পদাবলি

 



ডুবুরী হওয়ার গল্প

আশরাফ চঞ্চল 


কতটা গভীরে গেলে ছুঁয়া যায় জল

মাপা যায় গভীরতা

নদীর অতল?

সাঁতার জানো না তাতে ভয় কী

সাহস রেখে নেমে পড়ো

হাত নাড়াও

পা নাড়াও

একদিন সব শিখে যাবে।


বেশিক্ষণ দম থাকেনা?

তবে শোনো-

প্রমথেই ডুব দিওনা

ওপরে ওপরে ঘুরো

হাত চালাও

ঠোঁট চালাও

ঢেউয়ে ঢেউয়ে সব জল ঘুলিয়ে দাও

শৃঙারে শৃঙারে ডুব দিয়ে ওর পতন ঘটাও


পারো যদি নিয়মিত দুধ কলা খাও

মাঝে মধ্যে ডিম

কালোজিরা 

মধু 

কস্তুরী 

হেকিমি শা¯্রে এগুলো নাকি শক্তি বাড়ায়!


একটি কাজ একইভাবে বারবার করোনা

প্রতিবার কাজে নতুনত্ব আনো

শুধু দক্ষিণে কেনো

উত্তরেও যাও

পূর্বে

পশ্চিমে গেলে

কেঁপে কেঁপে উঠবে সমস্ত জল

নদীতে জোয়ার আসবে

স্রোত বইবে।


এভাবেই তুমি একদিন দক্ষ সাঁতারো হবে

অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই

ডুবুরী হয়ে ছুঁয়ে আসবে নদীর পাতাল

বউ বলবে, তুমিই শ্রেষ্ঠ পুরুষ

ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট! 




ঘুমের মৃত্যু

জয়িতা চট্টোপাধ্যায়


একটা শব্দে মৃত্যু হল সমস্ত ঘুমের

যে শব্দ ছিল হত্যার

বুকের উঠোনে, দিগন্ত রেখায়

কালো রং ছড়িয়ে যাচ্ছে

কে যেন ভালোবাসা পুড়িয়ে দিল আগুনে

সুরঙ্গে লুকোনো ছিল পুরোনো বারুদ

নিমেষেই চিতাভস্ম ছড়িয়ে গেলো

শীতের প্রবাহিত খরগ, ছিন্নভিন্ন মেঘ

ইতিহাস হারা সমস্ত গল্প,

গুহার ছবির মতো ভেঙে গেল 

মুখের চেনা ধ্রুবতারা

কালশিটে পড়া শীত কালের অবসান হল।




এতো সহজে ভোলা যায় না

জহিরুল হক বিদ্যুৎ


এতো সহজেই কী ভুলে থাকা যায়?

মৌন রাতের অবগুণ্ঠন সরিয়ে

যে চোখের পাতায় নেমে এলো কবিতা

জলের গানে স্নিগ্ধ প্রভাত হলো লীন

চায়ের কাপে মায়া ছড়ালো যে ওষ্ঠের চুম্বন

ঠুনকো অভিমানে কী ভুলে থাকা যায়?

হয়তো আবেগের ছলে বেহিসাবি ভুলে

মনখারাপ নিয়ে শুধুই ভুলপথে ছুটে চলা-

মায়ার শেকড় ছড়িয়ে আছে গভীরে,

বিস্তৃত প্রান্তর, রয়ে যায় জন্ম-জন্মান্তর

যেখানে মায়া নেই

সেখানে ভালোবাসাহীন ধূধূ মরুভূমি।

মায়ার কাটা বিঁধেছে যে বুকে

সে বুক তুমিহীনা মরে ধুঁকে ধুঁকে।



      

এক পলক দেখে যাওয়া

আদনান আল মিসবাহ


সেদিন

আলাপনের শুভ্রতা প্রদীপের মতো ছিল না 

সিঁড়ির শেষবিন্দুতে উপনীত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে

কোলাহলের বিরক্তিকর শরীর ক্ষতবিক্ষত করেছে 

নাতিদীর্ঘ পথ পেরিয়ে তোমার 

এক পলক দেখে যাওয়া


বাঁ দিকের গলি থেকে উদ্ভাসিত 

প্রেয়সীর মুখ 

চোখাচোখি হওয়ার মত বাহারি দৃশ্য ছিল না 

নদীর মতো নিরবধি বয়ে যাওয়া বিস্ময়ের মাথা

কুঠারাঘাতের নির্মমতায় থমকে দিয়েছে 

ভ্রুকুঞ্চিত শ্রীমান মুখাবয়বে তোমার 

এক পলক দেখে যাওয়া


সময়ের পরিসীমা 

বাঁধন ছিন্ন করার মতো তীব্র বেগবান ছিল না 

অসংখ্য প্লেটের ঝনঝনানি 

কোনরূপ পূর্ব সংকেত ছাড়া আচমকা মরে গেছে 

এমনকি-

মিনিট সেকেন্ডের অমোঘতাকে হত্যা করতে পারে 

কৌতুহলী মননের মৃদু তাড়নায় তোমার 

এক পলক দেখে যাওয়া


ক্ষনিকের ম্রীয়মান কথকতা

খুব বেশি রসালো আবেগপূর্ণ ছিল না 

বাক্য শেষ হওয়ার আগেই প্রশ্ন চিহ্ন 

শরীরের লোমগুলো দ-ায়মান 

যেনো ডিসেম্বরের কুচকাওয়াজ 

আতঙ্ক, ত্রাস, হুমকির মতো ভয়াবহতা ছড়িয়েছে

ঈর্ষান্বিত রক্তচক্ষু নিয়ে তোমার 

এক পলক দেখে  যাওয়া



শিক্ষিত নপুংসকের কবলে

রেজা কারিম 


কিছু শিক্ষিত নপুংসককে আমার চারপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখি

খুব রাগ হয় আমার 

বুকের ভেতরটা রাগে গজগজ করতে থাকে।


আমার ধারণা এরা এমন ছিল না

এদের পুরুষত্ব ছিল 

কিন্তু কিছু দায়িত্বের কারণে 

কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে

এরা আজ পুরুষত্বহীন।


কী ভাবছেন? 

এরা কি আসলেই ফিজিক্যালি অক্ষম?

না, মোটেই তা নয়।


এরা নামে পুরুষ কামে পুরুষ 

ঘামে পুরুষ পামে পুরুষ

আক্ষরিক নয় ভাবার্থে ভাবুন

প্রত্যক্ষ নয় পরোক্ষভাবে দেখুন

খুঁজে পাবেন আমার কবিতার সত্যতা।


এদের হৃদয় নেই 

বিবেক ঘুমন্ত কিংবা মৃত

বাইরে চাকচিক্যময় 

ভেতরে শূন্য, মহাশূন্য

মাকড়শার জালের মতো এরা আমায় আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে রেখেছে 

একদিন আমিও এদের মতো নপুংসক হব

আমার কাপুরুষোচিত আচরণ তারই ধ্রুব বহিপ্রকাশ।


তবু হৃদয়ের কোথায় যেন এদের জন্য আমার সীমাহীন ঘৃণা রয়েছে 

আসলে আমরা অনেক কিছুই মেনে নেই 

কিন্তু মনে নেই না।



অদৃষ্ট মঞ্চ

রহিত ঘোষাল


এখন খুব নিরিবিলি চারিদিক,

এখন সূর্যের তেজ কমে এসেছে,

ভেড়ার পাল বাড়ি ফিরছে,

গাঁয়ের মুরুব্বিদের ভিড় সাঁঝেরবেলা

চায়ের দোকানে, ওরা বলাবলি করে,

দেশে কি মানুষ আছে গো!

মানুষ নেই, সব এক একটা জানোয়ার!

আরো কত সাতপাঁচ কথা, 

এইসব দশা ছেড়ে উঠে আসি

আমাদের জৈব পাঁজরে সংকট

নিকটতম অক্ষমতা জন্ম দেয় উগ্রপ্রকৃতির

দিগন্তপ্লাবী আমাদের এই জৈবনিক দ্বন্দ্ব

ত্রসরেণু হয়ে ইহজন্মের সকালে পরিণত হয়।


তিতাসের মেয়ে

নাঈমুর রহমান


তিতাসের মেয়ে মিস দেবনাথ,

তোমার শরীরে এখনো বয় তিতাসের জলের ঘ্রাণ?

পৌঁছায় কি তোমার কানে আজও

ভরা যৌবন তিতাসের আহ্বান?

অথচ তিতাস এখন ছোট, ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে।

আর বেড়ে গেছো তুমি, তোমার ঘাড়ে পরা চুল থেকে

এখন আর ঝরেনা টুপটুপ তিতাসের জল

সে চুল ছুঁয়েছে এখন নিতম্ব।

তিতাস পাড়ের কাদা-বালি মাখা পা দুটো

করছে পদচারণ শহর রংপুর, জেনিস সু তে।

তিতাসের কিনারায় এসে আজও জড়ো হয় বকের ঝাঁক

আছে কিছু মাঝি-মাল্লার চিৎকার।

কিন্তু কেউ আর তোমার মতো দেখেনি

বলেনি কেউ করছো কি, তিতাস যে ছোট হয়ে হয়ে যাবে।

হয়ত তখন ছোট ছিলে, খুব ছোট

যখন বলেছো তিতাস আমার বাড়ি, তিতাস মা।

তুমি ছেড়েছো তবে তিতাসের পাড়, ভুলেছো তার স্বর

তিতাস তোমায় রেখেছে মনে তার প্রতি আর্তনাদে।

তিতাসের মেয়ে মিস দেবনাথ,

তুমি ফিরবে কি তিতাসের কোলে একবার?


নব প্রবাদ

মোহাম্মদ আবদুর রহমান


হাসনা তোমার হৃদয়ের কিউ আর কোড নিয়মিত স্ক্যান করতে থাকি

রক্তের ও গ্রুপ হয়ে নিংড়ে দিতে থাকি অসীম প্রেম

চেক করে দ্যাখো তোমার হৃদয়ের অ্যাকাউন্ড।


বন্ধন সৃষ্টির সময় ফেবিকুইক দিয়ে জুড়ে দিয়েছিলাম দুটি অন্তঃকরণ

আমি পৃথিবীর মত ঘুরতে থাকি হৃদে জেগে থাকা জ্যোতিষ্কের চারিদিকে।

জোনাকি হলেও অন্ধকার হতে দিইনি জীবনের পাঠশালা

প্রাণদ্বয় মিশে তৈরি হয়েছে একটি নব যৌগিক পদার্থ

গগন বক্ষে উড়বে নব প্রবাদ


মৃত্যু প্রহর 

এম সোলায়মান জয় 


কিছু মানুষ বা কিছু শহরের মরে যাওয়া উচিত

পুনরায় বেঁচে থাকবে কিংবা অন্ধকারে আসক্ত হবার জন্য

অনুভূতি নিঃস্ব হয়ে গেলে কুয়াশাচ্ছন্ন হয় রাজার প্রাসাদ

কোথায় যাচ্ছো? এমন প্রশ্ন করার অধিকার হারিয়ে যায়

যখন তুমি চলে যাও সাথে করে নিয়ে যাও নিজের আলো

ছায়া চলে গেলে আলোর প্রয়োজন থাকে না শরীরের

মায়া মরে গেলে কোন অন্তরের প্রয়োজন থাকে না

বন্যার শেষে ভেলার মতো যেন সবকিছু অযথা হয়ে যায়

পরাজিত রাজার মতো সময় তখন মৃত্যুর প্রহর গুনে।



তোমার হোক

আব্দুল্লাহ আল আম্মার

[উৎসর্গ : আমার বড় খালা]


এই পুষ্প বৃক্ষের ফাঁক গলে আসা রূপোলি চাঁদের কিরণে, 

সান্ত¡না খুঁজে পাইনি

অজস্র নিহারের এ সজীবতার মাঝে আমার চির পরায়ণ, 

তবু সান্ত¡না খুঁজে পাইনি


দুঃসাধ্যকে মেনে নেয়ার পৃথিবীতে কভু অবগাহনের তুষানলে পুড়ে ছাই 

মায়াবদ্ধ হৃদয়েরও সীমাবদ্ধতা আছে টের পেয়ে অস্তিত্ব হারাই, 

নিঠুর বাস্তবতাকে মানতে না পারা দুফোঁটা অশ্রুর স্রোতে 


ব্যর্থ মন রথে তবুও রয়ে যাওয়া 

দূর থেকে বহুদূর 


স্বপ্ন বয়ে আনা অজস্র নিহারের মাঝে এই সুখটুকু 

আমার না হোক, 

তোমার হোক 

এই ঘুমন্ত শহরের নিঝুম রাত্রির জেগে থাকা শোভান্বিত তারাগুলোর শোভাটুকুও 

তোমার হোক 

সুবাসিত এই পুষ্পবাটিকার নিষ্পাপ পাপড়িগুলো, 

তোমার পরে উৎসর্গিত হোক 

সুবাসটুকু তোমার হোক 

তোমার হোক। 




শুভ্র মেঘের মানুষ

গাজী তৌহিদ


কখনো কখনো হাতের মুঠ খুলে-

সবকিছু ছেড়ে দিতে হয়,

যে যাওয়া সে তো যাবেই।

শরতের শুভ্র মেঘের মতো,

গভীর সমুদ্রে আশা জাগানিয়া জাহাজের মতো,

টুপ করে ডুবে যাক,

নিমিষে মিলিয়ে যাক,

খোঁজ নেওয়ার দরকার নেই;

বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়ে আপন মানুষ ডেকে আনা যায় না।

দাঁতে দাঁত চেপে ভুলে থাকা শিখতে হয়,

গ্রানাইট পাথরের মতো,

কিউ কার্বন পদার্থের মতো,

হৃদয়টা শক্ত করে মানতে হয়-

হাতের মুঠ খুললে স্বাধীন হওয়া মানুষ,

অজুহাতে শরৎ শুভ্র মেঘে মিলিয়ে যাওয়া মানুষ,

কখনো আপন মানুষ হয় না।



পানির অভাবে রক্ত খাবে

হিলারী হিটলার আভী 


পানির অভাবে রক্ত খাবে 

এটা একদিন কবিতার লাইন হবে!


খাদ্যের অভাবে মানুষ মানুষকে কামড়ে খাবে 

এটাও একদিন কবিতার লাইন হবে! 


স্বার্থের মোহে নীতির বিসর্জন দিবে 

এটাও একদিন কবিতার লাইন হবে!


‘একজনও ভালো মানুষ নেই’

এটাও কেয়ামতের আগে কবিতার বাস্তব লাইন হবে! 


সব যান্ত্রিক কল’ই একদিন বিকল হবে 

এটা আজ থেকেই আমার কবিতার লাইন হলো!



নিঃসঙ্গ, বড় একা

আহমদ সাইফ 


দিনশেষে নীড়ে ফেরা পাখি একাকিত্ব বোঝে না!

সারি সারি বৃক্ষকেও একাকিত্ব পায় না।

লক্ষ কোটি নদীর ঢেউ কখনো একা হয় না,

পাহাড়ের সীমাহীন উচ্চতা আকাশ ছুঁতে চায় ;

মরুভূমির ধূ-ধূ বালু অসীম দৃষ্টিকে ছাড়িয়ে যায়! 

গাঁয়ের মেঠোপথ সাপের মতো এঁকে বেঁকে হেঁটে যায়।

মাঠের আলে জন্মানো দূর্বাঘাসও দলছুট হয় না!


শুধু-

মানুষ নিঃসঙ্গ-নিরবতায়-একাকিত্বে যাপন করে শতাব্দীর পরিসংখ্যান! 


দিনশেষে মানুষ ফেরারি আসামীর মতো নিঃসঙ্গ, বড় একা!



দূরত্ব 

ইয়াসিন আরাফাত


বিস্তৃীর্ণ মরুভূমির বুকে

খা খা রোদ্দুরে

যাযাবর বাতাসের পাঁকে 


ক্লান্ত পথিক

তৃষ্ণার্ত পথিক

ভুল করে পথ হারালে-


সে জানে

নির্মম দূরত্ব কাকে বলে!




গণতান্ত্রিক প্রেম

ফাহাদ আজিজ


আমাদের প্রেমটা হয়েছিল গণতান্ত্রিক নিয়মে;

যেখানে তুমি ছিলে একজন চতুর নেতা, আর-

আমি ছিলাম রাজনীতিতে ব-কলম, সহজ-সরল

সামান্য এক ভোটার। তুমিই তো স্বপ্ন দেখিয়েছিলে না?

কিন্তু আমিতো বুঝি নি;

গণতন্ত্রের সবকিছুই মিথ্যা। 

এখানে আশ্বাসকে বিশ্বাসে পরিনত করার কোনো নীতি নেই। 


তবে এখন বুঝি;

গণতন্ত্র কেবল স্বপ্নই দেখাতে পারে 

স্বপ্ন পূরণের সাধ্য গণতন্ত্রের নেই।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট