ছায়া

 


ছায়া

হাসান মাহাদি 


অন্দরমহলে মা যেমন তার আঁচলে আগলে রেখেছেন তেমনি বাবা বাইরে থেকে একটা বটবৃক্ষের মতো পুরো সংসারটাকে ঝড়, বৃষ্টি, রৌদ্র থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ছোটবেলায় অনেক বায়না ধরতাম। কখনও পূরণ হতো...

‘বাবা, ওড়াটা ওপর দিয়ে খালি রাখছ কেন?' 

গামছাটা মাথায় বাঁধতে বাঁধতে বললাম। সংসারের কাজকর্ম তেমন একটা করি না। বাবার সামান্য আয় আর মায়ের জোড়াতালিতে যে সংসার চলে, তা বুঝতাম। তবে আমার বাবা-মা কখনোই তা বুঝতে দিতেন না। নিম্নবিত্ত পরিবারের হলেও স্বাভাবিক অভাবটা কোনো দিনও অনুভব করিনি। আট-দশটা সাধারণ ছেলে থেকে একটু আলাদাভাবেই বড় হয়েছি। তবে সেটার কৃতিত্ব আমার মায়ের। বাবাও কোনো অংশে কম নন। 

অন্দরমহলে মা যেমন তার আঁচলে আগলে রেখেছেন তেমনি বাবা বাইরে থেকে একটা বটবৃক্ষের মতো পুরো সংসারটাকে ঝড়, বৃষ্টি, রৌদ্র থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

ছোটবেলায় অনেক বায়না ধরতাম। কখনও পূরণ হতো, কখনও হতো না। যখন বায়নাগুলো পূরণ হতো না তখন খুব রাগ হতো। এখন বুঝি, যে বায়নাগুলো পূরণ হতো সেগুলোর জন্য কতটা ঘাম ঝরত।

আজ বর্ষায় পলি পড়া মাঠে দাঁড়িয়ে কল্পনার মেঠোপথে হাঁটতে হাঁটতে সেই কথাগুলোই ভাবছি।

একবার আমার খুব জ্বর হয়েছিল। আমি যখন ওষুধ খেয়ে মরার মতো বিছানায় শুয়ে থাকতাম, একটা হাত তখন আমার মাথায় নড়াচড়া করত। আমি অ্যাণ্টিবায়োটিকের ঘোরে থাকলেও শক্ত মেছ পড়া খসখসে হাতের অসম্ভব স্নেহ আর ভালোবাসার পরম ছোঁয়াটা কার ঠিকই বুঝতাম। খুব ভোরে যখন শরীরটা একটু হালকা লাগত, তখন পাশের ঘর থেকে শোনা যেত,

‘হে আল্লাহ, তুমি আমার ছেলেটাকে সুস্থ করে দাও। এই আমার একমাত্র সম্বল ...।'

সেই সঙ্গে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার শব্দ।

মনে আছে, এই তো সেদিন যখন খবর হলো, আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি, সেকি আনন্দ তার!

হয়তো এক শান্ত ভোরে ফজরের নামাজের পর করা কোনো প্রার্থনার ফল তিনি পেয়েছেন! সবার অগোচরে সেদিন বাবা তার সজল নয়ন তৃপ্তি দৃষ্টিতে ওপরের দিকে তাকিয়ে ¯্রষ্টার শুকরিয়া যে আদায় করেছিলেন তা আমি দেখেছিলাম। তারপর যখন দেখলেন আমি তাকিয়ে আছি, তিনি তার ডান হাতটা তুলে মুষ্টিবদ্ধ করে মাথা নেড়ে কিছু একটা বোঝালেন। আমি বুঝেছি সে কথা।

‘এগিয়ে যাহ, বাছা। আরও বড় হতে হবে।’ আমিও মাথা নেড়ে তাকে কথা দিয়েছি।

এসব যখন ভাবছি এর মধ্যে মা যে কখন পানি নিয়ে এসে গেছেন খেয়াল করিনি।

হঠাৎ ডাক শুনলাম, ‘এমনে দাঁড়াইয়া আছস কেন?’

আমার ঘোর ভেঙে গেল। আমি বললাম, ‘কই? এমনি।’

আমার সামনে তখন বিচিত্র রঙের কিছু প্রজাপতি শুকনো ও আধা কাঁচা হেলেঞ্চা লতায় খেলছিল।

মায়ের ডাকটা শুনে একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম। 

বাইরের যত কঠিন বাস্তবতা আমাকে বিপদে ফেলতে চায় তখন সেই মেছ পড়া রুক্ষ হাত এসে আমাকে সামলে রাখে। আর যখন মন খারাপ থাকে, একটা কোমল আঁচল এসে আমাকে ভরসা দেয়। 

আজ নিজের ইচ্ছাতেই মাঠে এসেছি। কেন যেন ক্লান্তহীন বিরক্তিহীন ত্যাগী মানুষদের একটু বুঝতে ইচ্ছা করছে। কখনও পারব কি-না জানি না। হয়তো পারব, যখন তাদের জায়গাটা আমার হবে!

বাবাকে বোঝা ভরতে দেখে মা বললেন, ‘পোলাডায় পারব? ঘাড়ে ব্যথা পাইব না?’ বাবা হাত থেকে পচা কচুরিপানা ওড়ার মধ্যে রেখে আমার মাথায় উঠিয়ে দিলেন। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বললেন, ‘পোলায় বড় হইছে কি-না একটু পরখ করতে অইব না?’ আমি ততক্ষণে দু’কদম এগিয়ে গেছি। বাবার কথাটা স্পস্টই শুনলাম। নিজের অজান্তেই বুকভরে শ্বাস নিয়ে ভেতরের সব অপ্রাপ্তির ধূলিগুলো প্রশ্বাসে বাইরে ফেলে দিলাম। ভাবলাম, বাবা-মায়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহার, শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি নেই।

বর্ষার দুপুরটা যেন অসম্ভব সুন্দর হয়ে ধরা দিয়েছে। কাঁচা মাটির ছোঁয়ায় অমূল্য প্রাপ্তির আনন্দটা আরও আন্দোলিত হচ্ছে। মাথার বোঝাটাকে মনে হচ্ছে হালকা। কেউ যেন বুঝতে দিচ্ছে না বোঝাটা ভারী। 

একটা কণ্ঠ পরম আদরে আমাকে বলছে, ‘ভয় কিসের বোকা? এগিয়ে যা, আমি তো আছি।’

আমাকে অবশ্যই ভারী বোঝাটা শেষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। কেননা বাবাকে দেখাতে হবে আমি বড় হয়েছি। আর আমার বড় হওয়াটা তার শত পরিশ্রমের একমাত্র প্রাপ্তি হয়ে থাকুক।


হাসান মাহাদি 

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট