মানুষের মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ দেখি !
জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
মানুষের পড়ে থাকা দেখলে আগভাতের ওম জাগে শরীরে। রাশি রাশি পোড়া রোদের শনিকও বিঁধে হাড়ে হাড়ে; শিরা-উপশিরায়। আজকাল আরেকটু বেশি বেশিই হচ্ছে এরকমটা; কেন হচ্ছে, আন্দাচ করতে পারছিনা । মানুষের প্রতি বিশ্বাস কমে আসছে নাকি মানুষের প্রতি ঘৃণা জুমছে নাকি মানুষের প্রতি আলাদা এক প্রকার বিরাগের সৃষ্টি হয়েছে; অনেক ভেবে ভেবেও যখন কোনো কারণ বের করতে পারলাম না; তখন নিজের প্রতি দোষ দিতে শুরু করলাম; নিজেকেই বিশ্বাসের জ্যামিতিক রেখার সাথে গরমিল করে নিলাম । দু পায়া মানুষের প্রতি এমন বর্ণবিরোধের কারণ খুঁজতে নিজেকে একটু সময় দিতে চাই; একটু সময় নিতে চাই ।
২
কালু চাচার সাথে পানাইমোড়ে এক ছোট টঙ দোকানের মাচাঙে বসে লাল চায়ে ঠোট ভিজিয়ে ভিজিয়ে বলছিলাম লাল-নীল কতকথা । এক পর্যায়ে চাচা আমায় প্রশ্ন করে- ভাতিজা; এখন কি করছো ? অবাকই হলাম বটে । ছোট থেকে বড় হতে দেখল । কখন কি করছি, কখন কি করতে যাব, সব জেনেছে; আর এখন আমি কি করি কালু চাচা সেটা জানেনা; উদ্ভট এক রাগও হলো। চেপে গেলাম। বললামÑ এই তো চাচা, অনার্স শেষ করলাম। চাকরি-বাকরি করব ভাবছি । কালু চাচা আমার তাকিয়ে সহজ স্বাভাবিক উত্তর করে- ভালো; ভাতিজা, তয় আমি বহুত দেখছি পড়াশোনা কইরা কিছুই হয় না; আমগো সময় পড়াশোনার দাম ছিল; নাম ছিল; আর এখন পড়াশোনা কইরা মানুষ চোর হয়, বাটপার হয়, সবচে বড়কথা টাকাখোর হয় মানে ঘুষখোর হয়; যা আমি কোনোদিন চিন্তাও করতে পারিনি; এখনকার মানুষগুলারে ভাবতে গেলে অস্থির হয়ে যাই, থাক, ভাতিজা, আমার একটা কাজ আছে; পড়ে কথা কমু; আর আমি বুঝতে পারছি আমার কথা তোমার ভালো লাগে নাই, ভালো না লাগারই কথা । সময় করে সব কমু তোমারে; থাক, ভাতিজা ।
কালু চাচায় আমায় কথা বলার কোনো সুযোগ দিল না বলে কিছুটা মনক্ষুন্ন হলাম । আবার অবাক হলাম; পড়াশোনা নিয়ে অগত্যা তার সব ব্যাক্তিক মতবেদ শুনে ।
৩
চোখ খুলে একটু চারপাশ তাকাই; মানুষ দেখি। কত রঙের মানুষ; কত ঢঙের মানুষ, আহ ! এই মানুষের মুখের আরো কত মুখ; লাল মুখ, নীল মুখ, কালো মুখ, সাদা মুখ, আহা ! মানুষের মুখের উপর কত মুখের ছড়াছড়ি, কত মুখের বসতি ! মানুষের ভেতর কত মানুষ ! মানুষের ভেতর কত পশু ! মানুষের ভেতর জানোয়ার ! মানুষের মিছিলে হাটতে হাটতে মানুষ দেখি ! মানুষের ভীড়ে মানুষ দেখি ! মানুষের কেমন যেন হয়ে গেছে ! মানুষেরা সুন্দরের বিপরীতে আছে ! মানুষেরা সরলের বাহিরে আছে, মানুষেরা আলো ছেড়ে অনেক দূরে আছে ! আজকাল মানুষেরা মানুষ নেই ! মানুষের দ্বৈরথে মানুষে সেজে আছে, আহা ! মানুষ, আহা ! মানুষ ।
এতদিনে মানুষের প্রতি অনিহা, ঘৃণা, বিরাগের কারণ খুঁেজ পেলাম; কালু চাচার অর্ন্তপ্রয়াসগুলোও আজ বুঝতে পারছি; মানুষের প্রতি আমার যেমন বাঁকা দৃষ্টি তৈরি হয়েছে; তেমনি কালু চাচার মত হাজার মানুষের ভেতরেও অন্য মানুষের প্রতি এমন অনিহা, অশোভন ব্যক্তিক ভাবনা তৈরি হয়েছে যা; আমরা মানুষ নিজেরাই করেছি আমাদের অনৈতিক; অপাঙক্তেয় রীতি-নীতির আবাস ছড়িয়ে চারপাশ ।