যে ভালোবাসার শেষ নেই
রুমান হাফিজ
ক্লাস, টিউটোরিয়াল, এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন এসবের ঝক্কিঝামেলা সামাল দিতে দিতেই অবস্থা বেহাল। অফ ডে গুলাও কেমন জানি পানসে পানসে মনে হয়। ভার্সিটি লাইফে একঘেয়েমু বাসা বেধে ফেলতে বোধ হয় খুব একটা সময় নেয়নি!
ঈদের ছুটি ঘোষণা হতে না হতেই সব গুছিয়ে টুছিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালাম। কি যে শান্তি মনের মাঝে দোল খায় তা বলে কয়ে বুঝানো অসম্ভব! যাকগে ঈদ কেটে গেলো সুখে শান্তিতে।
কিন্তু...! বন্যার পানিতে আশপাশ ডুবে আছে সে অনেকদিন থেকেই। সমস্যা ওখানেই। ঈদের পরদিন বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম একটা কাজে। কিছু পথ যেতে না যেতেই আচমকা পা পিছলে পড়ে যাই।
বন্যার পানি রাস্তার উপরিভাগেও ছুই ছুই অবস্থা। আমার পুরো শরীরটাই পানিতে ডুবে একাকার। কোন উপায়ান্তর না দেখে ফের বাড়ির দিকেই রওয়ানা করতে হলো । কাপড় চোপড় পাল্টে নিতে গিয়ে বুঝতে পারি ফোনটাও ভিজে গেছে । অনেকবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না। ফোন আর অন হয় না। খুশির দিনে এমন একটা ঘটনায় সব যেন শেষ করে দেবার মতো অবস্থার তৈরী হল। কারণ এই ফোনটাই আমার একমাত্র সম্বল। ল্যাপটপ, ট্যাব কিংবা এই জাতীয় কোন কিছুই আমার নেই। যদিওবা এগুলোর থাকাটা আমার দরকার।
ঈদের সময় বলে কথা। ফোনকল, টেক্সট এককথায় যোগাযোগ অন্য সময়ের চাইতে বেশি থাকে। খানিকটা চাপা স্বভাবের এই আমি ঘটনাটা কাউকে বলা হয়নি। কিন্তু বড়াপুর থেকে লুকিয়ে রাখা! আর যাই হোক সম্ভব না। ঘটনার আদ্যোপান্ত সবটুকুই ওর সাথে শেয়ার করি।
বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে ছোট বোনের ফোন থেকে টুকটাক জরুর সেরে ফেলার চেষ্টা করি।
ঈদের ছুটি শেষ। আবার চলে যেতে হবে। বাড়ি ছেড়ে চলে আসার মুহূর্তটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি কষ্টের সেই সাথে যোগ হলো ফোনটা নষ্ট হওয়া। হঠাৎ বড়াপুর ফোন-
‘রুমু কই তুমি? (বড়াপু আমাকে রুমু বলেই ডাকে)
‘এইতো, বাড়িতে।
ওকে, যাচ্ছিস কবে চিটাগং?
‘টিকিট সংগ্র হলে আগামীকালই যেতে পারি।
‘আচ্ছা, এক কাজ কর যাওয়ার আগেরদিন শহরে চলে আয়। আমিও আছি। দেখা হলো। নতুবা যাওয়ার আগে যেকোনোভাবেই হোক, আমার সাথে দেখা করে যাবি, কেমন!
‘ওকে, আসলে নক দেবো।
ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করতে না পারলেও বাসে করে যাবো ভেবে আগেরদিন শহরে চলে আসি। বড়াপুর সাথে দেখা হয়। একটা কফি শপে নিয়ে গেলো। কফি আর চা আমার একটু বেশি পছন্দ।
কফি খেতে খেতে অনেক গল্প হলো। বাড়ি ছেড়ে যাওয়া আর ফোন নষ্ট হওয়ার কষ্ট যেন মুহূর্তেই ধূমায়িত কফির চুমুকে হারিয়ে গেলো!
বড়াপু একটা শপিং ব্যাগ বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। কি এটা? বড়াপু কিছুই বলতে রাজি হলো না। ওর একটাই কথা, ‘খবরদার, ভুলেও এটা বাসায় না যাওয়ার আগে চেক করতে যাবি না’
কিন্তু নাছুড়বান্দা আমার জোরাজুরিতে বড়াপু বলতে রাজি হলো।
‘তুই যখন আমাকে বলছিলি যে, তোর ফোনটা পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে তখন আমার খুব বেশি খারাপ লাগছিল। জানিস, আমি তখন চিন্তা করছিলাম। তোর বড়বোন হয়ে আমি ফোন ইউজ করবো আর তুই ফোন ছাড়া! বিশ্বাস কর, এটা ভেবে খুব বেশি কষ্ট পাচ্ছিলাম। আমার হাতে আপাতত তেমন টাকা পয়সাও নেই। স্কুল থেকে স্যালারী এখনো পাইনি তাছাড়া ঈদে টুকটাক শপিং করে হাতটা খালি হয়ে যায়। আরো ভালো একটা ফোন দিতে পারলে ভালো লাগতো। আপাতত এটা দিয়েই চল। প্লিজ লক্ষী ভাই আমার। রাগ করিস না, প্লিজ!’
বড়াপুর কথাগুলো আমার হৃদয়ে বানের জলের মত হুহু করে ধাক্কা দিচ্ছিল। জিহ্বায় কখন যে কামড় দিয়ে বসে আছি ঠিক মনে নেই। অশ্রুসিক্ত চোখে অপলক তাকিয়ে আছি বড়াপুর দিকে। কিচ্ছু বলতে পারিনি। মুখ দিয়ে বের হচ্ছিলোও না। এ আমার পাগলী বড়াপুটার ভালোবাসা। যে ভালোবাসার শেষ নেই, শেষ হবেও না।