নলিনীর দ্বিতীয় চিঠি
আসহাবে কাহাফ
সকাল সাতটা বেজে উনিশ মিনিট, আমি তখনো পূজোর ঘরে শঙ্খধ্বনি দিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে, বাইরে থেকে কে যেন কলিং বেলটা বার বার বাজিয়ে যাচ্ছিল। তড়িঘড়ি করে পূজো শেষ করে দরজা খুলতেই দেখি ডাকহরকরা। অনেক বছর পর এই বাড়িতে আবার ডাকহরকরা এসেছে। আমার এখনো খুব ভালো করে মনে আছে; এই সেই ডাকহরকরা যিনি ২১ বছর আগে শেষবার এসেছিল। তখন তিনি মধ্যবয়সী যুবক আর আমি একেবারে তরুণ। এখন আমি হলেম মধ্যবয়সী আর তিনি বৃদ্ধ। আজ আবার নতুন করে বুঝে নিলাম, বয়স অনেক বেড়েছে, কালের অতলে হারিয়ে ফেলছি নিজের সোনালি যৌবন। তাহলে আমি কি তারুণ্য হারিয়ে ফেলেছি? ঠিক এই মুহুর্ত্বে সেটা নিশ্চিত করে বলা কিংবা কারও কাছে প্রমাণের ইচ্ছে শক্তিটুকুন আমার নেই। বৃদ্ধ মশাই দাড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলবেন? কারও ডাক এসেছে? উত্তরে বাবু মশাই বলল; হরিনাথ বাবুকে? গতকাল, কলিকাতা হতে তাহার নামে একখানা ডাক এসেছে। ডাকের উপর আর্জেন্ট লিখা ছিল তাই দ্রুত নিয়ে এলাম।
বৃদ্ধ ডাকহরকরা মশাই হয়তো মনে করতে পারছেন না, ঠিক ২১ বছর আগেও তিনি আমাকে এই রকম আর্জেন্ট লিখা একটা চিঠি দিয়ে গিয়েছিল; আর সেটাই ছিল এই বাড়িতে তার শেষ চিঠি। বয়স হলে যা হয়, আমি কিন্তু ঠিকই তাকে চিনতে পেরেছি। আফসোস, এই সময় এই স্মৃতি একদিন আমারও বিলুপ্তি হবে। একদিন আমাকে দেখেও কেউ একজন স্বগতোক্তি করবে! গোপনে স্মৃতি হাতড়াবে! তিনি যথারীতি চিঠি হাতে তুলে দিয়ে প্রাপ্তিস্বীকারপত্রে সাক্ষর আদায় করে বিদায় নিলেন। আমার গৃহদ্বারে পড়ে রইললাম শুধু চিঠি সমেত আমি ও আমার পুরোনো স্মৃতির একঝাক না বলা প্রশ্ন। ভাবছি চিঠিটা খুলেই ফেলি; পড়ে দেখি ভিতরে কী লিখেছেন! কিন্তু পূজোর ঘরের কথা ভেবে রেখে দিলাম। চিঠিটা কার তা এই মুহুর্ত্বে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়; চিঠির উপর নাম লিখেছেন রাম দত্ত। পাশে ব্র্যাকেটে লিখেছেন কেউ একজনের পক্ষে। বেশ মনে ধরেছে কথাটা। এর আগেও অনেকে আমাকে এই ধরনের চিঠি লিখেছেন, তখন আমি এফএ ক্লাসের ছাত্র ছিলাম। মাঝে মাঝে পত্রিকায় লিখতাম বলে, কেউ কেউ চিঠি লিখিত আর খামের উপর বিভিন্ন রসিকতাপূর্ণ শব্দ লিখত। নলিনীর বিয়ের পর লেখা-লেখিও ছেড়ে দিলাম; চিঠি আসাও বন্ধ হয়ে গেল। চিঠিটা রেখে সোজা চলে গেলাম পূজোর ঘরে।
সব কাজকর্ম গুছিয়ে বেলা এগোরোটার দিকে চিঠিটা হাতে নিলাম। খুলে দেখার আগে প্রায় বার দশেক চেষ্টা করলাম রাম দত্ত বাবুকে চেনার, কিন্তু কিছুতেই আন্দাজ করতে না পেরে অবশেষে চিঠিটা বের করলাম। চিঠির হাতের লিখা ও ভাষা বেশ পরিচিত, তবে কে লিখেছে সেটা মনে করতে একেবারে সময় লাগে নি যে তা নয়, কেননা, চিঠির ভাষা কখনই একজন পুরুষের ছিলো না, ফলে শেষ পর্যন্ত পড়তেই হল। মাঝখানে বেশ কিছুক্ষণ আমাকে থামতে হয়েছে; ফিরে যেতে হয়েছে ছাত্র জীবনের শেষ অংশে। চোখের সামনেই ভেসে উঠেছে একুশ বছর আগের লিখা নলিনীর সেই প্রথম চিঠি; যেখানে নলিনী লিখেছেন-
তাং- ১ লা জুলাই ১৯৯৫ইং
প্রিয় নাথ,
প্রারম্ভে ভক্তি নাথের চরণে; অতপর আমার প্রাণ নাথের কদমে। প্রাণ নাথ, আজি বড়ো ব্যথা বক্ষে লইয়ে তোমাকে পত্র লিখিতে বসিলাম। পাশাপাশি থাকি বলিয়া কোনদিন আমাদিগের চিঠি লিখিয়া মনের কথা বলিতে হয়নি। আজিই প্রথম ; হয়তো আজিই শেষ! প্রাণের শৈশবসঙ্গী বলিয়া যাহারা তোমার আমার সম্পর্ক চাপিয়ে যাইতেছে তাহাদের কি বলিয়া অভিশাপ দিব তাহা আমার জানা নেই। তবে কি বলিয়া এই মুহুর্ত্বে তোমার আমার বিচ্ছেদ টানিয়া লইব সেই চেষ্টা করিতেছি। প্রাণ নাথ, গত দুই তিন রাত্রিকাল যাবত, আমি কিছুতেই নিদ্রা যাপন করিতে পারছি না। যখন দেখি পরিবারের সবাই কলিকাতার ভদ্রপতির সহিত আমার বিবাহের কথা বলাবলি করিতেছে। আমরা একত্রে বড় হইয়াছি, খেলাধুলা করিয়াছি তাহা সকলে দেখিয়াছে ঠিকই কিন্তু আমাদিগের মনের মিলন কেহ দেখিয়াছে বলিয়া মনে হইতেছে না। আমরা একে অপরকে কতটা নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছি তাহা কেহ বিশ্বাস করিবে না, কেহ যদিও বিশ্বাস করিবে বলিয়া মনে হইয়াও থাকে তবে এই কথা সত্য যে, এমতাবস্থায় আমি অথবা তুমি কাহারও সম্মুখে, সম্পর্কের কথা তুলিয়া ধরিবার মত যোগ্যতা অর্জন করিনি। এখনো আমি আর তুমি সবেমাত্র এফএ ক্লাসে পড়িতেছি। এই অবস্থায় যেকোনো পিতা-মাতা আমাকে তাহার পুত্রবধু করিয়া লইতে আপত্তি না করিলেও এফএ ক্লাসের একজন ছাত্রের সহিত মেয়ের বিবাহ দিতে আমার মাতা-পিতা ঠিকই আপত্তি জানাইবেন। তোমাকে শুধুমাত্র এফএ ক্লাসের ছাত্র ও বেকার বলিতে আমার কেনো জানি সংকোচবোধ হইতেছে, তুমিতো ইতোমধ্যে লেখা-লেখি শুরু করিয়াছ, পত্র-পত্রিকায়ও তোমার কিছু কিছু লিখা ছাপাইতেছে। তারপরও তুমি তাহাদিগের কাছে কর্মহীন, কেনন, এই সমাজে নগদ অর্থ ব্যাতিত কারও প্রতিভার মর্ম বুঝিতে পারিবে এমন মনমানসিকতা সবার তৈরী হয়নি। প্রাণ নাথ, তাই আমি অনেক ভাবিয়া দেখিলাম কলিতার ভদ্রপিতকে বিবাহ করিয়া লওয়াই উত্তম হইবে। আরেকটি কথা বলিয়া লই, আমি হয়তো কথাগুলি খুব সহজেই বলিয়া লইতেছি দেখিয়া তুমি অবাক হইবে! আমাকে লইয়া নানা খাটো কথা মনে মনে উচ্চারণ করিয়া থাকিবে। তারপরও হে প্রাণনাথ, এই কথায় সত্য যে; আমি তোমার সহিত যা করিয়াছি তার পুরোটাই ছিলো আমার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ওখানে বিন্দুমাত্র ত্রুটি কিংবা ছলনা ছিলো না। প্রাণনাথ, আজি এই কথাগুলো তোমাকে বলিতে পারিলেও নিজের ভিতরে যে কারবালর রক্তক্ষরণ বহিয়াছে তাহা আমি দেখাইয়া বুঝাইতে পারিব না। আগুনে সব কিছু জ্বলিয়া যাইবার পরে আগুনের যে স্তুপ হয় সেখানেও আগুনের একটা দহন থাকে; যা কেহ দেখিতে পারে না। সেই একইরকম আগুনের তীব্রতা আজি আমার বুকে। প্রাণনাথ, আমি হয়তো মরিতে পারিলেই বাঁচিয়া যাইতাম ; কিন্তু আরও অনন্তকাল তোমার ভালোবাসার বিরহে প্রজ্জ্বলিত হওয়ার স্বাদ গ্রহণের জন্য বাঁচিবার ইচ্ছে জাগে। হয়তো পৃথিবীর কোনো একজায়গায় বসিয়া নিরবে তোমার স্মৃতি মন্থন করিয়া দুফোটা চোখের জল ফেলিয়া আরও শত বছর বাঁচিয়া থাকিব। প্রাণনাথ, আমাকে এই চিঠির প্রতিত্তোর করিবে না। এই চিঠি যখন তোমার হাতে পৌছাবে তখন আমি অন্যের ঘরণী। আমার জন্য দুঃখ না করিয়া, তোমার জীবনকে জীবনের পথে বয়তে দিও। বাঁচিয়া থাকিলে কোনো দিন তোমার সম্মুখে আসিব না, আবার জীবন থাকিতে তোমাকে এক মুহুর্ত্বের জন্যও ভুলিয়া যাইব না। প্রাণনাথ, বিদায় জেনো।
ইতি
নলিনী ব্যানার্জী।
আমি অবশ্যই তখন এক প্রকারে বাকশক্তিহীন হয়ে পড়েছিলাম। নলিনীও বিয়ে করে কলিকাতা চলে গেলো। সেই যে গেলো আর কেউ কারও সাথে কখনো যোগাযোগ করিনি। আজ ২১ বছর পরে এসে, আবার নলিনী আমার চোখে জল এনেছে! মনের আকাশে কালো মেঘ, সেই মেঘ হতে বৃষ্টিপাত! অতপর ভালোবাসার গন্ধ মেখে আখি জলে স্নান। এটা নলিনীর দ্বিতীয় চিঠি; প্রায় তিন তিনটা রাত জেগে সে আমাকে লিখেছে-
তাং-১২/০৭/১৭ ইং
প্রিয় নাথ,
প্রারম্ভে প্রণাম রইল। হয়তো কিছুটা বেগ পাইতে হইবে এই চিঠির কারণ বিষয় প্রেরক ইত্যাদি খুঁজিয়া পাইতে। তবে নিশ্চয় জানিবে, এই চিঠি নারী জাতির কোনো একজন লিখিয়াছে; যে কিনা যৌবনকালে আপনাকে ভালোবাসিয়াছিল। শুনিয়াছিলাম আপনি বিবাহ করেননি। সেটাই উত্তম করিয়াছেন। আমি বিবাহ করিয়াও সেই আপনার ভালোবাসাটা ভুলিতে পারি নাই। ইতোমধ্যে আপনার প্রকাশিত বেশকিছু বই আমি পড়িয়াছি। আমার সাহেবও আপনার লিখার দারুণ ভক্ত। সেই হিসেবে আপনার বই পড়া। প্রায় তিন রাত জাগিয়া আপনাকে এই পত্র লিখিতেছি, একবার লিখে ভুল হয় ভাবিয়া আবার লিখি। আমার স্বামী আড়াল হইতে দেখে আর হাসে। সে আপনার আমার বিষয়ে সব জানিয়াছে; হয়তো আমি মরিবার পরে সে এই চিঠিটা তোমার কাছে পৌছাইয়া দিবে। আমি মরিলে আপনাদের বাড়ির সম্মুখের পুকুরে, আমাকে মনে করিয়া একখানা লাল গোলাপ ছুড়িয়া মারিবেন। আজি ২১ বছর পরে আসিয়া এই চিঠি লিখিবার পিছনে একটিই কারণ রহিয়াছে, যাহার জন্য আপনি মনে মনে আকুল হইয়া উঠিয়াছেন! আমার বড্ড জানিতে ইচ্ছে করে- আপনি বিবাহ করেননি কেন? আমাকে ভালোবেসে নাকি অভিমানে? উত্তর করিতে হইবে না। কেবল আপনার নিজের কাছে উত্তর করিলে হইবে। কেননা, এই চিঠি যখনি আপনার হাতে পৌছাইবে, তখন আমি গত হইব। প্রাণ নাথ, ভালো থাকিবেন।
ইতি
নলিনী রাম দত্ত
কলিকাতা, ভারত।
পাঠান্তে, ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। এবার নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম, এই একাকী জীবনের কারণটা কি নলিনীর ভালোবাসা নাকি চাপা অভিমান? কোনো প্রতিত্তোর নেই হৃদয়ের গভীরে। কেবল চোখে বেয়ে নিচে নেমে এলো কয়েকফোঁটা জল।