অপেক্ষায় ছিল সালমা।অনেক দিনের অপেক্ষা-অনেক বছরের অপেক্ষা।ঢাকা থেকে শামীম রওনা দিয়েছে।
সকালেই বিমান থেকে নেমে ফোন করেছিল,আসছি বউ।উতলা বউটি খুশীতে ডগো-মগো।প্রায় তিন বছর পর স্বামী আসছে।
থৈথৈ উতলা মন থেমে যায়।যখন সালমার ছোট ভাই ও শামীমের ছোট ভাই ঢাকা থেকে, ফিরে এসে বলে,শামীম ভাইয়ের রোগ হইয়িছে,কঠিন রোগ।পুলিশ বলেছে,করোনা হইছে,সে এখন ঢাকাতে হাসপাতালে থাকবে।
দড়বড়িয়ে বৃষ্টি হওয়ার দৌড়ের মত, হঠাৎ থেমে থেমে গুমড়িয়ে ওঠে, সালমার মনের ভিতর।সে যখন আগুন ঝাপ দেবে ভাবছিল, তখন আগুনটা দড়দড় করে, পানি ঢেলে দিয়ে নিবিয়ে দিলো,এই দুঃসংবাদ।
চৈত্রের জোছনাময় রাতে ঘরে শুয়ে,একা-একা এপাশ-ওপাশ করতে থাকে।সালমার শাশুড়ি আল্লা-আল্লা করে করে,কেঁদে-কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে।এখন শুধু সালমার আকুতি, বুকভরা যন্ত্রণা,ঢেউ ওঠা পানির মত উথলিয়ে উথলিয়ে উঁপচিয়ে পড়তে চায়। তিন বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে।ভরা কলস রেখে, হতভাগ্য স্বামী, ভাগ্য ফেরাতে বিদেশ যায়।টাকা-পয়সা কম পাঠায়নি বাড়িতে।অনেক অনেক টাকা পাঠিয়েছে।সে টাকা দিয়ে সুন্দর একটি বাড়ি বানিয়েছে।ছোট ভাইটার লেখাপড়ার খরচ দিচ্ছে।মাঠে দু'চার বিঘা জমিও কিনেছে।শুধু সালমায় বুকে পাথর বেধে, স্বামীর অপেক্ষায় থেকেছে। এসব ভাবতে ভাবতে, সালমা ক্লান্ত হয়ে যায়।পাড়াঘরের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরের চালের উপর টুপটাপ কিছু হুড়োজবর পড়ার শব্দ হলো।এরপর শ-শ-শ শব্দে, হালকা ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে।সালমা পাশ ফিরে শুতেই বুকের গহীনে বাতাসের অংশ প্রবেশ করে।বুকটা তার হালকা ভাবে প্রাণ ফিরে পায়।এতক্ষণ যে দম বন্ধ হয়ে আসছিল, তা থেকে একটু মুক্তি পায়।ঘর্মাক্ত ব্লাউজটা নিজের মাথাটা একটু উঁচু করে, খুলে ফেলে।অন্তর্বাসটা আর খোলে না।তবু জোরে নিঃশ্বাস নেয়।
শামীমকে ভেবে আর কি হবে?তবুও মনটা চঞ্চলা টুনটুনির পাখির মত, নেচে নেচে বেড়ায়।শামীম বাঁচবে তো?যদি মরে যায়,আর ফিরে না আসে? তার সামনে সাদা কাফনে মোড়ানো লাশের দৃশ্য ভেসে ওঠে।
গ্রামের মানুষ সবাই মিলে, খাটোয়া কাঁধে নিয়ে, গোরস্থানের দিকে যেতে দেখেছে বহুবার।সালমা যে ঘরে থাকে, ওই ঘরের বেশ দূর দিয়ে, গোরস্থানে লাশ নিয়ে যাওয়া দেখা যায়।অনেকদিন সে, জানালার পাশে এসে দেখেছে,ওই গ্রামের মৃত মানুষকে নিয়ে যেতে। তার শরীরের লোম নেই,তবুও যেন, যে কটা আছে, সেগুলো খাড়া হয়ে, কাটা হয়ে যায়।দ্রুত উঠে গিয়ে,জানালা বন্ধ করে দেয়।তার বড় ভয় করছে।জানালা বন্ধ করার সময়, আকাশের চাঁদের আলো এক ঝলক তার শুকনো মুখে লেগে, হারিয়ে যায়।বিছানায় গড়া দেওয়ার আগে, কিছুক্ষণ বসে থাকে।ব্লাউজটা দু'হাত উঁচু করে, পরে নেয়।তারপর কাঁইত হয়ে শুয়ে পড়ে।হাতের উপর মাথা রাখে।অমনি প্রতিদিনকার পথ আগলিয়ে দাঁড়ানো,সেই বদমাইশটার মুখোচ্ছবি ভেসে ওঠে।তার নাম মিয়াজান।শামীমের সহপাঠি ছিল।অথচ বিয়ে হওয়ার পর থেকে প্রায় এ বাড়িতে আসতো।তার চোখেমুখে ছিল একধরণের দুষ্ট হাসি।সালমা দেখেও না দেখার ভান করতো।শাশুরি ছেলের বন্ধু হিসেবে,তাকে বেশ যত্ন করে,আদর করে ডাকে,আয়সু বাপ-বইসু।
হতাশার এ রাতে, বার-বার তার মুখের ছবিটা,বোতামখোলা বুকের ছবিটা, গালজড়ানো হাসিটা সালমাকে মাদকের মত টানছে।মিয়াজানের মুখোচ্ছবি ছাড়া, সে আর কিছুই দেখতে পারছে না।বাইরে থেকে খুব ধীরে ধীরে বৃষ্টি পড়ার শব্দ ভেসে আসছে।সালমার উত্তপ্ত শরীরটা ধীরে ধীরে মিয়াজানের চোখে চোখ রেখে, হারিয়ে যায় ঘুমঘরে।ঘরের চাল থেকে বৃষ্টি পড়ে টিপটপ-টিপটপ....।