মতি সাহেবের মাতামাতি
ইজাজ আহমেদ মিলন
স্মৃতি ভ্রম রোগে আক্রান্ত মতি সাহেব। ভালো নাম মতিউর রহমান। পূর্বের কোন স্মৃতিই তার মনে পরে না। স্মৃতিগুলো তার সাথে একের পর এক প্রতারণা করে যাচ্ছে। একটু আগে কী করেছন, এখন দিব্যি সেটা ভুলে যাচ্ছেন। এ কারণে মতি সাহেবের সমস্যা হলেও বাড়ির কাজের ছেলে সাদ্দামের বেশ সুবিধাই হয়েছে। প্রতিদিন পকেট থেকে শ’শ’ টাকা মেরে দিচ্ছে সাদ্দাম। এ সবের কিছুই বলতে পারেন না মতি সাহেব। তার সমস্ত স্মৃতি গ্রাস করে ফেলেছে একটা স্মৃতি। ভয়ংকর সে স্মৃতি। ভয়ংকর বীভৎস্য। দৃষ্টিতে স্থির হয়ে আছে সে স্মৃতি।
‘কত করে কইলাম! দেয়ালে টানানো ফটোটা নামিয়ে ফেল, কথা শুনলি না। ওই ফটোর ওপর আমার চোখ পড়লে আমি আর স্থির থাকতে পারি না। আইজই ফটো নামাইবি,নইলে এই ঘরে আমি থাকমু না। ’ হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে রাতে সাদ্দামকে মতি সাহেব বলছিলেন কথাগুলো।
ইচ্ছে করলে তিনি নিজেই দেয়াল থেকে ছবিটা নামাতে পারেন। কিন্তু ওই ছবি তিনি স্পর্শ করবেন না। নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মতি সাহেবের শোবার ঘরের পশ্চিম দেয়ালে কাঠের ফ্রেমে বাধানো একটা ছবি। বার বছর বয়সে তোলা ছবি। মুখের ডান দিকে ঠিক চোখের নিচের অংশে ছোট একটা তিলক। সাদা কালো ওই ছবিতে রিফাত ঈষৎ উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখের একটা অংশ দেখা যায়। অন্য অংশ আলো ছায়ায় আবছা। কী মায়াবী চেয়ারা!
মতি সাহেবের বিয়ে করার কখনো স্বাদ জাগেনি। তবে একটি পুত্র সন্তান পালন করার প্রবল ইচ্ছে। সমস্ত দরদ ঢেলে তাকে আদর করবে এমন মানসিকতা পুষে আসছেন বহু দিন ধরে। তার অঢেল ধন সম্পদ কে ভোগ করবে ? মরে গেলে অন্তত একজন উত্তরাধিকার থাকা দরকার। বংশের একটা প্রদীপ রেখে যাওয়া চাই । হোক সে মেয়ে কিংবা ছেলে । নিশ্চয় সে সন্তান নিজের ঔরসজাত হতে হবে। বিয়ে না করলে কীভাবে সম্ভব সেটা ? নারী বিদ্বেষী মতি সাহেব তার সিদ্ধান্তে অটল। বন্ধু বান্ধব আত্বীয় স্বজন কারো বুঝই তাকে সিদ্ধান্ত থেকে সরাতে পারেনি। নারীরা হলো ভোগের পণ্য । এরা কখনো শয্যার চির সঙ্গী হতে পারে না। এমন নানা যুক্তি তার মুখ থেকে বের হয় প্রায় সময়ই।
মতি সাহেব ধর্মকর্ম তেমন একটা করেন না। বছরে দু’ঈদের নামাজ আদায় ছাড়া ধর্মের কোন পূণ্য তার ঝুড়িতে নেই। নিজের কষ্টার্জিত অর্থ মানুষকে দিয়ে সেবা করার প্রশ্নই আসে না। তবুও সামাজিকতা রক্ষার জন্য গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে কিছু অর্থ দেন , সেটা বাধ্য হয়ে। এলাকার উঠতি বয়সের ছেলেরা আসে , না দিয়ে আর পারেন না। এমনই এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে একবার তাকে অতিথি করা হলো। স্থানীয় মসজিদ ও মাদরাসার উদ্যোগে আয়োজিত ওই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পুরো খরচই তিনি বহন করলেন। এর একটা কারণও আছে, সেটা হলো তিনি নারী বিদ্বেষী বক্তব্য দেবেন । দেশের নামকরা আলেম ওলামা উপস্থিত। অনুষ্ঠান প্রায় শেষ পর্যায়ে। সভাপতির বক্তব্য দেওয়ার আগে মতি সাহেবকে ডাকা হলো বক্তব্য দিতে। মঞ্চে উঠেই শুরু করলেন তার বক্তব্য ।
তিনি বললেন ‘ মহান সৃষ্টিকর্তা কখনো ভুল করেননি, তার কোন ভুল হতে পারে না। মহান প্রভু হলেন সকল ভুলের ঊর্ধ্বে । কিন্তু তিনি যদি কোন ভুল কখনো করে থাকেন , সেটা হলো পৃথিবীতে নারী সৃষ্টি করা। দুনিয়ার প্রায় বেশির ভাগ সমস্যাই নারী ঘটিত কারণে হয়ে থাকে। যদিও আমার জন্ম একজন নারীর গর্ভে,তবুও এ কথা বলতে আমার দ্বিধা নেই। ’
মতি সাহেব বক্তব্য আর শেষ করতে পারলেন না। চার দিকে শুরু হয়ে গেলো হৈচৈ। বিক্ষোভ মিছিল করতে লাগলো ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। পাদুকা প্রদর্শন করলো কেউ কেউ। মতি সাহেব পড়লেন চরম বিপদে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লো বিভিন্ন এলাকায়। মঞ্চের পেছন দিয়ে নেমে দৌড়ে পালিয়ে সেদিন মতি সাহেব আতœরক্ষা করলেন। পর দিন শুরু হলো মুসলমানদের আন্দোলন। এলাকার হিন্দুরাও যোগ দিলেন আন্দোলনে। কারণ তিনি পুরো নারী জাতিকে অপমান করেছেন।তাকে গ্রেফতারের দাবিতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে নারী পুরুষ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ বিক্ষোভ করছেন। সমাবেশ হচ্ছে। পুলিশ অসহায়। কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বিক্ষোভকারীদের। পুরো জেলার বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জের একই চিত্র। বিষয়টা নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় খবর বেরোলো। মতি সাহেবকে গ্রেফতারের দাবিতে সকলেই ঐক্যবদ্ধ। পীর আক্কাস মিয়া সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ মতি সাহেব। তার কলেজের শিক্ষার্থীরাও নেমেছে রাজপথে। আতœগোপনে আছেন তিনি। ধর্মের ওপর আঘাত করেছেন মতি । নারীদের পণ্য বানিয়েছেন, স্রষ্টা ভুল করেছেন বলে বক্তব্য দেওয়ার কারণে এই মহা বিপদে পড়েছেন তিনি।
মতি সাহেব যদিও নারী বিদ্বেষী একজন মানুষ। কিন্তু কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার একটা অনুপ্রেরণা। রবীন্দ্রনাথের দুই বোন উপন্যাসটি বহুবার পড়া হয়েছে মতি সাহেবের। ওই উপন্যাস পড়ে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করেছেন বারবার। দুই বোন উপন্যাসে রবি ঠাকুর লিখেছেন-
‘ মেয়েরা দুই জাতের, কোন কোন প-িতের কাছে এমন কথাই শুনেছি।
এক জাত-প্রধানত মা, আর এক জাত প্রিয়া।
ঋতুর সঙ্গে তুলনা করা যায় যদি, মা হলেন বর্ষাঋতু। জলদান করেন, ফলদান করেন, নিবারণ করেন তাপ, উর্ধ্বলোক থেকে আপনাকে দেন বিগলিত করে, দূর করে শুষ্কতা, ভরিয়ে দেন অভাব’।
“আর প্রিয়া বসন্তঋতু। গভীর তার রহস্য, মধুর তার মায়ামন্ত্র, তার চাঞ্চল্য রক্তে তোলে তরঙ্গ, পৌঁছয় চিত্তের সেই মনিকোঠায়, যেখানে সোনার বীণায় একটি নিভৃত তার রয়েছে নীরবে, ঝংকারের অপেক্ষায়, যে ঝংকারে বেজেবেজে উঠে সর্ব দেহে মনে অনির্বচনীয়ের বাণী।”
রবীন্দ্রনাথের এ উক্তি ভুলে গিয়েছিলেন বাংলা বিভাগের ছাত্র মতি সাহেব। তিনি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স করে ওই কলেজে অধ্যাপনা করছেন। অহেতুক একটা মন্তব্য করে ঝড় তুলেছেন ধর্ম বর্ণ সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্য। খবরের কাগজের শিরোনাম হয়েছেন। গাল মন্দ সইতে হচ্ছে।
বিপদ থেকে উত্তরণের পথ খোঁজছেন মতি সাহেব। এই ঘটনায় মূল উস্কানীদাতা ময়লানা কেরামত আলী। তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে লাগলেন আতœগোপনে থেকে। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হলো তার সাথে। চুক্তি হলো কেরামত আলী আর এ ব্যাপারে কিছু করবেন না। উস্কে দিবেন না কাউকে। শুধু চুপ থাকবেন। বিনিময়ে তাকে লাখ টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু টাকাটা আগে দিতে হবে এটা হলো ময়লানা সাহেবের শর্ত। টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন তার কাছে। ।
ইতিমধ্যে ময়লানাকে ম্যানেজ করার ফল পেতে লাগলেন তিনি। ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসছে আন্দোলন। কাজের ছেলে সাদ্দামের কাছে উত্তরার বাড়ির পুরো দায়িত্ব দিয়ে মতি সাহেব এক বছরের ভিসা নিয়ে কৌশলে গোপনে চলে গেলেন নেপাল। কিন্তু একটা সন্তান পালনের বাসনা প্রবলভাবে গ্রাস করে তাকে। দেশের খোঁজ খবর রাখছেন নিয়মিত । ময়লানার সাথেও আছে যোগাযোগ। নেপল শহরের অভিজাত একটা হোটেলে থাকেন তিনি। এক মহিলার সাথে পরিচয় হয় মতি সাহেবের। পাকিস্তানী মহিলা। নাম রাজিয়া বিনতে হাশিম। তিনি যৌন কর্মী। ৪ বছর ধরে আছেন নেপালে। আফিমের ব্যবসার সাথেও সম্পৃক্ততা আছে তার। স্বামী পরিত্যক্তা রাজিয়া বেশ সম্পদ করেছেন এসব কাজ করে। কোন সন্তান নেই। গর্ভপাত ঘটিয়েছেন আগে কয়েকবার। নষ্টের এ জগতে আসার পেছনে তার যৌক্তিক একটা কারণ আছে। সুন্দরী রাজিয়াকে একবার তার স্বামী রিয়াজ হায়দার এক বন্ধুর কাছে দিয়েছিলেন রাত যাপনের জন্য। বিনিময়ে তাকে টাকা দেওয়া হয়েছিল। তারপর রাজিয়া ভাবলেন স্বামী থাকতে যদি অন্য পুরুষের সাথে আমার মেলামেশা করতে হয়, তাহলে এ স্বামীর সংসারে থেকে কেন? রিয়াজকে ডির্ফোস দিলেন পর দিন। পরে এক বান্ধবীর সহযোগিতায় চলে যান নেপালে। ঘৃণ্য এক জগতের হয়ে যান স্থায়ী বাসিন্দা। স্বামী রিয়াজের প্রতি অভিমান করে মূলত তার এ জগতে আসা। আর রিয়াজ মূলত এটা করেছিল বাজি ধরে। সেই বাজিতে না হারলেও হারাতে হয়েছে স্ত্রীকে।
মতি সাহেবের সাথে রাজিয়ার পরিচয় থেকে ঘনিষ্টতার দিকে মোড় নিলো তাদের সম্পর্ক। মতি সাহেব তার ঘটনা বললেন রাজিয়াকে। এবং সযতেœ লালিত বাসনাও বললেন। এক বিকেলে দু’জন বসলেন একটা লেকের ধারে। মতি সাহেবের আচরণে মুগ্ধ রাজিয়া। কথা বলার এক ফাঁকে মতি সাহেব আগ্রহ করে বলনে -
: আমি তোমার গর্ভ ভাড়া নিতে চাই,দশ মাস তোমার গর্ভে আমার সন্তান রাখবো (ভ্রুণ বেবী পদ্ধতি) কী বলো ?
: মানে কী ? বুঝলাম না।
: মানে হলো Ñ আমি তোমার সাথে সেক্স করবো। যদি তুমি কোন পদ্ধতি গ্রহণ করে না থাকো , তোমার গর্ভে যে সন্তান আসবে , সেটা আমার সন্তান। তোমার কোন দাবি থাকবে না ওই সন্তানের ওপর। বিনিময়ে তোমাকে কী দিতে হবে বলো?
: আমি এমন অদ্ভুত ঘটনার কথা তো শুনিনি কখনো। সন্তানকে তুমি পালন করবে কীভাবে?
: আমি ওকে দেশে নিয়ে যাবো। আমার মতো করে গড়ে তুলবো। ওর কোন মাতৃ পরিচয় থাকবে না। থাকবে শুধু পিতৃ পরিচয়।
রাজি হলো রাজিয়া। টাকা হলেই হলো । টাকার জন্য এমন নিষ্ঠুরতম কাজটি করতেও তার আপত্তি নেই। এর জন্য তাকে দশ লাখ টাকা দিতে হবে। শর্ত হলো সন্তান যাই হোক জন্মের পাঁচ ছয় দিনের মধ্যে তাকে নিয়ে যেতে হবে। আপত্তি নেই মতি সাহেবের। শর্ত মতো মতি সাহেবের শয্যা সঙ্গী হলেন রাজিয়া। দেশ থেকে সাদ্দাম দশ লাখ টাকা জোগাড় করে পাঠালেন নেপালে। সময় যাচ্ছে । দেশের সব ব্যবসা বাণিজ্য ঠিক আছে খবর রাখেন তিনি। কিন্তু কলেজ থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এতে তার একটুও মন খারাপ হয়নি। রাজিয়া তিন মাসের অন্ত:সত্তা। বিয়ে না করেও স্বামী স্ত্রীর মতো চলছেন দু’জন। রাজিয়ার যতœ নিচ্ছেন ঔরসজাত সন্তানের জন্য। ভালোবাসার অভিনয় করছেন।
দশ মাস পর একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে মতির ঔরসজাত সন্তান জন্ম নিলো রাজিয়ার গর্ভে। ছেলে সন্তান। চুয়াল্লিশ বছরের জীবনে সবচেয় আনন্দের দিন আজ মতি সাহেবের। শর্ত মতো পাঁচ দিন পর রাজিয়া গর্ভের সন্তানকে মতির হাতে তুলে দিলেন। কিন্তু সন্তানের জন্য মমতা আর দরদ উপচে পড়ছে রাজিয়ার। দু’চোখে টলমল করছে জল। বুক ফেটে যাচ্ছে। মতির কাছে শিশু সন্তানকে দিয়ে রাজিয়া নিরুদ্দেশ হলেন। হাসপাতাল ছেড়ে অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন তিনি। রাজিয়ার জন্য মায়া হলো মতি সাহেবের। বিভিন্ জায়গায় খোঁজলেন তাকে । পেলেন না কোথাও। শিশুর নাম রাখা হলো রিফাত রহমান। পাঁচ ছয় দিনের একটা শিশুকে নিয়ে কী করবেন মতি সাহেব ভাবছেন। বিমানের টিকেট কাটা থেকে শুরু করে দেশে আসার জন্য একটা প্রস্তুতির প্রয়োজন। কীভাবে করবেন এ সকল কাজ। কোথায় রাখবেন তাকে? যাই হোক ঘটনাটা হাসপাতালের এক নার্সের কাছে খুলে বললেন তিনি। রেক্সিনা নামে ওই নার্স শিশুকে দু’একদিন তার কাছে রাখার প্রস্তাবে রাজি হলেন। এরই মধ্যে দেশে ফেরার সকল কাজ শেষ করেছেন মতি সাহেব।
পর দিন তিনি দেশে ফিরবেন। সঙ্গে থাকবে তার ঔরসজাত সন্তান। কিন্তু সমস্যা হলো বিমান বন্দরে। শিশুটির মা নেই সাথে। নিশ্চয়ই শিশুকে পাচার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সন্দেহ করে নিরাপত্তাকর্মীরা আটকালেন তাকে। রাজিয়ার সাথে তার চুক্তির সকল কাগজপত্র দেখালে কর্তৃপক্ষ ছেড়ে দেন । দেশে ফিরলেন মতি সাহেব। বিমান বন্দরে হাজির সাদ্দাম । সে এই শিশুর খবর কিছুই জানে না। এলাকার কাউকে তার ফেরার কথা বলা যাবে না Ñ এমন কথা আগেই সাদ্দামকে বলে রেখেছিল মতি। রাত তখন দশটা। বাসায় উঠবেন । কিন্তু কীভাবে যেন ময়লানা কেরামত আলী সাহেব টের পেলেন। মতি সাহেব বাসায় উঠার আগেই ময়লানা তার বাসায় হাজির। এলাকার অবস্থা স্বাভাবিক হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু ময়লানা আরো কিছু টাকা নেওয়ার কৌশল হিসেবে একটা ফন্দি আঁটলেন। ওই শিশুর খবরও তিনি জানেন না। মতির কোলে শিশু দেখে চমকে উঠলেন। শিশুর বিষয়টি খুব সহজ করে মতি সাহেব বুঝালেন ময়লানাকে। এবং আপাতত কাউকে না বলার জন্য অনুরোধ করলেন।
ময়লানা সাহেবও কথা রাখলেন। কাউকে বললেন না। পরম মমতায় মতি সাহেব তার ঔরসজাত রিফাতকে লালন পালন করতে লাগলেন। কিন্তু এলাকার লোকজন জানে যে এই ছেলেকে মতি কোন পাচারকারীর কাছ থেকে কিনে এনেছেন কিংবা দত্তক এনেছেন। রিফাত যে মতি সাহেবের ঔরসজাত এটা তিনি আর ময়লানা সাহেব ছাড়া আর কেউ জানে না। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত রিফাতকে লালন পালনে কিছুটা অসুবিধা দেখা দিলে তার দু:সম্পর্কের জুয়েনা আক্তার নামে এক বোনকে বাড়িতে আনেন। তিনি ছিলেন অবিবাহিত। রিফাত জুয়েনার স্নেহে বড় হতে থাকে। মতির বাসায় ময়লানা সাহেবের অবাধ যাতায়াত। এরই ফাঁকে জুয়েনার প্রতি ময়লানা ক্রমশ দুর্বল হতে থাকেন। অধিকাংশ সমযই ময়লানা বাসায় আসেন যখন মতি সাহেব না থাকেন।
এদিকে মতি সাহেব ঘুমের ঘোরে প্রতি রাতেই দু:স্বপ্ন দেখেন, গুলিভর্তি একটা পিস্তল থাকে তার বিছানায়। প্রচন্ড রকম মদ্যপায়ী হয়ে উঠেন। যে ময়লানা টাকা নিয়েছেন কিংবা যারা তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে তাদেরকে কে তিনি হত্যা করবেন , এমন মানসিকতা তৈরি হয় মতি সাহেবের ভেতরে। ঘটনার প্রায় বার বছর গত হয়েছে । কিন্তু তার ভেতরের ক্ষোভ যায়নি। কী একটা ঘোরের মধ্যে আচ্ছন্ন মতি দিনযাপন করছেন! কিন্তু রিফাতের কথা চিন্তা করে ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে চান, পারেন না। ক্রমশ বাড়তে থাকে তার পাগলামী। অর্থ সম্পদ যা ছিল প্রায় শেষ। শুধু বাড়িটা বাকি আছে।
সময় গড়িয়ে গেছে অনেক। কলেজের চাকরি ফিরে পাননি। সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণœ হয়েছে। হতাশায় মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। রিফাত টের পেয়েছে যে ওর বাবা এখন বিপথে চালিত হচ্ছে। রিফাতের বয়স এখন তেরো বছর। সে সব বুঝে। অসম্ভব মেধাবী রিফাত অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। রিফাত জানে জুয়েনা যে ওর মা নয়। সে বাড়ির কাজের মেয়ে কিন্তু বাড়তি কাজ হলো তাকে দেখভাল করা। তবুও মাতৃসম সন্মানই করে জুয়েনাকে। ময়লানা সাহেবের সাথে জুয়েনার দৈহিক সম্পর্ক টের পান মতি সাহেব। সুযোগ খোঁজছিলেন।
অধ্যাপনার পাশাপাশি মতি সাহেব ঢাকা বাংলাবাজারে একটা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এক সময় ব্যবসা ভালোই জমে উঠেছিল। একদিন মতি সাহেব তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়ি ফিরে দেখেন রিফতা পড়ার টেবিলে। সেদিন তার বাসায় ফেরার কথা ছিল না। ঢাকার বাইরে যাবেন বলে ফোনে জানিয়েছিল রিফাতকে। রিফাত জানায় জুয়েনাকে। হঠাৎ তিনি রাত দশটার পর বাসায় ফেরেন। জুয়েনার ঘরে শীৎকারের শব্দ শুনে এগিয়ে যান মতি সাহেব। দরজা আটকানো। খুলতে বলেন। জুয়েনা দরজা খুলে না। ময়লানা পড়েছেন এবার বিপদে। পালানোর পথ খুঁজে পেলেন না। শরীর কাঁপছে। এক পর্যায়ে দরজা খুঁলে দিলে বিষয়টি মতি বুঝেও না বুঝার ভান করেন। ‘ আজ আমার রুমে থাকবেন আপনি, ময়লানা সাহেবকে বললেন মতি সাহেব। তিনি রাজি হলেন। এবং জুয়েনার সাথে দৈহিক সম্পর্কের কথা বলে ক্ষমা চাইলেন। এই সুযোগই তো খুঁজছিলাম, ভাবতে থাকেন মতি। এ দিন কাজের ছেলে সাদ্দাম তার গ্রামের বাড়ি নকলায় ছিল।
এক সাথে দু’জন রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লেন। মতি সাহেবের ডান পাশে ঘুমালেন ময়লানা সাহেব। আর রিফাত বাম পাশে বাবার বুকে শুয়ে ঘুমিয়ে যায়। গত বার তের বছরে মতির সাথে ময়লানার সম্পর্ক গভীর হলেও মতির বুকের ভেতর ক্ষোভ দানা বেধে আছে । কী এক দু:স্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে গেলো তার। পিস্তল হাতে নিয়ে কক্ষের ভেতরেই পায়চারি করতে লাগলেন। জুয়েনা ওই রাতে আর মতির সামনে আসেননি। বিছনা থেকে মতি উঠে নামার সময় ময়লানার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিন্তু ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকেন। পিস্তল হাতে নিয়ে পায়চারি করছেন মতি সাহেব । ময়লানা দেখছেন। প্রচন্ড ভয় তার ভেতরে । আমাকে কি মতি খুন করবে ? নয় তো এতো রাতে পিস্তল হাতে নিয়ে ঘুরছে কেন? এমন নানা প্রশ্ন আসতে থাকে মাথায়।
নেপালে শিশু সন্তানের স্বত্ব চুক্তিপত্র সম্পাদন করার পর রাজিয়া একটা ফটোকপি রেখে দিয়েছিল। সেখানে মতি সাহেবের পুরো ঠিকানা লেখা রয়েছে। গর্ভজাত সন্তানের মায়ায় নেপাল থেকে বাংলাদেশে এসেছেন রাজিয়া। রাত তখন দুইটা বাজে। লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করতে করতে মতি সাহেবের বাড়ি পেয়ে যান রাজিয়া।
ময়লানা কেরামতকে খুন করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন মতি সাহেব। ময়লানার মাথায় পিস্তল ধরে মতি । তার শখ হয়েছে মানুষ খুন করার। একডজন খুন করবেন তিনি। প্রতিজ্ঞা করেছেন নিজের সাথেই। ময়লানাকে দিয়ে শুরু । মৃত্যুর আগে কীভাবে মানুষ ছটফট করে সেটা দেখবে এটা তার প্রবল ইচ্ছা। এ সময় রিফাতের ঘুমও ভেঙ্গে যায়। রিফাত দৌড়ে গিয়ে বাবার হাত থেকে পিস্তলটা ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হয়। এ সময় হঠাৎ ময়লানার শরীরে গুলি না লেগে গুলি গিয়ে লাগে রিফাতের শরীরে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রিফাত। ছটফট করতে থাকে সে। মৃত্যুর ঠিক আগ মুহুর্ত। ময়লানা তখন ঘরের ভেতরে ছুটছুটি করতে থাকে। এক পর্যায়ে ময়লানা ঘর থেকে বের হয়ে আতœরক্ষা করে। তখন মতির সেন্স কাজ করছিলনা। ‘ ‘বাবা তুমি অবশেষে আমাকেই মেরে ফেললে? ক্ষমা করে দিও’, বিড় বিড় করে বলছিল রিফাত।
নিজের জীবনের চেয়েও যাকে বেশি ভালোবাসতো মতি সে নিজের হাতে খুন হলো ভাবতে থাকেন মতি। পিস্তলে আরো কয়েকটা গুলি আছে। ইচ্ছে হলো আমিও আতœহত্যা করি। এ সময় বাইরে দরজায় টকটক শব্দ। মতি সাহেব ভেবেছিল পুলিশ খবর পেয়েছে। হয়তো পুলিশ এসেছে। মেঝেতে রিফাতের লাশ পড়ে আছে। দরজা খুলতেই চেয়ে দেখে বোরকা পড়া ধবল দুধের মতো সাদা একজন মহিলা। চিনতে আর বাকি রইলো না যে এটা রাজিয়া।
: হাই, আমি রাজিয়া
: চিনতে পেরেছি
: কী ব্যাপার মেঝেতে দেখি রক্তের বন্যা। কার লাশ পড়ে আছে ? আমার আদরের মানিক কোথায়? ও কত বড় হয়েছে এমন অসংখ্য প্রশ্ন মুহুর্তের মধ্যে।
একটা ইতস্ত ভাব করে মতি। বাকরোদ্ধ। থরথর করে কাঁপছে পুরো শরীর। তুমি কীভাবে আসলে, কোথা থেকে আসলে এসব জানতে ভুলে গেছেন। তার সামনে ছেলের লাশ । তাও আবার নিজের হাতে খুন ।
: একটু আগে বাসায় আমার শত্রুরা ঢুকে ছিল। আমাকে না পেয়ে ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে দ্রুত চলে গেছে। বাসার কিছুই নেয়নি।
: তার মানে আমার গর্ভজাত সেই সন্তানের লাশ এটা ? বলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন রাজিয়া।
এই ফাঁকে জুয়েনা দরজা খুলে। মতি তাকে শেখায় যে বলতে হবে সন্ত্রাসী ঢুকেছিল ঘরে। আমাকে না পেয়ে আমার পিস্তল দিয়েই তারা খুন করেছে রিফাতকে । জুয়েনা বলল ঠিক আছে। দ্রুত পুলিশে খবর দেওয়া হয়। লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যাওযা হয় মর্গে। মতি সাহেবের অভিযোগের ভিত্তিতে ময়লানা সাহেবকে গ্রেফতার করা হয় রাতেই। কিন্তু সত্য কথাটা বলার সুযোগ হয়নি তার।
ঔরসজাত সন্তানকে নিজ হাতে খুন করে পার পেয়ে গেলেন মতি সাহেব। তার ইচ্ছে পূরণ হলো না। ইচ্ছে ছিল নিজ হাতে ময়লানাকে খুন করার। সেটা আর হলো না। গর্ভের সন্তান যাকে পাঁচ দিনের দিন বিদায় দিয়েছিল রাজিয়া নেপালের হাসপাতাল থেকে , সেই সন্তানকে প্রায় তের বছর পর বনানী কবরস্থানে শেষ বিদায় দিয়ে তিনি চলে যান। কিন্তু কোথায় আছে রাজিয়া মতি জানেন না। মতি তাকে থাকার জন্য একবারও বলেনি। বললে হয়তো থেকে যেতো তার কাছে।
মতি সাহেবের মাতামাতিটা সমস্ত সীমা রেখা অতিক্রম করে ফেলেছিল। এই ঘটনার পর মতি সাহেব স্মৃতিভ্রম রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় উন্মাদ হয়ে জীবন কাটাতে থাকেন। রিফাতের বার তম জন্মদিনে তোলা ছবিটা দেয়ালে টানানো। ওই ছবির দিকে তাকেলে মতি সাহেব আর স্থির থাকতে পারেন না। রাজিয়া কি নেপাল ফিরে গেছে ? নাকি পুত্র শোকে এই শহরের কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার মতো উন্মাদ হয়ে ? এমন নানা প্রশ্ন তাড়িত করছে মতিকে।