অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
আনন্দ বেদনা
মুহাম্মাদ রাহাতুল ইসলাম
দুপুরের প্রচন্ড রৌদ্রের তাপ এখনও খুব একটা কমেনি। বারবার ঘরে ঘরে বাইরে যাওয়া আসা করছে মাহমুদা। এখনও রান্নার কোনো গোছগাছ হয়নি। হাঁটু গেড়ে চুলার পারে বসে আছে খালিদ। বিলের থেকে পুটি, চিঙরি, দারকিনা সহ ইত্যাদি মাছ ধরে এনেছে সে। আর সাথে এনেছে কয়েকমুঠ কলমি শাক। সেগুলো-ই রান্নার জন্য তাড়াহুড়ো করছে মাহমুদা। আজ ত্রিশে রমজান। বেশ কয়েক বছর পর এবারের রোজা ত্রিশটা পূর্ণ হলো। কাল ঈদ। তবে পেটে অসুখের কারণে আজকের শেষ রোজাটা সম্পন্ন করতে পারেনি খালেদ। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই ভেঙে ফেলেছে। কিন্তু সকাল থেকে তেমন কিছুই খায়নি। এজন্য একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করছে মাহমুদা।
পাকঘরের কোণা দিয়ে পুকুর পারে নুয়ে পরা লেবু গাছটায় অনেকটি ছোট ছোট লেবু ধরেছে। গরম গরম ভাত সাতে পুটি মাছ দিয়ে কলমিশাক আর কচি কাগজি লেবু। এভাবে খাবারের স্বাদ কল্পনা করতে করতে মুচকি হাসে খালেদ। এমনিতেই কড়া রোদ তার উপর চুলার গরম, নেয়ে ঘেমে খারাপ অবস্থা হলেও খালেদের এমন শিশুসুলভ হাসি চোখ এড়ায়না মাহমুদার। ভিতরটা কেঁপে উঠে যেন। দারিদ্রতার কাঠখড় পোড়ানো কত কষ্টের সংসার। অভাব অনাটন আর অসুখ বিসুখ তো লেগেই থাকে একটার পর একটা। তবুও এই সাদাসিধা মানুষটার সহজসরল হাসির জন্য সব মুখ বুঝে সহ্য করে নেয় মাহমুদা। বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর হতে চেলেছে। এখনও যেন মানুষটাকে দেখে তার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। পরিশ্রমী, কঠর অথচ কত বিনয়ী আর উধার চিত্তের অধিকারী। একদমই সহজসরল। হিংসা বিদ্বেষ তো দূরে থাক। সামান্য তম খারাপত্ব যেন তার ভিতরে নেই।
মাহমুদা জিগ্যেস করে; কার কথা ভাবতাছেন মুখ বাকিয়ে? সংবিৎ ফিরে পায় খালেদ। বেচারা একটু লজ্জাও পেলো বোধ হয়। একগাল হেসে উত্তর দেয়; আরে না, তেমন কিছু না। বলেই উঠে ঘরে চলে যায় সে। ঘরে চৌকিতে ঘুমিয়ে আছে ফাহাদ। বয়স চার বছর। খালেদ ও মাহমুদা দম্পতির এক মাত্র সন্তান। খালেদ তাকায় তার দিকে। কি সুন্দর ফুটফুটে একটি মানব শিশু। শিশুদের মাঝে ঐশ্বরিক সৌন্দর্য বিদ্যমান। পৃথিবীর সব শিশুরাই সুন্দর। কপালে হালকা ঘাম জমে আছে। হাত পাখা নিয়ে ছেলের পাশেই শুয়ে পরে খালেদ।
বিকেলে অনেক জোরাজোরি করার পরও খালেদ কিছুই খায়নি। রোজা রাখেনি বলেই যে খেতে হবে এরকম তো কোনো কথা নেই। তাছাড়া এইটুকু সময় না খেয়ে থাকা কোনো ব্যাপারই না। খালেদ আক্ষরিক অর্থে গরিব। সহায় সম্পত্তি তেমন কিছু নেই। তবে সে ভীষণ আত্মমর্যাদাশীল, ধার্মিক। মাগরিবের আজান হয়। স্বামী স্ত্রী এক সাথে ইফতার করে। কাল ঈদ। ভীষণ আনন্দের দিন। খালেদ তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে- বাজার থেকে কি কি আনতে হবে। এক এক করে প্রয়োজনীয় সব কিছুর কথা বলে মাহমুদা। এবং কড়া সতর্ক করে দেয় সে যেন, তার জন্য যেন কোনো কিছুই না আনে। আত্মীয় স্বজন তেমন কেউ নেই। কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না। গতবছরের ঈদের কাপড়-ই এখনো পরা হয়নি। যেমনটা তেমনই পরে আছে ট্রাংকে। তাছাড়া ইদানীং আয় রোজগারও খুব একটা ভালো না। ধানের দাম কম ছিলো। আর হঠাৎই মহাজনের আড়তে আগুন লেগে সব পুড়ে যায়। সব মিলিয়ে অবস্থা খুবই শোচনীয় বলা যায়। ঘর থেকে বের হয় খালেদ। পিছন পিছন ছুটে যায় মাহমুদা। আর শোনেন; ছেলেটার জামা আনতে কিন্তু ভূইলেন না। রাত যত হয় হোক জামা না নিয়ে ফিরবেন না কিন্তু। চিৎকার দেয় মাহমুদা। কালকে ঈদ। সেই কবে জামা বানাতে দেয়া হয়েছে টেইলার্সে। দেয়ার কথা ছিলো আরও দুইদিন আগেই। ঈদের সময়ে টেইলার্সের এই এক সমস্যা। ঠিক মতো কাপড় বানিয়ে দেয় না। আজ না কাল, কাল না পরশু এমন করতেই থাকে। কে জানে আজকেও দেয় কি না।
ঠিক যেমনটা ধারণা করা হয়েছিলো। জামা এখনও সেলাই করা-ই হয়নি। সেদিন গভীর রাত করে বাড়ি ফেরে খালেদ। টেইলার্সের দোকানে বসে ছিলো। বসে থেকে একটা জামা আর প্যান্ট বানিয়ে এনেছে। কাল ঈদ। খালেদ মাহমুদা কেউ নতুন জামা নেয়নি। শুধু ছেলেটার জন্যই এই জামা কাপড়। বাচ্চা মানুষ। ওর জন্য না হলে কি আর চলে। বাড়িতে আসতে আসতে ছোট বেলার কথা ভাবে খালেদ। তাদের অভাব অনাটনের সংসার। তার উপর সেবছর বন্যায় একটা গরু মারা গেছে। পরিবারে সদস্য সংখ্যাও বেশি। সবার জন্য নতুন জামা কাপড় বানাতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন। এত টাকা তো বাবার কাছে নেই। যে কোনো কারণেই হোক জামা বানানো হয়নি খালেদের জন্য। ঈদের দিন সব বাচ্চারা নতুন কাপড় পরেছে। তা দেখে সে কি কান্না খালেদের। মনে পরলে এখনও হাসি পায়। বাড়িতে এসে এরকম আরও অনেক স্মৃতি স্মরণ করতে করতে ঘুমিয়ে পরে খালেদ।
আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর। ভালো ভাবে গোসল করে পরিস্কার কাপড় পরে খালেদ। মাথায় চিরুনি দিতে দিতে তাকিয়ে থাকে ছোট ছেলেটার দিকে। মাহমুদা তাকে ধরে নিয়ে গেছে কলতলায়। তারপর সেখানে বসিয়ে ভালো ভাবে সাবান দিয়ে গোসল কারাচ্ছে মাহমুদা। ছেলেটা আজ একটুও কাঁদছে না। অন্য দিন হলে হয়তো কাঁদতো। ঈদের আনন্দের নিচে চাপা পরে গেছে তার এই সামান্য পরিচ্ছন্নতার কষ্ট। অতঃপর গোসল শেষে ঘরে এনে নতুন কাপড় পরায় ফাহাদকে। খালেদ হাসি হাসি মুখে প্রিয়তমা স্ত্রীকে সালাম দিয়ে ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বাবা পুত্রের এমন আনন্দ যাত্রা দেখে চোখে পানি এসে যায় মাহমুদার। আঁচল দিয়ে মুছে নেয় কয়েকবার। এই জীবনে তার আর কিছুই চাওয়ার নেই। ছোটবেলায় এক্সিডেন্টে বাবা মায়ের একত্রে মৃত্যুর পর সে ভূলেই গিয়েছিলো আনন্দ কি। আজ তার মনে হচ্ছে পৃথিবীটা আসলেই বড্ড সুন্দর, ভীষণ আনন্দের। অন্ততঃ এই দু’টো মানুষের জন্য হলেও সে বেঁচে থাকতে চায় দীর্ঘকাল।
হাটহাজারী, চট্টগ্রাম