল।
মেয়েটির মুখোমুখি ছিটে আমি বসে রইলাম। একটু মাথা উঁচু করে তাকালে সোজাসুজি দৃষ্টি চলে যায় মেয়েটির বক্ষে । গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। আমি মেয়েটার পায়ের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম। এবং বুকের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম এবং তার মুখের দিকে তাকালাম। এমনভাবে তাকালাম মেয়েটি বোঝার কথা নয় কিন্তু মেয়েটা অত্যন্ত আধুনিক এবং ট্যালেন্ট মনে হল। আমি অনুভব করতে পারলাম, মেয়েটি আমার তাকানো বুঝতে পেরেছে। দৃষ্টি সংযত করে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।
আমি গাড়ির গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম মেয়েটা আমার দিকে দু'বার তাকিয়েছে, সেই তাকানোর ভেতরে বিরক্ত মিশ্রিত ছিল।
হঠাৎ তার হাতে থাকা মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। মেয়েটি ফোন কেটে দিল। তের সেকেন্ড পর মেয়েটির মোবাইল ফোন আবার বেজে উঠল।
মেয়েটি দ্বিতীয় বার ফোনটা কেটে দিল।
তার পর ফোনের ডাটা অন করে সে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়ল। ডাটা সংযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নোটিফিকেশনের শব্দ শুরু হল। মেয়েটি ফোনের বাটন চেপে সাউন্ড কমিয়ে দিল।
কন্টাক্টর একজন ভাড়া কম দিয়েছে খিস্তি দিয়ে বলে উঠলো,
আগে কইবেন না মিয়া! হুদাই ক্যাচাল করলাম ।
মামা আপনি কই যাইবেন। ভারা দ্যান।
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
সামনে যাবো, পরে দিচ্ছি।
এইযে আপা কই যাইবেন? ভাড়াটা দেন?
মেয়েটি তার কথায় কর্ণপাত না করে মনোযোগ দিয়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে চ্যাট করছে; আমার দৃষ্টি আবারও তার চোখের দিকে আটকে গেল। মেয়েটির চোখের কোণায় শিশিরবিন্দুর মতন জল জমে আছে। এক ফোটা জল গড়িয়ে ফোনের স্ক্রিনে পড়ল।
মেয়েটি তার জর্জেট ওড়না বুকের কাছে হাত দিয়ে টেনে ধরল।
আমার যেখানে নামার কথা সেখানে না নেমে আমি মেয়েটিকে ফলো করতে শুরু করলাম।
মেয়েটির সম্ভবত ডাটা অফ করে ফোনটি ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর রেখে দিল।
জর্জেট ওড়না তার বুক থেকে বারবার বাতাসের সরে যাচ্ছে। সে বারবার নিজের ওড়না ঠিক করছে আর চোখের জল মুছছে।
গাড়ি থেমে গেল শেষ স্টেশনে এসে। ভাড়া দিয়ে নেমে পড়লাম
মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমে একটি ফ্লেক্সিলোডের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো ।
আমি তার শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালাম। তার শরীর দিয়ে মিহি সবরি কলার ঘ্রাণ বের হচ্ছে ।
আমি পিছন থেকে বলে উঠলাম; ভাই আমার নম্বরটা একটু দ্রুত লিখুন ।
মেয়েটি পাশ কেটে বেরিয়ে গেল।
পাশের দোকান থেকে একটি সিগারেট নিয়ে লাইটার দিয়ে অগ্নিসংযোগ করতেই পকেটে থাকা মোবাইল ফোন বেজে উঠল।
আমি হ্যালো হ্যালো বললাম, ওপাশ থেকে কোন সারা শব্দ এলো না। নেটওয়ার্ক সমস্যা ভেবে আমি ফোনটা রেখে দিলাম।
সিগারেট শেষ করে ফোনটা হাতে নিয়ে নম্বরটা ডায়াল করলাম।
একজন বয়স্ক বৃদ্ধ মহিলা তার কণ্ঠ শুনে মনে হল সে হাঁপানি রোগী। কথা বলতে তার সমস্যা হচ্ছে ।
আমি বিনয়ের সাথে তার কাছে জানতে চাইলাম।
আপনি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন? কে বলছেন, কোথা থেকে বলছেন?
সে জোরেশোরে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
দীপা, দীপা দেখ তোকে কে যেন ফোন দিয়েছে।
ফোনের লাইনটি বিচ্ছিন্ন হয়নি আমি প্রত্যাশায় ছিলাম; কেউ একজন হ্যালো বলে উঠুক। অতঃপর কর্কশ গলায় বলে উঠল,
মানুষের আর ফোন দেবার সময় নেই। হুট হাট যখন তখন ফোন দেবে।
ফোনটি হয়তো তখনো মেয়েটির মায়ের হাতেই আছে। এই শব্দটি দূরবর্তী একটি শব্দ হয়ে আমার ফোনে বেজে উঠলো।
হ্যালো কে বলছেন?
আমি রাসেল বলছি,
কোন রাসেল?
তার শেষ বাক্যটি শুনে মনে হল সে বেশ কয়কজন রাসেল নামের ছেলেকে চেনে।
আমি কিছুক্ষণ দম ধরে থেকে তাকে অভয় দিয়ে বললাম,
ভয় পাবার কিছু নেই। আমি রাসেল, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী থাকি। আপনি কোথা থেকে বলছেন?
এ কথা শোনার পর,
মেয়েটি ফোনের লাইন কেটে দিল।
আমি পুনরায় নম্বরটা ডায়াল করে ফোন দিলাম । অযাচিত কণ্ঠে ভেসে আসলো। “আপনি যে নম্বরটিতে ডায়াল করেছেন, এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।”
অযাচিতভাবে মাথার ভেতর ঢেউয়ের প্রলেপ এসে আমাকে জাগিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটির কমল ঢেউ দোলানো শরীরের তক মোহনীয় আবেশ আমাকে ঘিরে ধরলো। মাল্টা আকারের আকর্ষণীয় বক্ষদ্বয়, জোনাকি আলোর মত সে দৃশ্যমান হতে লাগল চোখের সামনে। নিকোটিনের ধোঁয়ায় আমি তার অবয়ব ভুলে অফিসের পথে রওনা দিলাম।
তিনদিন পর আজ আমার অফিস। কাকতালীয় ভাবে বৃহঃপ্রতিবার সরকারি ছুটি ছিল। ব্যাংক তো দু’দিন বন্ধসেটা সবার জানা। হাফ ওয়াল বিল্ডিং, উপরে টিনের ছাওনি গরমের দিনে মনে হয় কেউ গরম বালু শরীরে ঢেলে গিয়েছে। এর ভেতর পানি নেই, রাস্তার কাজের জন্য গ্যাস লাইন বন্ধ। কাজের বুয়া দুদিন এসে ফিরে গেছে । ছুটির এ তিনদিন আমার সঙ্গে ঘটে গেছে বেশ কয়েকটি ঘটনা। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টি হচ্ছে গাড়ির সেই মেয়ে! সে আমার কাছে নামহীন, ঠিকনাহীন থাকলেও আজ সকালে নিশ্চিত হয়েছি, মেয়েটির নাম দীপা ।
ভেতরে ভেতরে একটা অনুভূতি কাজ করল। আমার মুখ দিয়ে দু’লাইন রবী ঠাকুরের সেই বিখ্যাত গানের কথা বের হয়ে আসল।
সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’
অফিসের ডেস্কে আমার সামনে দু’জন দাঁড়িয়ে আছে। আমি চেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে মনিটরে চোখে রেখে কাজ করছি। হালকা একটু মাথা উঁচু করে তাকাতেই একটি মেয়ের আগমন ঘটল। সামনের জনের জন্য তা অদৃশ্য আমি দ্রুত কাজ শেষ করে একজনকে বিদায় দিতেই, পরের জন্য তার ফিক্সড ডিপোজিটের ড্রাপটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
-স্যার আমার টাকা কী আজ তুলতে পারবো?
আমি তার মুখ ও চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।
- টাকা তুলছেন কেন? আপনার নমিনির নাম কি?
- স্যার নমিনির নাম আমার স্বামী ।
- ঠিক আছে, আপনার স্বামী বুঝলাম। তার নাম বলেন।
মেয়েটি আমার কথা শুনে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল। আমি তাকে আবারও তাগাদা দিয়ে বললাম, আপানার স্বামীর নাম বলুন। সে একটু লজ্জা পেয়ে ফিস্ ফিস্ করে বলল, জালাল ।
পরের কাস্টমারের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ উপরে উঠে গেল । আমার গলা শুকিয়ে গেল। হাতের কাছে পানির পট ছিল তা মুখে লাগিয়ে ডক ডক করে পানি খেয়ে নিলাম। মিনি স্ট্রোক রোগীর মত আমার কথা অর্ধেক বের হচ্ছে অর্ধেক আমার গলার ভেতর কাটা ধিঁধে থাকলে যেমন লাগে ঠিক তেমন হতে লাগল। আমি তার মুখের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-কী নাম আপনার?
-দীপা !
- শুধু দীপা?
তার প্রতি উত্তরে কোন জবাব সে দিল না। পাথরের মত আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
- নমিনির নাম বলুন,
-মনিকা দীপা সাহা
- টাকা তুলছেন কেন? রেখে দিলে তো ভালো হতো ।
- আমার ভালো নিয়ে আপনাকে ভাবতে বলেছি ?
মেয়েটি আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে কথাটা যখন বলল, তখন মনে হল কানের ভেতর কেউ গরম লোহার রড ঢুকিয়ে দিচ্ছে । আমি তাকে ইশারা করে ক্যাশ দেখিয়ে দিলাম। সে কতটা সাহস নিয়ে আমাকে এমন করে বলল, আমি শুধু তাই চিন্তা করতে লাগলাম।
অফিস ছুটির পরে সিন্ধান্ত নিলাম আজ দীপাদের বাসায় যাবো । শহরে আসলে কারো বাসায় খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি মিষ্টির দোকান খুঁজতে লাগলাম ।
মনের ভেতর থেকে বলে উঠল, মিষ্টির
চেয়ে ফল নেওয়া সবচেয়ে বেশি ভালো হবে । এক কেজি আঙ্গুর আর এককেজি কমলা কিনে একটা রিকসা নিয়ে সোজা চলে গেলাম। দীপাদের বাসায় ।
পুরনো একটা বাসা আশেপাশের পরিবেশ দেখে মনে হল এখানে অনেক মানুষ আসে । আমি দীপাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল দিলাম। ভেতর থেকে দীপার মা দরজা খুলে আমাকে বলল,
- কাকে চাই?
-এটা কি দীপাদের বাসা ।
-জি!
- আপনি কে?
- আমি রাসেল ।
- এ নাম তো কোনোদিন শুনিনি ।
-তা দীপা তো আজ বাসায় নেই, আপনি দীপাকে ফোন করে আসেনি?
আমার শরীরটা ভালো না, শ্বাস কষ্টটা বেড়েছে। বয়স হলে যা হয় । শরীরে রোগের অভাব নেই। কদিন আর বাঁচব। মেয়েটা খুব চেষ্টা করছে, আমাকে বাঁচানোর ।
আমার হাতের পলিথিন ব্যাগ দীপার মা সামনের ট্রে-টেবিলে রেখে আলাপ শুরু করল, দীর্ঘ আলাপ। এ বয়সে মানুষ কথা বলতে বেশি ভালোবাসে হয়তো।
-প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আপনি কি বাসায় একাই থাকেন?
দীপার মা হেসে বলল,
-একা থাকব কেন? আমার সঙ্গে দীপা থাকে । ওর যেদিন বাহিরে কাজ থাকে সেদিন রাতে আমি একাই থাকি ।
-সরি আপনার মেয়ে কী কোনো জব করেন? মানে গোয়েন্দা বা সরকারি কোনো জব।
-না ।
-তাহলে কীসের জব করে।
-মানুষের সেবা।
-মানে?
-শরীর সেবা।
-সরি আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনার কথা।
-কেন দীপা আপনাকে কিছু বলেনি?
-আমার চিকিৎসার জন্য দীপা পেশাটা গ্রহণ করেছে ।
-আপনি কি পানি খাবেন?
-জি!
-কাঁপছেন কেন?
-না, ঠিক আছে ।
-দীপা তো শিক্ষিত,সুন্দরী ।
-শিক্ষিত মানুষই তো বেশি আসে।
কলিং বেল বেজে উঠল।
-এই অসময়ে আবার কে এলো । আপনি বসুন, আমি দেখছি ।
-কী রে দীপা ফিরে আসলি যে।
-সে ফোনে না করে দিয়েছে, কিন্তু টাকাটা বিকাশ করে দিয়েছে।
-তার টাকা নিয়েছিস কেন?
-কাজ না করে পরের টাকা নেওয়া ঠিক হয়নি ।
একটু সামনে এগিয়ে এসে তার মাকে প্রশ্ন করল,
-মনে হচ্ছে বাসায় কেউ অপেক্ষা করছে ।
-ও হ্যাঁ। তোকে বলা হয়নি।রাসেল এসেছে।
-কোন রাসেল?
-তোর বন্ধু?
-আমার বন্ধু!
দীপা সামনে এগিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কী যেন বলতে চেয়ে থেমে গেল। আমিও দীপাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম।
সে বিনয় স্বরে বলল,
-দাঁড়িয়ে গেলেন কেন?
-বসুন ।
- মা’ তাকে নাশতা দাও ।
-আপনি একটু কষ্ট করে বসুন। আমি ভেতর থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছি ।
আমার জন্য দীপার মা প্লেট ভর্তি নাশতা নিয়ে এলেন । আমার দিকে তা এগিয়ে দিয়ে সে তার রুমে গিয়ে খিল এঁটে দিল। কিছুক্ষণ পর দীপা আমার সামনে এলো।
দীপার দিকে তাকিয়ে আমি আরো অন্ধকারে ডুবে গেলাম। ঠোঁটের গাঢ় লিপিস্টিক গায়ে বিদেশি পারফিউমের ঘ্রাণে আমার নাক বন্ধ হয়ে আসছে। দীপা আমার হাত স্পর্শ করল। আমি পুলকিত হলাম। কী মোলায়েম হাত ওর।
দীপা আমাকে হাত ধরে তার অতিথি আসনের দিকে নিয়ে যেতে লাগল।
আমি দীপাদের পেছন দরজা দিয়ে দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেলাম ।
সেদিনের পর থেকে আমি এখনো দৌড়াতে দৌড়াতে পৃথিবীর পথ শেষ করেছি, তবুও দীপার গায়ের সেই ঘ্রাণ আমার নাকে এসে লাগছে এখনো।