পূর্ণ প্রতীতি : রুমানা নাওয়ার



পূর্ণ প্রতীতি
রুমানা নাওয়ার

ভালোবেসে বিয়ে করেছে ওরা। আহির আর মাহি। দু’জনেই এমবিবিএস শেষ করেছে মাত্র । বয়সটা টগবগে। বল্গাবিহীন ঘোড়ার মতো। মাহি অসুস্থ জেনেও আহির ভালোবেসেছে বিয়েও করেছে পরিবারের অমতে। বাবা মা একমাত্র ভাইটাকে ত্যাগ করেছে ভালোবাসার টানে। কত স্বপ্ন দু’চোখ জুড়ে। মাহিকে সুস্থ করে তুলবে ওর চিকিৎসা বিদ্যার সবটুকু দিয়ে। কিডনির সমস্যা মাহির। দু’টো কিডনি ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার পর মা র একটা কিডনি নিয়ে মাহির বেঁচে থাকা। আহির সব মেনে বিয়ে করেছে মাহিকে। প্রথম প্রথম তেমন আমল দিতো না বেখেয়ালি মেয়েটি।
মাহি কেমন জানি দুর্বল। শারিরীক কোন আকর্ষণ নেই আহিরের প্রতি। অথচ ঐ সময়টায় একটা ঘোরের ভিতর যায় নতুন কাপলদের। শারিরীক সম্পর্ককে ভয় পেত মাহি। জোর করে তো আর ওসব চলেনা। ভিতর থেকে তাগাদা আসতে হবে। আহির তবুও দমেনা। সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় উপোষী শরীরটার ক্ষিধে মিটাতে। মাহিকে চাঙা রাখতে চায়। তবু বিবাহিত জীবনের নয় বছরে নয় বার ওদের শরীর মিলেছে। তাও ঔষধ দিয়ে মাহিকে। কি অবর্ণনীয় কষ্ট নিয়ে  রাতের পর রাত েেকটেছে সেটা কেবল আহির জানে। ২২ /২৪ বছরের শরীরটা কান্না করতো ডুকরে ডুকরে। আদর চাইতো শরীর ভীষণ আদর। নিপাট বেডশিটটা খাটটা ওর সাথে গুমড়াতো কষ্টে। দাঁতে দাঁত চেপে কামকে দমন করতো আহির। আর বেচারা মাহি কি করবে। ওর শরীর তো এসব বুঝেনা। কাছে টানেনা।
ডায়ালাশিস করে করে ওর শরীরটী বিপর্যস্ত। যে সময়টা আহির বর নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় থাকার কথা। সে সময়টায় ওর মাহিকে নিয়ে ডায়ালাশিসের রুমে ডায়লাশিসে দিন যায়। বিয়ের একবছর না যেতেই আত্বীয় স্বজনরা ফিসফাস করতে থাকে বাচ্চা কেন নিচ্ছি না। মাহি অসুস্থ। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ফেললে মঙল হবে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। আহাম্মকরা বুঝে না বাচ্চা দেয়ার সামর্থ্য নেই ওদের ছেলের। শরীর যে কয়বার মিলিত হয়েছে তাও আহির চেয়েছে বলে। ওটা তে যতোনা মাহি এক্টিভ ছিলো তার চেয়ে ঢের এক্টিভ ছিলো আহির। তো এভাবে বাচ্চাকাচ্চা কোত্থেকে আসবে বুঝাতে পারেনা ওদেরকে। যতসব চিন্তা ওদের তার চেয়ে বেশী চিন্তায় পরে আহির। তারপর বলতে শুরু করলো বউ রাতে বাইরে ডিউটি করে বাচ্চা কিভাবে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো কথা। ওর ভিতর ঘরে মন পাঁজরে কি হচ্ছে সেটার খোঁজ কেউ নেয়না। বাবা মাকে খুব ফিল করে তখন। শ্বশুর শ্বাশুড়ীও অনেক ভালো। বুঝে সব। আহিরকে মেয়ে মনে করে ওদের। ছেলের সব অক্ষমতা শেয়ার করে ও শ্বাশুড়ীর সাথে। যাকে ও গাল ভরে মা ডাকে। এভাবে দিন যায় মাস যায় বছরও কিছু মাঝখানে অতিবাহিত হয়। আহির ব্যস্ত ক্যারিয়ার নিয়ে স্বামী র চিকিৎসা নিয়ে। ডায়লাশিস করে বাঁচিয়ে রাখে মাহিকে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? হাঁপিয়ে উঠে মাঝেমাঝে প্রচন্ড আত্ববিশ্বাসী মেয়েটি। শেষ পর্যন্ত কি হবে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কিছুই বুঝতে পারেনা। তবুও আশায় বুক বাঁধে। আত্বীয় স্বজনের টিপ্পনী  তো আছে। থোড়ায় কেয়ার করে ও এসব। তবুও শ্বশুর-শাশুড়ির ইচ্ছে তার মাতৃত্বের স্বাদ এসব মিলে বাচ্চার জন্য মন আকুল হয়। একটা ফুটফুটে বাচ্চা হোক ওর আর মাহির। মাহির স্মৃতি থাকুক তার পোড় খাওয়া জীবনে। কিন্তু মাহি তো অক্ষম। শেষ পর্যন্ত সবায় মিলে সিদ্ধান্ত নেয় বাইরে গিয়ে ট্রিটমেন্ট করবে। কথা অনুযায়ী কাজ। চলে গেলো দুজন পাশ্ববর্তী ইন্ডিয়ায়। অনেকে চিকিৎসায় ফল পেয়েছে ওখানে।

টেষ্টটিউব বেবি নিতে হবে আহিরকে।
টেস্টটিউব বেবি নেয়াতে স্পার্ম ডোনার হবে মাহী। মাহীর অহ্মমতার জন্য ৪৪ টা ইনজেকশন আহিরের শরীরটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো। তবুও তো সুখ। সন্তান আসছে তার শরীরে। মা হবে আহির মা। অনেক কষ্টের মাঝেও একদলা সুখ এসে উথলায় বুকের কাছে। প্রজাপতি হয়ে নাচে নানা বর্ণিল ডানায়। মাস দুয়েক পর মাহী আহিরকে নিয়ে চলে আসে বাবা মার কাছে। বউকে দেখে শ্বশুর শ্বাশুড়ীর খুশী আর ধরেনা। মাহির সন্তান পেটে ধারন করছে তাদের বউমা। এর চেয়ে সুখের খবর আর কি হতে পারে তাদের জীবনে? মাহিই যেখানে অস্তগামী সূর্য তাদের কাছে।

দিন যায় আহিরের শরীর ভারী হয়। টুইন বেবির অস্তিত্ব ওর শরীরটায়। শরীর তো ভারী হবেই। বাবা মা ফুপু আত্বীয় পরিজনরা বাহবা দেয় মাহির বীরত্বে।
একটা না দু দুটো বাচ্চার জন্মদাতা মাহি। সাবাস!
নিন্দুকের মুখে চুন কালি দিতে এর চেয়ে সমুচিত জবাব আর কি হতে পারে? সন্তানই জন্ম দিতে পারবেনা বলছিলো সবাই সেখানে এরকম খবর তো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। আহির হাসে মুখ লুকিয়ে। আর ভাবে বাহবাকে নেয়ার কথা আর কে নেয়। হায়রে অবোধ মানুষজন।

প্রার্থিত দিনে জন্ম নেয় আহিরের বেবী। ১ম যে আসলো সে চিৎকার করে আশপাশ জানান দিলো ওর আসার খবর। ২য় জন একটু ক্ষীণ স্বরে। আহিরের পৃথিবী ঝলমলা রোদ বসন্তে। মাহিও দারুন হ্যাপী। বাবা হওয়ার আনন্দ মা হওয়ার আনন্দ অন্যরকম। যে হয়েছে সেই বুঝে। যারা হয়নি তারাও এ আস্বাদের অপেক্ষায় হয়তো।

দু’টোর নাম মিলিয়ে রাখা হয় পূর্ণ আর প্রতীতি। একটু একটু বড় হতে থাকে ওরা। আর ঘরটা হাসে ওদের দৌঁড়াত্বে। দাদা দাদীও ওদের জন্য পাগল। সময় কাটায় ওরা নাতনীদের নিয়ে। পুরো ঘরটায় সুাখের আবাস। মাহিও আগের চেয়ে বল ফিরে পায় শরীরে যেন। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ওর হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে করে।
বিধাতা সুখ বুঝি সইতে পারেনা বেশী দিন। মাহির শরীর আস্তে আস্তে দূর্বল থেকে দূর্বলতর হতে শুরু করলো। বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিলো শরীরে। কিডনির সমস্যা তো আছেই। ডায়ালাশিস এ ও আর কাজ হয়না। বাবা মা চোখে অন্ধকার দেখলো যেন। এমন কেনো হলো ছেলেটার। কত আশায় বুক বেঁধেছিলো ওরা। বউ বাচ্চা সব হলো ছেলেটার। সুখের কিনারায় এসে আবার দুঃখের সাগরে ভাসতে লাগলো ওরা।


দীর্ঘ দু’মাস মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে এক ভরা জ্যোৎস্নালোকিত রাতে সবাইকে কান্নার সাগরে ভাসিয়ে মাহি চলে গেলো পরপারে। মেয়ে দু’টোকে খুব কাছে চাইতো শেষের দিকে। অসুখের অবর্ণনীয় কষ্টে চেহারাটা এত খারাপ হয়ে গিয়েছিলো পূর্ণ প্রতীতি ভয় পেতো বাবার কাছে যেতে। মারা যাওয়ার সময় পাশে রেখেছিল তাদের। চোখ ভরে দেখেছিলো তার আদরের কলিজা দুটোকে। আর আহির তো বুকে পাষাণ বেঁধে ছিলো। যে মাত্র মাহি নাই হয়ে গেলো দুনিয়া থেকে তখনই তার ধৈর্য্য’র বাঁধ ভেঙে গেল যেন। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো মেয়েটি। মাহির বুকে আঁচড়ে পড়লো ঢেউয়ের মতোন।
এমন তো কথা ছিলোনা মাহি। তুমি আমাকে একা রেখে কোথায় যাচ্ছ? আমি সর্বস্ব ত্যাগ করেছি তোমার জন্য। আর তুমি?
এ বলে আবার বুক ফাটা আর্তনাদ করতে লাগলো। উপস্থিত সকলে কান্না করতে লাগলো আহিরের বিলাপে। বাবা মাও শোকে পাথর বনে গেলো। তাদের প্রথম সন্তান মাহি। বুকটা ভেঙে যেতে লাগলো কষ্টে।

দিন যায় সময়ের হাত ধরে। পূর্ণ প্রতীতি বড় হতে থাকে আহির আর দাদা দাদাীর ছায়ায়। আহির সারাদিন কর্মব্যস্ততায় কাটায়। নিজেকে ডুবিয়ে রাখে কাজে। ভুলে থাকতে চায় মাহিকে। ঘরে ফিরলেই চোখ আর বুকটা উচলায় তার ভালোবাসার মানুষটির জন্য। মাহির ঘামে ভেজা শার্ট টা বুকের কাছটায় জড়ায় আনমনে।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট