নিশিকন্যা
মাহমুদুল হক জালীস
অধুনা রাত এলে প্রায়ই উত্তেজনা বোধ করে আসিফ। যৌবনের প্রবল তৃষ্ণা অষ্টপ্রহরে বিদ্যুৎ চমকের মতো তড়িৎ গতিতে তার শরীরে প্রবাহিত হয়। যেদিন মাথায় ওই খারাব কাজের চিন্তা ঢোকে সেদিন আর ঘুম আসে না। চোখের পাতা শত চেষ্টায়ও এক করতে পারে না। চাহিদা মিটানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে। আজকেও তার চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই। গভীর রাতে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়ে। দিনের চিরাচরিত শহরটা রাতের অন্ধকারে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। কেমন যেন খুব অচেনা অচেনা। দিলের আলোর ভদ্রগোছের মানুষগুলো রাতের আঁধারে চরিত্র চেঞ্জ করে। প্রদর্শন করে ভেতরের আসল রূপ। আসিফ এসব ভাবতে ভাবতে গলির মোড়ে এসে রিক্সা নেয়। বয়োবৃদ্ধ এক লোক চালকের আসনে । জীবিকার তাগিদে হাড্ডিসার শূন্য দেহ নিয়েও রাত বিরাত কষ্ট করে যাচ্ছে এই সমাজের কত মানুষ। ঘোর অন্ধকারের ভেতর গন্তব্যে চলছে রিকশা। মাঝে মাঝে ক্রিং ক্রিং শব্দে ছেদ পড়ছে রাতের নিরবতার। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আবছা হলুদ আলো। কেমন যেন বিষাদমাখা। এ আলোতেই সে চলতে অভ্যস্ত। কিন্তু আজ তার কেমন যেন লাগছে। হয়তো আপেক্ষিক কিছু একটা ঘটার পূর্বাবাস। একটা গলির মুখে রিকশা থামিয়ে নেমে পড়ে আসিফ । ভাড়া চুকিয়ে গলির ভেতর হাঁটা ধরে। রাস্তার দুপাশে কয়েকটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে খদ্দেরের খোঁজে। দেখতে বেশ পরিপাটি। সাজগোজর ঈষৎ আভা প্রত্যেকের শরীরে প্রতীয়মান। কথা বলছে কিছুটা উচ্চ আওয়াজে। নিজেদের দিকে আকর্ষণ করানোর নিমিত্তে। আসিফকে দেখে মেয়েগুলো চিরচেনা সেই হাসি দেয়। তার কাছে নিজেদের লোভনীয় করার জন্য। আগে অনেকবার এই হাসি দেখেছে আসিফ। এদের হাসি থেকে শুরু প্রায় অধিকাংশের দেহের সাথেও তার পরিচয় রয়েছে। কিন্তু আজকে তার গন্তব্য অন্য জায়গায়। ওদের দিকে ভ্রক্ষেপ না করে সে একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজা চৌকাঠের সাথে ভেজানো। হালকা ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দেয় আসিফ। বিছানার উপরে অন্য দিকে ফিরে বসে আছে এক রমনী। সিগারেট টান দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধোঁয়ার কুন্ডুলী ছড়াচ্ছে। আড়চোখে বাঁকা দৃষ্টিতে দেহের গড়ন দেখে আসিফ। বেশ নাদুসনুদুস। শরীরের বাড়তি অংশও অনেকটা সুঠাম। পূর্বাভ্যাস থাকলেও সে ইতোপূর্বে এমন কাউকে দেখেনি। কেমন যেন দ্বিধা দ্বিধা লাগছে তার কাছে। টিপটিপ পায়ে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায়। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তার আশপাশ । মধ্যবয়ষ্ক এক মহিলা। চেহারা দেখে ভদ্রঘরের বলেই মনে হয় তার কাছে। শরীরের সৌন্দর্য কালের ঘাত-প্রতিঘাতে অনেকটাই শুষে নিয়েছে। তবুও ছিমছাম দেহের গড়নে সৌন্দর্য কিছুটা হলেও অনুমেয়। মহিলাটি তার দিকে তাকাচ্ছে না। কী যেন একা একা ভাবছে। আসিফের একটু অস্বস্তি লাগে। এপরিবেশের মহিলারা সাধারণত এমন হয় না। কী করবে সে? ভেবে পাচ্ছে না। চিরচেনা পরিবেশটা আজ কেন জানি অচেনা অচেনা মনে হয়। আসিফ একটু গলা খাঁকারি দেয়। মাহিলাটি তার দিকে একনজর তাকায়। আসিফের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। মহিলাটির প্রতি কেন যেন ভীষণ মায়া হয় তার। ঐ কাজের চিন্তা তার মাথা থেকে উবে যায়। আগ বাড়িয়ে সে জানতে চায় তার এপথে আসার ইতিবৃত্ত ।
নিশীথ যামিনীতে চাঁদের ঝলমলে আলো পৃথিবীর আকাশজুড়ে খেলা করছে। যোজন যোজন দূর থেকে মিহি মিহি আলোকচ্ছটা কার্ণিশ ঘেঁষে রুমে ঢুকছে। ঘুলঘুলির ছায়াবিম্ব পড়ছে ফ্লোরে। আসিফ নিবিষ্ট মনে বসে আছে এক পাশে, অন্য পাশে নিশিকন্যা তার জীবনের বিড়ম্বনাময় আখ্যান নিয়ে জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে। জোসনার আলো তার অবয়বের লাবন্যতা বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। কিছু সময় দুজনের মাঝে নিরবতায় কেটে যায়। মন ছুঁয়ে যায় আরেক মনকে।
নিরবতা ভেঙে আসিফ জানতে চায়- কী নাম আপনার? । তনু, মহিলাটি বলল।
এই তনুর ছোট সংসার ছিল। বাবা-মা, ভাই-বোন ছিল। ছোট ঘর ছিল। উঠোন ছিল। সোনালি ধান ছিল। মাঠভরা ফসল ছিল। পাখিদের কল-কাকলিতে মুখরিত ছিল ওদের বাড়ি। তখন কতই বা বয়স হবে
তনুর। চোদ্দ কি পনের। হঠাৎ একদিন গভীর রাতে তনুদের বাড়িতে ডাকাত আসে। দরোজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে। সারা ঘরের মানুষ ভয়ে তটস্থ। ডাকাতদল সার্চ লাইটের আলোতে খোঁজাখুঁজি করে জিনিস পত্র, টাকাকড়ি, সোনা-গয়না।
সবশেষে ঘরের ভেতর যুবতীদের সন্ধানে নামে। খুঁজতে থাকে তাদের লালসা মেটানোর খোরাক। দৃষ্টি পড়ে খাটের ওপরে আঁটোসাটো হয়ে বসে থাকা তনুর দিকে। ঘরের অন্য লোকজনদের হাত পা বেঁধে, বিছানা থেকে তুলে আনে তনুকে। হিংস্র ডাকাতের ভয়ে কাচুমাচু হরিণের সাবক ওর মন। রাতের আঁধার বিদীর্ণ করা চিৎকার । ‘বাঁচাও বাঁচাও’ মুখের বুলি। প্রতিবাদ প্রতিরোধের হাতিয়ার নেই কাছে পিঠে কোথাও। নেই কোনো নৌজোয়ান বীর-পালোয়ান যে এক অবলা নিরীহ মেয়ে মানুষের সম্ভ্রম রক্ষা করবে। নারী জাতির চির মূল্যবান সম্পদ অক্ষত রাখবে। পালাক্রমে শরীরিক ও মানসিক অত্যাচারে তনুকে করে ছিন্নভিন্ন। রাতভর দেহের সাথে চলে হোলি খেলা। এ যেন এক কচি হরিণ শাবককে কামড়ে ছিঁড়ে খায় ক্ষুধার্ত একদল হিংস্র বাঘ। তনুর বস্ত্রহীন শরীর লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। এভাবেই কয়েক ঘণ্টা কেটে যায় তনুর জীবনের পাতা থেকে।
তনুর বীরাঙ্গনা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত এখন থেকেই শুরু। তারপর ঈশান কোণে কত যে মেঘ জমে ছিল! কিন্তু দুঃখের শ্রাবণ কেউ ঝরাবে কিনা জানা ছিল না তনুর। মৃত্যু তাকে গ্রহণ করেনি বলে জীবন ওকে শান্তি দেয়নি এক দ-ও। এ সব কিছু ভুলে তনু নতুন করে বাঁচতে চায়। জীবনে বাঁচার গান শুনতে চাই। মোছতে চায় মন থেকে সেই আতঙ্কিত রাতের কথা। এরেই মাঝে অনিক নামের এক ছেলে তার কাছের মানুষ হয়ে যায়। সবসময় আগলে রাখে তনুকে। ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখায়। ভালোবাসের বুলি শোনায়। ভুলিয়ে দিতে চায় তনুকে সে যে একজন ধর্ষিতা। অনিকের প্রতি আসক্ত হয় তনু। শরীরের জমিনে আবার ফসল বুনতে চায়। ভালোবাসার ফসল। ভালোবাসার নদীতে সাঁতার কাটবে দুজনে মিলে। ভুলে যাবে কিছুটা হলেও সেই বীভৎস রাতের কথা। অনিকের বিশ্বাসের নৌকায় জীবনের বাকী পথটুকু পাড়ি দিবে। এসব আশা বুকে নিয়ে অনিকে সাথে তনুর বিয়ে হয়। ছোট ইটের ঘরে চাঁদের আলোর প্লাবন। মনে মনে অনিক নামটিই জপে অহর্নিশ। সারাদিন অপেক্ষায় থাকে অনিকের। কিন্তু সে জানে না অনিকেও যে বাটপার। এমন অনেক মহিলাকে ভালোবাসার কথা বলে, পরে ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করে। হঠাৎ এক রাতে অনিক বাড়ি ফিরছে না। অপেক্ষায় রাত জেগে বিছানায় তন্দ্রচ্ছন্নভাবে পড়ে থাকে তনু। দরজার আগলে গভীর রাতে খুট খুট শব্দ হয়। তনু ঘুম ঘুম চোখে দরোজা খুলে আবার শুয়ে পড়ে। আলো আঁধারীতে কে যেন ঘরের ভেতর ঢোকে। তার খুব পাশে এসে বসে। চোখ বুজেই কথাগুলো ছোড়ল তনু ‘এত দেরি কেন হইছে? ভাত খাইবা না?’ সে বলে, না। কাছে এসে তনুর শরীরে হাত বুলিয়ে যায় আলতোভাবে। কোন কথা নেই। তনুর শরীর হিম হয়ে আসে। চমকে উঠে সে? অনিক? এক ঝাটকায় হাত সরিয়ে ওঠার চেষ্টা করে তনু। না পারে না। তনু স্তম্ভিত। বাকহারা। এখানেও সেই পশুর দল! শব্দহীন অসাড় তনু শুধু হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে। রেহাই পায় না। আগন্তুক তার পৌরুষ কাম চরিতার্থ করে ওঠে পড়ে। ডাকে অনিক, অনিক আয়, আমি যাই। তনুর চৈতন্যে ঝড় ওঠে । আর্তনাদ করে। ওর চিনতে বাকি থাকে না নব খরিদ্দার অনিককে। তারপর থেকে তনু প্রতিজ্ঞা করে যদি শরীর বেঁচেই খেতে হয় তা হলে নিজেই বেঁচুম। অন্যের বিবাহে থেকে নয়। সেখান থেকে বিভিন্ন পতিতালয় তনুর উঠাবসা। আর কিছু বলতে পারে না তনু। আসিফ তনুর হাতটা ধরে বের হয়ে পড়ে অজানা গন্তব্যে।