খানাবাড়ির প্যানপ্যানানি

 



খানাবাড়ির প্যানপ্যানানি

হাফিজুর রহমান


গ্রামের সবচাইতে বড়ো বাড়িটাই খানাবাড়ি। এই বাড়ির মানুষগুলো শিক্ষা-দীক্ষা, বংশ পরিচয়, সম্পদ - প্রভাব, সকল ক্ষেত্রেই আশপাশের আট-দশটা গ্রামের মানুষগুলোর তুলনায় সব দিক থেকে এগিয়ে থাকার কৃতিত্ব ধরে রেখেছে, দীর্ঘদিন থেকে। বিশাল বড় একটি বাড়িতে বসবাস করে এক’শোরও বেশি সদস্যের একটি পরিবার। এক হাঁড়ির রান্না করা খাবার খায় সকালে একসাথে বসে, পাকা ঘরের দীর্ঘ বারান্দায় পাটের তৈরি চট বিছিয়ে। এলাকার বাইরের অজানা কেউ দেখলে খুব সহজেই ভেবে নিবেন, হয়তো গ্রাম্য আয়োজনে কোন বড়সড় বিয়ে অনুষ্ঠানের খাওয়া-দাওয়া চলছে।

কৃষি নির্ভর এই পারিবারিক সম্প্রীতির প্রশংসা বিস্তৃত এলাকা জুড়ে, একসাথে খাবার খাওয়ার চিত্রটি ছড়িয়ে পড়েছিল মানুষের মুখে-মুখে, আর এভাবেই ‘খানাবাড়ি’ হিসেবে এই বাড়িটি একসময় পরিচিতি অর্জন করে। 

খানাবাড়ির অভিভাবক ছলিমুদ্দিন খাঁ, বয়সের দিক থেকে এই বিশাল পরিবারের সকলের বড়, বয়স নব্বই ছুঁইছুঁই। ছলিমুদ্দিন খাঁ’রা আট ভাই। একেকটি ভাইয়ের চার থেকে ছয়জন করে করে পুত্র সন্তান। ইতিমধ্যে ছেলে ও ভাতিজা মিলে ডজন খানেকের বেশি - বিয়েসাদী করে দু’চারটা সন্তান জন্ম দিয়েছেন। নাতি, নাতনি সহকারে এতবড়ো একটি পরিবারের দক্ষ অভিভাবক ছলিমুদ্দিন খাঁ, যার কথাই শুরু এবং শেষ। তাঁর কথা বা কর্মে কোন ধরনের আপত্তি বা দ্বিমত পোষণ করার, কেউ সাহসেই পায় না, নতমুখে সবকিছু মেনে নিতে বাধ্য হয় সকলে। 

হয়তো এই রকমের অভিভাবকের দক্ষ নেতৃত্বের কারণেই, পরিবারটিকে এতোটা বড় বানানো সম্ভব হয়েছে। 

বয়সের ভার, কাবু করতে পারেনি কখনও ছলিমুূদ্দিন খাঁ’কে। এতোটা বয়সেও তাঁর দুর্দান্ত দাপট, ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে পরিবার থেকে শুরু করে গ্রামের অনেকেই। এ নিয়ে সমালোচনাও কম হয় না, “মানুষটার মৃত্যুর ভয় নেই, এখনও সংসারের পিছনে লেগে আছে, ধর্মকর্মে মন নেই!” এই ধরনের নানান রকমের সমালোচনা। নিজেদের মধ্যেও অনেকের জন্মেছে ক্ষোভ, কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না ভয়ে।

এই দুর্দান্ত দাপুটে মানুষটা, হঠাৎ করেই একদিন পরপারে পাড়ি দিলেন, কোনধরনের পূর্ব সংকেত না দিয়েই বীর পুরুষের মতো। 

অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলেন না বিছানায়, চিকিৎসা ও সেবার জন্য ভরসা রাখতে হয়নি কারও উপর। অসুস্থ হওয়ার পরপরই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গিয়েছেন পরপারে। 

খানাবাড়ির যোগ্য অভিভাবক ছলিমুদ্দিন খাঁয়ের মৃত্যু পর, এই বিশাল পরিবার নিয়ন্ত্রণের ভার গ্রহণে একাধিক সদস্য এগিয়ে এলেও, কেউয়েই ঠিকঠাক ভাবে চালাতে পারছিল না। ঘারতি ছিল বিশ্বাসের, অভাব ছিলো আস্থার, চেষ্টা চলে একে অন্যের থেকে বেশি সুবিধা নেয়ার। ছয় মাস যেতে না যেতেই এই স্বনামধন্য পরিবারটি রুপান্তরিত হলো অশান্তির দূর্গে।

একেকটি বিষয় নিয়ে প্রতিদিনই চলতে থাকে একেক রকমের ঝগড়াঝাটি, মারামারি সহ নানান রকমের অশান্তি। অবশেষে খানাবাড়ির পরিবারটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ভাগাভাগি করতে ভাঙতে হলো বাড়ি, ভাগাভাগি হলো ইট-সুরকি সহ ধুলোবালি পর্যন্ত। 

একসময় মরহুম ছলিমুদ্দিন খাঁ’র, যারা সমালোচনা করত, আড়ালে করত গালিগালাজ; তাদের মুখেই এখন এই মানুষটার গুণগান। ঠিক কতটা পারদর্শী হলে এরকমের একটি পরিবার পরিচালনা করা সম্ভব, আসলে কোন রোগের কী ঔষধ প্রয়োগ করতে হয়, সেটি তিনি ভালো করেই জনতেন বলেই সংসার নামক জটিল জায়গায় তিনি সফল হতে পেরেছিলেন। সকলের মুখে-মুখে শোনা যায় এখন, “খানাবাড়ির ছলিমুদ্দিন খাঁ, ভীষণ ভালো মন ও মানের মানুষ ছিলেন।”



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট