আহত পতাকার কান্না
রানা মাসুদ
কান্নার শব্দে থেমে গেলাম। বোবা কান্নার মতো। শব্দ যেন ভিতর থেকে বের হতেই চাচ্ছে না। ঠিক যেন মোমবাতিতে আগুন জ্বালালে কোন ধোঁয়া আসে না। শুধু নিভু নিভু করে আগুন জ্বলতেই থাকে। মোম গলে যেমন মোমবাতি চুইয়ে চুইয়ে পরে ঠিক তেমনি চোখের অশ্রু নামক রক্তগুলো গাল বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পরছে। বারবার গামছা দিয়ে চোখের রক্তগুলো মুছলেও আবার এক নিমেষেই পূরণ হয়ে যাচ্ছে।
পুরনো একটি ব্যাগ। ধুলাবালি, মাটি আর এটাসেটা লেগে অন্যরকম একটা রুপ নিয়েছে ব্যাগটি। একটা বোতল। পানির বোতলই হবে। মনে হচ্ছিল অনেকদিন ধরে বোতলটি ব্যবহার করলেও কোনরকম ঘষামাজা বা ধোয়া হয়নি। আর্সেনিকের কারনে হয়তো বোতলটা হলুদে ভরে গেছে। তবুও যেন বোতলটিই নিত্য সঙ্গী।
সাদা একটি চাদর। আসলে চাদরকে চাদর বলে সম্বোধন করা ঠিক হবে না। কেননা, চাদরের গায়ে লাল রঙের অনেক লেখা, কালো রঙের অনেক শোকাহত স্মৃতিচারণ, সবুজ রঙে দেশের কথায় ভরে গেছে চাদরটি। তাছাড়া, চাদরটি এক নাগাড়ে শরীরে দেওয়ায় ময়লায় অন্য রকম একটি ছবিতে পরিপূর্ণ হয়েছে। তবে লেখাগুলো এখনো ফুটে আছে। লাল রঙের লেখাটি ঠিক রক্তের মতো লাগছে। মনে হচ্ছিল দুই একদিন আগে আঁকা হয়েছে। চাদরে নানান রকমের ইতিহাসের চিহ্ন। ধীরে ধীরে আমার মনে প্রচন্ড আগ্রহ হচ্ছিল প্রকৃত ঘটনাটি জানার। সেজন্য একটি ট্রেন মিস করেও বসেছিলাম।
হাতে কিছু পাথর ছিলো। একটু দূরে বসে থাকার কারণে বুঝতে পারছিলাম না। একটি সিগারেট জ্বালিয়ে পাশে গিয়ে দাড়ালাম। কখনও লাল রঙের পাথরের টুকরো দিয়ে লিখেই আবার পরক্ষণেই মুছে ফেলছে। আবার কখনও কালো রঙের পাথরের টুকরো দিয়ে লিখেই আবার পরক্ষণেই মুছে ফেলছে। আমার কাছে সবকিছুই গন্ডগোল লাগছিলো। তবে, মুছে ফেলা লেখাগুলো আমাকে খুব নাড়িয়ে দিয়েছে। বাম হাতে থাকা কাপড়ের টুকরোটি মুছে মুছে অনেক ক্ষয় করে ফেলেছে। মনে হচ্ছিল কাজটি অনেকক্ষণ ধরেই একনাগাড়ে করছিলো।
হাতে মুকুট বিড়ি। ব্যাগের ভেতর কি যেন খুঁজছিল? ব্যাগের মধ্যে যা কিছু ছিলো তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাচ্ছিলো না। পকেটের ভিতর হাত দিয়েও যখন পেলেন না তখন আর কি করা? বিড়িটা আবার রেখে দিলেন।। কিন্তু ততক্ষণে বেশ নেশা হয়ে গেছে। কেমন যেন একটা অসস্তি অনুভব করছিল। প্রথমে নেশাগ্রস্ত মনে হচ্ছিল। কিন্তু না। সেরকম কিছু না। একটু পরেই আবার আগের মতো...।
সিগারেটের আগুন দেখেই মুচকি হেসে উঠলো। যেন জীবন জীবদ্দশায় কিছুটা দম ফিরে পেয়েছে নিশ্বাস
নেওয়ার মতো। ততক্ষণে পকেটে রাখা বিড়িটা বের করেছে। বুঝে উঠতে দেরি হলনা আমার তখন.....। তবে এরকম মলিন হাসি অনেকদিন দেখিনি। হয়তো আবার দেখতে পাবো কিনা সেটাও জানিনা। মনে হয় পৃথিবীতে যারা অল্প কিছু নিয়ে সুখে থাকার চেষ্টা করে শুধুমাত্র তাদের মধ্যে এই হাসিটা পাওয়া যায়।
বাম হাতে বিড়ি, ডান হাত দিয়ে সিগারেটের আগুনটা নিয়ে ধরাবে এমন সময় কেউ একজন এসে সিগারেটের উপর পা দিয়ে সামনের দিকে হাটতে থাকে। রেলস্টেশনতো অনেক মানুষের ভিড়।
আকাশে মেঘ জমালে যেমন পৃথিবীটা স্তব্ধ ও অন্ধকার হয়ে যায় ঠিক তেমনি এমন মুচকি হাসি মুখ নিমেষেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। দুয়েক মিনিট শুধু আগুনের দিকে চেয়ে রইলেন। আর জোরে জোরে নিশ্বাস ছাড়তে লাগলেন।
গ্যাস লাইট। চোখের সামনে ধরতেই আবার পুনরায় সেই হাসি। খুবই ভালো লাগছিলো এরকম হাসি দেখে। সময়টা যদি ফ্রেমে বন্দী করা যেতো তাহলে আরও বেশি আনন্দমুখর হতো। আমার হাত থেকে গ্যাস লাইট নিয়েই বিড়ি ধরালো।
বিড়ি টানা শেষ। এতো তারাতাড়ি বিড়ি টেনে শেষ করতে এই প্রথম দেখলাম। ক্ষুদার্ত হাতির সামনে যেমন হালকা কিছু খাবার খেতে দেওয়া। কয়েকটি ছবি তুলে রেখেছিলাম। কিন্তু মোবাইল নষ্ট হওয়ার কারণে সব কিছু ডিলিট হয়ে গেছে।
এবার একটু উঠে দাঁড়ালো। খুব সহজেই যে উঠতে পারলো তেমন কিন্তু নয়। লোহার খুঁটি ধরে ধরে উঠতেই যেন মিনিট দুয়েক লেগে গেল। মনে হচ্ছিল অনেকসময় ধরে বসে থাকার কারণে হাত-পা গুলো জ্যামে পরে গেছে।
কাকা ধরবো?
কথাটা শুনে কেমন যেন একটু ইতস্তা বোধ করলো। ডান হাত নাড়িয়ে ইশারায় বললো না না। উঠতে গিয়ে হঠাৎ টোলে পরে যাওয়ার মতো হওয়ায় আমি গিয়ে ধরে ফেলি। তখন অবশ্য কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ালেন। আমি আর কিছু বলিনি।
বেশকিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকার পরে আবার বসে পরলেন। এইবার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা কৌতুহল এসে বারবার ডেকে যাচ্ছে।
কোনরকম সংকোচ না করেই বললাম, কাকা কিছু খাবেন?
কোন উত্তর পেলাম না। ভাবলাম হয়তো শুনতে পায়নি।
পূনরায় বললাম, কাকা কিছু খাবেন?
এবারও কোন সাড়াশব্দ নেই। মনের মধ্যে একটু রাগ হলো।
তারপরও শেষবারের মতো বললাম, কাকা কিছু খাবেন?
এইবার বলার আগেই মাথা নাড়িয়ে দিলো।
আমি আর দেরি না করে হুট করে পাশের দোকান থেকে রুটি, কলা আর কেক পানি নিয়ে হাজির।
কাকা খাচ্ছে। আর আমি বসে শুধু দেখছি।
কাকার খাওয়ার তালে তালে জিগ্যেস করলাম,‘কাকা কোথায় যাবেন?’
কিন্তু কাকা কিছুই না বলার কারণে বুঝতে পারলাম এমনিতেই কথা বলে না তারপর আবার খাচ্ছে।
হঠাৎ চোখ দুটো কেমন যেন বড় বড় করে তাকালেন। আমিও বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। কি যেন বলতে চাচ্ছে? কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না। তবে, মনে হচ্ছিল কিছু একটা হয়েছে। মাটিতে লুটে পরতেই বুঝতে আর দেরি হলো না কি হয়েছে? পাশে রাখা পানির বোতল তারাতাড়ি খুলে মুখে দেওয়ায় স্বস্তি ফিরলে একগাল হেঁসে বলল,‘বাবা তুমি আমার জীবনটা পূনরায় বাচিয়ে দিলে।’
তালা দেওয়া মুখের কুলুপ যেন এবার খুলে গেল। লটারির পুরুষ্কারের মতো। সুযোগটা হাত ছাড়া করিনি। আস্তে আস্তে ভাব জমাতে শুরুকরলাম। শিকলে বাঁধা মনের গোপন কথাগুলো বের হতে থাকলো।
বাড়ি নিতাইগঞ্জ। বাবার নাম কেষ্ট ঠাকুর। তিনিও নাকি যুদ্ধের আগেই গত হয়েছে। মা ছিলো তবে দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে ভুগে তিনিও ওপাড়ে চলে গেছেন।
বয়স ৫২ ছুঁই ছুঁই। শরীরটা যে খুব ভালো যাচ্ছে সেটাও নয়। তবে এখনো কারোরই দারস্থ হয়নি। এক ছেলে আর মেয়ে নিয়ে সংসার। গৃহকর্ত্রী বছর দুয়েক হলো নিশ্বাস ছেড়ে দিয়েছে।
ইতিমধ্যে চোখের কোনায় অশ্রুজলের ছড়াছড়ি। টপটপ করে কয়েক ফোটা অশ্রুজল পরে গেলো। ভাবলাম কথাগুলো মনকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ডান হাত দিয়ে চোখদুটো মুছে ফেললেন। আবেগ আপ্লুত কন্ঠে কি যেন গড়গড় করে বলতে চেয়েও থেমে গেলেন।
-কাকা, কাঁদছেন কেন? প্রিয়জনের কথা মনে পরেছে?
-জি, বাবা। সবসময়ই মনে পরে। তবে যারা জীবিত আছে তাদের কথায় মনে পরে বেশি। আর মনে পরলে বুকের ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। হৃৎপিন্ডটা পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। যেটুকু বাকী থাকে সেটুকুও ধীরে ধীরে পচেগলে গন্ধ ছড়াতে থাকে।
-কাকা এতো কষ্ট কিসের? কিসের জন্য বুকে এতো হাহাকার?
-আর বলিস নারে বাপ! এতো কষ্ট করে রোজগার করে যাদের মানুষ করালাম তারাই আজ ফাঁকি দিতে শুরু করেছে। পিতৃত্বের পরিচয় বোধ হয় তাদের আর দরকার নেই। বাবা অক্ষরের দুটি শব্দের মানুষটি যে আজও বেঁচে আছে হয়তো তারও কোন খোঁজখবর নেই তাদের কাছে। জমিজমা যেটুকু ছিলো সবইতো নিয়েছে। দেহটাও পারলে বোধহয় এতোদিনে নিয়ে নিতো। ভাসিয়ে দিয়ে আসতো কলাগাছের ভেলায়। বাবারে! মেয়ের কথা বাদই দিলাম। অভাবী সংসারে ছেলে সন্তান নিয়ে কেমন করে আমার সেবাযতœ করবে। তবে যেটুকু সামর্থ্য আছে তার সেবাযতœ করে।
-আর ছেলে?
-ন্ডমম, আর ছেলে! ছেলের কথা বলিস নারে বাপ। বুকের হাড়গুলো ধস্তাধস্তি জবরধস্তি করে ভেঙে যেতে চায় তার কথা শুনে। কুলাঙ্গারটা আমার জমিজমাটুকু লিখে নিয়ে শশুর-শাশুড়ী আর বউ নিয়ে আমোদ প্রোমোদে ব্যস্ত। আমাকে খাওয়াতে নাকি তার অনেক খরচ পরে। বলতে বলতে আবার ধুকধুক করে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে আবার বলতে শুরু করলেন...।
চোখের কোনায় অশ্রু নামক শব্দটি এসে ভিড় করছে। চোখের পাতা নড়তেই দুই ফোটা অশ্রুজল পরে গেল। নিজেকে হয়তো সংযত রাখতে পারিনি। রাখার কোন কৌশল আছে বলেও আমার জানা নেই। অসহায়ত্বের গল্প বুঝি এরকমই। পুঁজি বলে শুধু হাউমাউ করে কাঁদতে পারা আর দুঃখগুলো বুকের ভিতর চাষ করাটাই মুখ্য বিষয়।
চোখমুখে পানি দিয়ে আবার একটি সিগারেট জ্বালিয়ে পাশে বসে টানছি। দুঃখগুলোকে বিদায় জানানোর জন্য একটি অহেতুক চেষ্টা। ভুলে থাকার বাহানা শুধু। অভিনয় সে-তো অনেক আগেই হৃদয় পুড়ে পুড়ে রপ্ত করেছি।
-বাবা! আমাকে একটা দেওয়া যায়না?
কোন রকম চিন্তা না করেই সিগারেটের প্যাকেট বের করে হাতে দিলাম। একটি পকেটে রাখলেন আর একটি...।
সত্যি কথা বলতে কি এরকম বন্ধুত্ব হয়তো আগে কখনও হয়নি। একজন ৫০ উর্ধ্ব আর একজন যুবক। অভাবনীয় ব্যাপার।
-কাকা, ঢাকায় এসেছেন কেন? কার কাছে এসেছিলেন?
কোন কথায় বলছিলেন না। মনে হচ্ছিল ধোঁয়ার মাঝে নিজেকে মেলে ধরেছে। আশেপাশে তাকানোর কোন সুযোগ নেই। একনাগাড়ে টেনে সিগারেট শেষ করে ফেললেন।
তারপর বললেন,
-বাবা, কি যেন বলতে ছিলে?
-বলছিলাম ঢাকায় কেন এসেছিলেন?
কাকা গড়গড় করে বলতে শুরু করলেন।
বললেন,
- বাবা, আমি মুক্তিযোদ্ধা। হয়তো কাগজ কলমে কোন প্রমাণ নেই। তবে সত্যি বলছি স্বাধীনতা যুদ্ধে দলবেঁধে যুদ্ধ করেছি।
প্রিয় কয়েকজন বন্ধু, সহযোদ্ধাকেও হারিয়েছি মুক্তিযুদ্ধে। ছোট ভাইকেও তো হারিয়েছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা যারা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা নামক শব্দটি ছিনিয়ে এনেছি তাদের কপালে কি জুটেছে? কিছুই নয়। হাহুতাশ করা ছাড়া কিছুই করার নেই। অনেক দিন চেয়ারম্যান, মেম্বারদের কাছে গিয়েও কোন কিছু পায়নি। উপজেলা অফিসে গিয়ে কোন সুরাহা হয়নি। সবাই শুধু আশ্বাস দিয়ে যায়। কিন্তু...।
অবশেষে, কেঁদে কেঁদে চোখের জল ফেলতে শুরু করলেন।
বাবা! তারপর থেকে আর কারোরই দারস্থ হয়নি। যেখানে সেখানে দিনরাত পার করি। কখনও খেয়ে আবার কখনও না খেয়ে। কখনও রেলস্টেশনে আবার কখনও গ্রামগঞ্জের চায়ের দোকানেই কাটে সবসময়। তবে বাবা, আমি প্রতিমাসে ঢাকায় আসিনা। বিশেষ কিছু দিন ছাড়া ঢাকায় আসা হয়না আমার। দিনগুলোর কথা মনে পরলে বুকের ভেতর ফাঁকা মাঠের মতো হয়ে যায়। যেখানে শুধু মরিচীকারা বাস করে। শুকনো পাতাগুলো মরমর করে ভাঙতে থাকে।
আমি একটু থমকে গিয়ে বলতে শুরু করলাম,‘কাকা বিশেষ দিন? মানে বুঝলাম না।’
ভাবলাম এরকম একজন নিরিহ মানুষেরও কি বিশেষ দিন থাকে? যার কারণে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসা এই ব্যস্ত নগরী ঢাকায়। তাহলে কি সেই বিশেষ দিন? মনের মধ্যে ধীরে ধীরে আরও বেশি আগ্রহ জমতে থাকলো। পিপাসিত কাকের মতো হন্যে হয়ে গেলাম।
-বিশেষ দিন বলতে ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বর। এই তিনদিই আমার ঢাকা আসা হয়। যত ঝর বৃষ্টি, বাঁধা বিপত্তি আসুক না কেন আমাকে তুমি পাবেই।
খুবই শক্ত গলায় কথাগুলো বলতে ছিলেন তিনি। কথার মধ্যে কেমন যেন একটা গন্ধ আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বর এই তিনটি দিনই যে আমার সত্তাকে নাড়িয়ে যায়। বাংলা ভাষাভাষী সকল মাতৃপ্রানকে উজ্জীবিত করে।
-কেন কাকা? শুধুমাত্র এইদিগুলোতেই ঢাকায় আসেন কেন?
আবার সজোরে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি কয়েকবার চেষ্টা করেও কোন সুরাহা করতে পারিনি। আসলে মনের মধ্যে গুপ্ত কষ্টগুলো এভাবেই মানুষকে আঘাত করে সুখ পায়। আর ভিতরের হৃদয় নামক কলকব্জাগুলো ধ্বংস করতে থাকে।
কান্না জড়িত কন্ঠেই বলতে শুরু করলেন,
-বাবারে! এই তিনটিদিনে আসলে বুকের পাঁজরগুলো ভেঙে তছনছ হওয়ার উপক্রম হয়। নিশ্বাস নিতে চাইলে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে পরি। থতমত হয়ে যায় কণ্ঠনালী। ফুসফাস শব্দ ছাড়া আর কিছুই বের হয় না।
-বাবা রে!! আমি সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিলাম কোন দিন জানিস? জানিস না। সেদিনের অশ্রুজলে আমি নিজেই ডুবে যেতাম।
হাউমাউ করে কাঁদতে ছিলেন তিনি। বলতে ছিলেন,
-গত কয়েক বছর আগে ঢাকা শহরে ‘লাখো কন্ঠে সোনার বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। অসংখ্য মানুষের আনাগোনায় ভরে গিয়েছিল পুরাতন বিমানবন্দর। দলবেঁধে, যে যার মতো, বিভিন্ন গার্মেন্টস, পোশাক শিল্প, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রীর পদচারণে মুখরিত হয়েছিল সমস্ত মাঠ। একসঙ্গে লাখো মানুষের জাতীয় সংগীত গাওয়া ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। সেদিন বাংলাদেশ সরকার লাখো কন্ঠে সোনার বাংলাদেশ এর সার্টিফিকেট, পানি, ঔষধ এবং খাদ্যদ্রব্যও বিলিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় সেদিনই ছিলো বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিশপ্ত দিন। নাহলে কি এইদিন দেখতে হতো? কতো মায়ের বুক খালি করে, কতো বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে, কতো পিতার অশ্রু দিয়ে, কতো নিরীহ মানুষের জীবন বলিদান দিয়ে, কতো ভাইয়ের রক্তের দাগে, কতো নববধূর সিঁথির সিধুর মুছে স্বাধীনতা নামক শব্দটি ছিনিয়ে এনেছি, লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে নিয়ে এসেছি। সবই আজ বিফল মনে হচ্ছে। এই দুঃখগুলো আমাকে প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। সেদিন দেখলাম হাজার হাজার পতাকা মাঠে গড়াগড়ি খাচ্ছে, কেউ কেউ ছিড়ে ফেলছে, কেউ কেউ ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে, আবার কেউ কেউ...ব্যবহার করছে।
-লাখ লাখ মানুষ সেদিন জাতীয় পতাকার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। অগুনিত পতাকা গুলো এভাবেই আর্তনাদে কেঁদে উঠছিলো বারবার বারবার। অনেকেই আবার পতাকার উপর... করছিলো। এই যদি দেশের মানুষের চিন্তাভাবনা হয়, এই যদি দেশের সরকারের উৎসব অনুষ্ঠান হয় তাহলে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে লাল সবুজের পতাকা অর্জনের দরকার ছিলো না। দরকার ছিলো না ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বরে কোটি কোটি টাকা খরচ করে মিছিল মিটিং, প্রচার প্রচারণা করার। যেখানে বাঙালীরা একটি মাত্র পতাকার সন্মান দিতে পারে না।
-বাবা রে! আমরাতো যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছি। বিনিময়ে কিছুই পাওয়ার আশা করিনি। যদি পাওয়ার নেশায় বিভোর থাকতাম তাহলে সেদিন নিজের জীবন বিপন্ন রেখে দেশ রক্ষায় নিজেকে বিলিয়ে দিতাম না।
-বাবা রে! ঢাকায় আসি এই একটাই কারণে। নিজ উদ্যোগে যতটুকু পারি রাস্তাঘাটে, বাসস্ট্যান্ডে, রেলস্টেশনে এমনকি শহীদ মিনারে ছিটিয়ে থাকা পতাকা গুলো কুড়িয়ে এনে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিই। যাতে করে পতাকা গুলো কারো পদতলে না পরে। পদতলে পরলে ব্যথা অনুভূত হয় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরে। আহত পতাকার কান্না জড়িত আওয়াজ সবসময়ই কানে বাজে। চিৎকার করে বলতে থাকে এ কেমন স্বাধীনতা!
নিশ্চুপ বসে আছি। দুই হাত দিয়ে মুখটাকে ঢেকে রেখেছি। চোখ খুলে তাকানোর সাহসটুকু হারিয়ে ফেলেছি। এইতো গতকাল ১৬ ডিসেম্বর ছিলো। ভাবতেই অবাক লাগছে আমি নিজেও পতাকার অপব্যবহার করেছি। শাস্তি আমারও হওয়া উচিত। মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার, দাঁড়িয়ে নিশ্বাস নেওয়ার শক্তিটুকু ইতিমধ্যেই হারিয়ে ফেলেছি। কোন রকম শব্দ ছাড়াই কেঁদে উঠলাম।
পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম।
-কাকা, আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমাকে মাফ করে দিন।
-আরে বাবা! কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? তোর উপলব্ধি নিজে থেকেই তোকে মাফ করে দিয়েছে। তোর মতো উপলব্ধি যদি সবার হতো তাহলে...।
ইতিমধ্যে বাড়ি যাওয়ার শেষ ট্রেন এসে গেছে। লজ্জায়, অপমানে তাঁর দিকে না তাকিয়েই ট্রেনে উঠে পরি। শেষবারের মতো এক পলক দেখার জন্য ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু মানুষের ভিড়ের কারণে দেখতে পারিনি।
আজ ২২শে ফেব্রুয়ারি। অনেক আশা নিয়েই রেলস্টেশনে বসেছিলাম সারাদিন। কিন্তু যাঁর খোঁজে সারাদিন বসে বসে কাটালাম তাঁর দেখা পেলাম না। ভেবেছিলাম গতকাল ২১শে ফেব্রুয়ারি ছিলো অবশ্যই তাকে এখানে পাওয়া যাবে। কিন্তু না, তাঁকে খুঁজে পায়নি।
ফেরার পথে একটু থমকে দাঁড়ালাম। রেলস্টেশনের একটি দেয়ালে ছবি লাগানো।
সেই মানুষটির ছবি। যাকে আমি খুঁজছিলাম।
হারানোর বিজ্ঞপ্তি, ‘মানসিক ভারসাম্যহীন শ্রী নারায়ণ চন্দ্র দাশের কোন খোঁজখবর পেলে নিচের নাম্বারে যোগাযোগ করুন। তাকে বিশেষ পুরুষ্কার দেওয়া হবে।’
বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠলো। উল্লেখিত নাম্বারে যোগাযোগ করলাম।
বলল, আমরা ওনাকে খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু তিনি...।
-কিন্তু তিনি কি ভাই?
অপরপ্রান্ত থেকে কান্নাজরিত কন্ঠে বলল, ‘তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন।’
ততক্ষণে দুচোখ অশ্রুজল ভিজিয়ে দিয়েছে। আর কোনকিছু জিজ্ঞাসা না করে শুধু বললাম,‘আপনার ঠিকানাটা পাওয়া যাবে?’
-ঠিক আছে লিখে নিন...।