নিজস্ব পরিবেশের সৌভাগ্যবান কবি
কমরুদ্দিন আহমদ
মাহমুদ নোমান
নগরায়নের হিড়িকে প্রকৃতি ধ্বংসের উৎসব আর মানুষ থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমনসময় আসতেও পারে, মানুষ মানুষকে দেখলে ভয় পাবে। ইতোমধ্যে আতংকিত হওয়া শুরু হয়ে গেছে। ঠিক, তেমনি এখনকার অধিকাংশ আধুনিক কবিতা দেখলে এসব কথা মনে ঝাপটায়। পরাবাস্তবতার বলয়ের আরো বাইরে গিয়ে মানুষের কাছে ফেরে না কবিতার মর্মবাণী। প্রকৃতির কথা, গ্রামের কথা লিখতেই কেমন জানি লজ্জাবোধ আর এসবের কবিতা দেখলেই বিরক্তির চরমদশা। এসব কবিতায় হিংসার গন্ধ প্রকট। এমন দুর্দশায় কেউ কেউ যে প্রকৃতির মাঝে, মানুষের মাঝে আলো ছড়াচ্ছেন কবিতার মর্মকথায়, এটা জেনে খুব আশান্বিত হই। নিশ্বাস নিতে ইচ্ছে হয়, প্রাণ আর মনভরে....
এমন এক কবির নাম কমরুদ্দিন আহমদ। তিনি প্রকৃতির বাউল কবি, তা তাঁর কবিতার প্রথম লাইন থেকে পাঠকের বুঝতে সময়ক্ষেপণ হবে না। মানুষের মাঝে মানুষের আত্মিক টান অনুভব করবে নিঃসন্দেহে । মনে হতে পারে, পাঠকরা তাঁর খুব কাছের আত্মীয়। হয়তো নানাবিধ কারণে যোগাযোগ নেই। আবার এমনও মনে আসতে পারে, কবিতার চিত্রকল্পে একেকজন সবুজের বিপ্লবী বা স্বপ্নকথক।
কমরুদ্দিন আহমদের কবিতা পরিশীলিত ভাবের সাথে মোহনিয়া আঞ্চলিক শব্দের চমৎকারিত্বের সফল রূপায়িত এক সাঁকো। ভাবের সাথে খুব খাতির যেন সাঁকোটির এ পাড় আর ঐ পাড়ের শব্দের সাথে। কোনো একটা শব্দকে জোরপূর্বক ব্যবহার করছে এমনতর মনে হবে না, এখানেই কমরুদ্দিন আহমদের কবিতার বাহাদুরি। চেনা জনপদ বা নাড়িপোঁতা মাটিকে নিয়ে লিখতে পারা কম সৌভাগ্যের নয়, তাই কমরুদ্দিন আহমদ সৌভাগ্যবান কবিও।
বিষয়-আশয় বিচারে অথবা বোধের জ্ঞানে কমরুদ্দিন আহমদের কবিতাকে আল মাহমুদের কবিতা পড়ছেন বলে মনে হতেও পারে অথবা বলতে পারেন - আল মাহমুদের কবিতা পড়ছি না তো! কিন্তু, কমরুদ্দিনের আহমদের কবিতাকে আমার কমরুদ্দিন আহমদের কবিতা-ই মনে হল। শব্দ আর আঙ্গিক একেবারে নিজস্ব ধাঁচের, কখনো কখনো যথেষ্ট প্রভাববিস্তারী ভাবের চলনে- বলনে। আল মাহমুদের কবিতার তাত্ত্বিক বিশ্লেষক বলেই হয়তো কিছুটা প্রভাবিত। তবে অতি সম্প্রতি কমরুদ্দিন আহমদের ‘ গন্ধরাজের ঘ্রাণ’ পড়ে মনে হলো- এটাকে কেউ এককভাবে ছড়া বা কবিতা গ্রন্থ বলে চালিয়ে দিতে পারবে না অথচ দুটোর খাছিলত এখানে বিদ্যমান। তিনি হয়তো চেয়েছেন, প্রকৃতির সারল্যতা ছন্দের তালে বা অন্ত্যমিলের চমৎকার গাঁথুনিতে ফুটিয়ে তুলতে এবং এখানেই কমরুদ্দিন আহমদ সবচেয়ে সফল। নিজস্ব পরিবেশ আর পরিস্থিতির চিত্রকল্পে পাঠক হয়ে ওঠে ভ্রমণপিপাসু-
আমার গাঁয়ে সূর্য ওঠে চায়ের সবুজ ঢেউয়ে
কোমল সোনা কুড়ায় তখন ধাঙ্গর পাড়ার বউয়ে
মেহগনি পাতার ফাঁকে হলদে চড়ুই নাচে
বাবুই পাখি বুনছে বাসা তালতমালের গাছে।
(নদীর পাড়ে বনের ধারে; ৯ পৃ.)
মিথভাবনাগুলো দেশজ সংস্কৃতির মেলবন্ধনে উপমার সদ্ব্যবহারে আপনার গা টানতে পারে জোছনা ভরা রাতে-
চাঁদের বুড়ি চানপুরেতে
শঙ্খ না’য়ে ছড়ায় ইলিশ
ধীবর রাণী দাম রেখেছে
এ শরতে দুইশ তিরিশ।
(প্রেম খুঁজেছি নদীর বাঁকে ; ১৫ পৃ.)
০২. কমরুদ্দিন আহমদের কবিতা গীতল শব্দের বিমোহনে আধ্যাত্মিক বুনিয়াদে ভাবিত, কিন্তু যুগোপযোগী হয়ে মানুষের মাঝে নিবীড়ভাবে মিশে যায় প্রত্যেকটি অনুষঙ্গে। নান্দনিকতার অমূল্য সংযোজন প্রত্যেকটি কবিতায় কমরুদ্দিন আহমদকে স্বভাব কবি বা মরমিবাদে দীক্ষিত কবি নানা অভিধায়ে অভিহিত করতে পাঠক উদগ্রীব হয়ে ওঠবে। আধ্যাত্মিক বিষয়াদির যুৎসই ব্যবহার কখনো কখনো ভেতরটা নাড়িয়ে দোলাতে থাকবে পাঠককে-
গাছের জরায়ু ফুঁড়ে কাঠালের শিশু
বউ কথা কও থামে ময়ূরের পিছু,
সারাক্ষণ পাহারায় মৃত্যুর রাহু
আত্মায় জাগাও জিকির আল্লাহু আল্লাহু।
(আত্মায় জাগাও জিকির; ১০ পৃ.)
খ. জ্বলন্ত হুতাশনে ইব্রাহীম নবীর হাসি
পূণ্যবতী হাজেরার ধৈর্য্যের বাঁশি
বর্তমানকে ভবিতব্যের কুঠুরিতে গাঁথা
হালকা হয় পাতাঝরা দুপুরের ব্যথা।
(ফাগুন; ১৪ পৃ.)
পরিবেশ পরিজন নিয়ে লিখলেন, ভুলেননি লিখতে পরিবেশ পরিজনের শেকড় উপেক্ষা নিয়েও। দিনদিন মানুষের মাঝে মানুষের টানের যে হঠাৎ ঘাটতি পরিলক্ষিত, এসব কবিকে দেয় চরম মনোকষ্ট। সংস্কৃতি ভুলে মানুষের পশ্চাৎপদতা নিয়ে কবি সোচ্চার। তবে কটুকথায় নয়, আন্তরিকতায় বুঝিয়ে দিয়েছেন এসব অপসংস্কৃতির মতিগতি। কবি যে সমাজের দর্পণ তাঁর লেখায়, এটি কমরুদ্দিন আহমদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। সমাজের দায়বদ্ধতা কবি এড়িয়ে যায় নি, যা সুখকর পাঠকের জন্য-
কোথায় গাঁয়ের পুঁথির আসর
কোথায় পালাগীত
কবিয়াল তো বেতার কেন্দ্রে
নামলো গাঁয়ে শীত।
(ব্যা-জ্বর; ১৯ পৃ.)
এই যে সমাজের দায়বদ্ধতা বৃহৎ পরিসরে রাষ্ট্রীয় ভাবনায় কবি আরো বলিষ্ট। রাজনীতির নামে নিত্য ধান্ধাবাজি আর মানুষের মধ্যে কলহ সবসময় জিয়ে রাখার বীজ বপন কবির কলমে দৃঢ়তার সাথে উচ্চারিত হয়েছে-
রাজনীতিকের ভ-ামিতে
হয়না তো দেশ জাত
কুঁড়েঘরে ত্রিভুজ প্রেমের
লেগেছে সংঘাত।
(সুখ খুঁজতে; ২৬ পৃ.)
এই অপরাজনীতির প্রভাবে ভঙ্গুর যুবসমাজ এমনকি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপাতির চড়া মূল্যে সাধারণের ভোগান্তিও ভাবায় কবিকে। তেমনি ভাবায় দেশের সাথে বহির্বিশ্বের রাজনীতি। বলতে পারি কমরুদ্দিন আহমদ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কবি। এক্ষেত্রে ‘নদী কমিশন’ কবিতাটি সবচেয়ে স্মরণযোগ্য-
রাম গিরিতে মেঘের আগম
হাসছে কদম কন্যা
বৃষ্টি হয়ে ঝরলে আকাশ
বাংলাদেশে বন্যা।
(নদী কমিশন ; ৩৭ পৃ.)
০৩.
যতকিছু বলি না কেন, কমরুদ্দিন আহমদ এক আপাদমস্তক প্রেমের কবি। গীতল শব্দে প্রতিটা কবিতায় রোমান্টিকতা নিজস্ব ব্যঞ্জনায় মহিমান্বিত, নিজের সময়টাকে ছাড়িয়ে চিরতরুণ। শঙ্খনদীর উন্মাতাল কলরোল কবির বুকে সদা প্রবাহমান, সবুজের চা বাগানের ঢেউয়ে ব্যাকুল অন্তরাত্মা; বাঁশখালীর জনপদ কবির কাছে যেন জায়নামাজ। ইতিহাস- ঐতিহ্য লালিত্য প্রেমের লয়ে, একটু সুযোগ পেলেই উগরে দেন যেন সমন্ত কল্পনাশক্তি, আশা আকাক্সক্ষা আর বিরহযাপনের কথামালা-
মৌমাছিরা ক্লান্ত শ্রমে
মৌচাকে তাই জমছে মধু
ঝরে শুকায় ফুল- পাঁপড়ি
পেন্ডুলামে ঝুলছে বধূ-
(সুখে আমার মন ভরে না; ১১ পৃ.)
খ.ঘাই হরিণী ডাক দিয়েছে বুকের ভেতর
বনের গাঙ্গে ছল- ছলানি
চানখালিতে বৈঠা টানে অচিন মাঝি
কোন সুদূরে নিয়ে যাবে আমায় টানি...?
(অরক্ষিত মৎস্য কুমার; ৪০ পৃ.)
গ. হেমন্তে যুবতীনদী বুকের সাধিকা
সাত’শ গোপী, আরো কেয়াবন কাশ
গোধূলি কুয়াশা, ঘাস, ললিতা- বিশাখা
পানরসে ঋতুবতী সরল আকাশ।
(জলকুমার; ৩৯ পৃ.)
পরিশেষে বলা যায়, ‘গন্ধরাজের ঘ্রাণ’ গ্রন্থটি কেউ ছড়ার, কেউ কাব্য আর কেউ গীতিকাব্য হিসেবে মনপছন্দ করে নিলে বাড়াবাড়ি নয় কোনোটাই। পাঠশেষে যেকোনো পাঠকের মনোদেহে সুবাস ছড়াবে গন্ধরাজ ফুলের....