পদাবলি




আলপিনে জড়ানো জ্যোৎস্না
উদয় শংকর দুর্জয়

জোস্নার আলপিন বিঁধে আছে অযুত কাল ধরে, রেটিনার চারপাশে;
এক ফোঁটা কান্নার হ্রদে, ভেসে আছে নিস্তব্ধ পাঁচতলা জাহাজ।
দুপুরের রঙ ছুটে আসে বিভ্রান্তি ফেলে, একপাল নীল ঘোড়া হয়ে;
প্রত্যাহ আকাশ ভাঙে কলতান রুখে, নিশ্চুপ ক্লান্তির ফিনিক্স বেহাগ।

পাল্টাতে এসে মৃদু কলরোল, থেমে গ্যাছে উল্লাসের দল;
ভাব্বার বিষাদ লিখে, ফিরে গ্যাছে সোনালি আলবাট্রাস।
কখন যেন স্টারলিং সুর চুরি করে গায়, স্বর্নচাপার গান,
এক অষ্টাদশী রোজ তাড়িয়ে বেড়ায় নিরুদ্দেশি পেগাসাস।

ত্রিকোণী রোদ্দুরে ভেজাতে আসা অঞ্জলির গৃহদ্বার,
বিবর্ণ বেহালায় পড়ে থাকে বিভ্রমের কলতান।
আর চাইলেও নিকষ ফেরি, উড়ে আসবে না, ছেড়ে পাটাতন।
এক অন্যযানে, সমুদ্র থেকে তুলে নেবো, ধুলো সমেত রুপোলি মনিহার।


গুজরিপঞ্চম
জোবায়ের মিলন

-এই রীতিটা পীড়া দেয়।
মৃত্যুর পর এসে বুক চাপড়ায় সকলে
চোখ চিপে পানি বের করে হায় হায় করে
স্মৃতিকে পুঁজি করে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত
হাজার শব্দ সুতায় গাঁথে, শোক বার্তায় জলধি বানায়;
মৃত্যু পূর্ব সম্পর্ক এক বিরাট বিস্ময়।
রুদ্রকে নিয়ে আজকের শত আয়োজন মনে করিয়ে দেয়
সেইসব দিনরাত্রি’র কথা, যখন একটা চাকুরীর
তেষ্টা নিয়ে মাটিকে দুভাগ করেছে রুদ্র, বিলাপে। এটা একটা
উদাহরণ।

-এরকম উদাহরণ কালের অঙ্গনে অনেক।

তসলিমার নির্বাসন লজ্জিত করে বেতবনের সবুজ।
তসলিমা ফিরে এলে শাপলা ফুটবে বলে ধুতরার গায়ে
জ্বালাধরা সন্ধ্যা নামে;
-সত্যকে জখম সহজ, চিরায়িত সত্যের মৃত্যু নেই।
তসলিমার নামে এ উদ্যানে সভা হবে, শোক হবে,
বক্তৃতা হবে, করতালি হবে; তসলিমা আলো-রোদের
উদাহরণ হবে সমূহ একদিন।

থাকি বা না থাকি, থাকো বা না থাকো
রৌদ্র কন্যারা একদিন, তার থেকে তুলে নেবে ভোরের
ঝিলিক। 


ভেঙ্গে পড়ছে সব
রফিকুজ্জামান রণি

তুমুল উল্লাসে ভেঙ্গে পড়ছে সব
রোদ থেকে ভেঙ্গে পড়ছে ক্রোধ
কোলাহল থেকে ভেঙ্গে পড়ছে শব্দ
তুফান থেকে ভেঙ্গে পড়ছে গর্জন
এবং মেঘ থেকে ভেঙ্গে পড়ছে ছায়া

শুধু স্তব্ধতা, ভীষণ রুক্ষতায়-
ভেঙ্গে পড়ছে তারা থেকে তারা!


কবির হাসি ফুঁটে
সাজ্জাক হোসেন শিহাব

কদম ফুলের পাতায়-ঐরাতে বাদলের তারা
ফুটেছিলো! আঁধারডানায় ভর করে দূরদেশ
থেকে উড়ে এসেছিলো অচেনা মায়াবী রুপকথা!
বাতাসে আবেগী ঢেউ ছিলো! কেউ তো সাগর হয়ে!
সেই সাগর, যে গভীর অসীম বৃষ্টি একা লুটে!
আমি দেখি সেই আষাঢ়ে আজো কবির হাসি ফুটে!


এই আশ্বিনের কাছে
নুরুল ইসলাম বাবুল

ফালি ফালি মেঘের মতো উড়ে যায় দিন,
দিনগুলো টেনে টেনে দীর্ঘ করে আমাদের বয়স;
কখনো মাথার ওপর জমে থাকে সাদা-সাদা মেঘ
মেঘগুলো মায়া করে করে ছায়া দেয়,
সেই নিবিড় ছায়ার ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে
পৌঁছে যাই শিন শিন আশ্বিনের দিকে...

আহা!  কতকাল পড়ে আছি এইখানে
বুকপকেটে ভরে নিয়ে
হেমন্তের হিম-হিম সকাল;
জামার আস্তিনে গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখি
গলে যাওয়া শিশির।

দিনগুলো শুধু উড়ে উড়ে যায়
ফালি ফালি মেঘের মতো
তবু অনাদীকাল পড়ে আছি এই আশ্বিনের কাছে।





কল্পনা
লুফাইয়্যা শাম্মী

হলদে জ্যোৎস্নার মত মেঘে জড়িয়ে ভেবে নিচ্ছি তুমি ছুঁয়ে আছো, আমায় ভাবছো তোমার স্বপ্নের চূড়ায়! তখন আকাশ নেমে আসে কোলের উপর, তুমি রূপকথার গল্প শুনে চুপটি করে ঘুমিয়ে যাও, যেন নিতান্ত’ই অবুঝ শিশু। মেঘের দলে গা ভাসিয়ে তোমায় ছুঁয়ে আমিও ডুবে যাই উর্মিদোলায়।


পাখিটা উড়ে গেছে
আহমদ মেহেদী
(উৎসর্গ : পৃথিবীর সমস্ত পুত্রহারা পিতাদের)

এটাই হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দের সংবাদ, এই সংবাদ  বিশ্ব জয়ের আনন্দের  চেয়েও কোনো অংশে কম নয় আপনি প্রথম ছেলে কিংবা মেয়ের বাবা হয়েছেন!
বাবার হৃদয় সমস্ত শক্তি দিয়ে  তখন আনন্দে নেচে উঠে তাঁর’ই রক্তখন্ড টাকে এক নজর দেখার জন্যে!
কাকে প্রথম জানাবে এই খবর? বাবাকে? মাকে? কাছের বন্ধুদের?

কিছুক্ষণের মধ্যে  ডাক্তার এক দুঃসংবাদ দিলেন-আপনার বাচ্চা ত অসুস্থ! তাকে আইসিও তে নেয়া জরুরী,
কি আশ্চর্য! কেন কি হয়েছে আমার ছেলের?
আনন্দের মাঝে এ যে ভীষণ যন্ত্রনা আমার সমস্ত হৃদয়টাকে এভাবেই ভেঙ্গে দিবে কে জানতো,
আমার এমন লাগছে কেন- মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীর সব অমানুষ মিলে আমাকে পিষে ফেলতে চাইছে ....একটু দয়া ধর হে দয়াময়!

একটি আসেইসেনকিউবেটরের মধ্যে শুয়ে আছে আমার আদরের মেহরাব!
ডাক্তার কিছুক্ষণ পরপর আমাকে আর আমার ছোট ভাইকে ব্রিফিং করছেন, তাকে দেখার সুযোগ করে দিচ্ছেন।
কেমন সাহস ঐ ডাক্তারের, আমি নাকি ছুঁয়ে দেখতে পারব না! এবার সর্বশেষ অবস্থান জানানো হচ্ছে আমাদের! আমাদের চোখের জল দেখে ডাক্তারের চোখে ও জল এসে পড়ল, আমি শেষবারের মত আমার মেহরাবকে গালে আদর করে এলাম, বুঝতে পারছি -পাখিটা কষ্ট পেয়ে  উড়ে যাচ্ছে, উড়ে চলে গেছে!
হে বিধাতা তুমি ত জানতে সেদিন আমার বিনিময়ে আমার পাখিটাকে চেয়েছিলাম তোমার কাছে।
আজ এই পৃথিবীর সবাইকে জানিয়ে রাখি পরকালে আমি স্বর্গ-নরক যেখানেই থাকি; আমার এই পাখিটাই চাই....হে দয়াময়!


মাটি হওয়ার ইতিহাস!
বিদ্যুৎ দেব

মাথার উপর পাক মারে তিনপাখা মেশিন। নিয়মের তিন সুত্রে ঘুরে আমার পৃথিবী। যদিও মাটি ঘেরা আমার শরীর। আকাশটা ঢেকে দিল রঙ্গিন টিন। জ্বর গায়ে আমার কত কিছু মনে হয়। মাটির গান শুনায় প্রিয়জন।
মাটির বুকে পাথর সাজায় স্বপ্ন দেখা আদমের পরম্পরা। সংখ্যা বাড়ায় গানিতিক হারে। বাড়ায় শব্দ যন্ত্রণা। ঘাম দেয়া শ্রমিকের ছায়া পড়ে সূর্য পশ্চিমে হেঁটে গেলে। এই সময়  মানুষের  মুখ দেখায় পাতা কালারের। ভয় পাই আমি । মন চায় পড়ে নিই মাটির হওয়ার ইতিহাস!





আক্ষেপ
নুশরাত রুমু

মেঘলা বিকেল বেলা আমি যে একেলা
শূণ্যে ধোঁয়ার আগল মনটা পাগল পাগল
         কেইবা কাকে বোঝে?
বেঁধেছে সংঘাত চলছে অজুহাত
করছে দোষারোপ ছুঁড়ছে কথার তোপ
         কে আর মনকে খোঁজে?




আধুলী সঞ্চয়
পারুল  নিশা

বিভৎস্যতার প্রকষ্টে ভালবাসা পেতে ,
কান পাতে সহিংস বুকে।
নিজের বোধ বুদ্ধির প্রসস্থতা রুখে।
অন্ধের আয়না বা চিরুনীর বিভক্ততা নেই,
মনের সব চাওয়া পাওয়া যেন অব্যক্ততাই।

পরিত্যক্ত শরীরের মত জীবনটাও যেন অতিরিক্ত,
তিক্ত সময়ের হাত ধরে পথ চলতে বিরক্ত।
যাওনা নদী তটে, চাওনা কারো আঁখি পটে,
তবুও বদনাম রটে।

জন্ম দেখেছি আগেও অনেক, মরতে দেখেছি বারংবার।
পথে ঘাটে দেখি কত বিবস্ত্র চিৎকার।
অগ্রাধিকার হিংসার ফাঁদে পড়ে কাঁদে।

বেঁচে থাকার প্রত্যাশা হয় শিরচ্ছেদ।
দুঃক্ষের হাটে জীবন বেঁচে খায়,
আঘাতে আঘাতে আধুলী সঞ্চয়।

কথা বলার আগে
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

এখন যার কথা বলার সময়
একটু আগেও সে এখানে ছিল
নাম ঘোষণার পরই
তাকে আর দেখতে পাচ্ছি না

একটা কথাও সে বলে নি
তবু রাস্তা দিয়ে পরপর
বেশ কয়েকটা বাস ছুটে গেল
আকাশটা কালো হয়ে এলো

এবার কিন্তু আপনার পালা
দেখুন নিজেকে কতটা আগলে রাখতে পারেন ।

ওরা মরে
কৃপাণ মৈত্র

ওরা পাথর কাটতো, সাদাপাথর।
 ঠিকরে পড়তো চাঁদের আলো,
প্রদীপের লক্ষ শিখা সব কোণের ফোঁকরে ঢুকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতো।
 অস্ত সূর্য লাল অনুরাগের চিঠি পাঠাতো প্রতিদিন। শিশিরস্নাত সোহাগ।
 খবর নিত না তাদের যাদের বুকের জমাট রক্ত
 বিদ্রোহ করে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করে।
ঈশ্বরের অবিচারে ঈশ্বরকে দাঁড় করায় ঈশ্বরের কাঠগড়ায়।
এক পৃথিবীর বাতাসে ও তাদের কুলায় না।
যে সৃষ্টি একসময় সুখের নিদ্রা ডেকে আনত প্রসব সন্তানের উজ্জ্বল হাসির মতো-
সে চোখ স্বপ্ন দেখার সাহস পায় না। বুকঠেলা দীর্ঘশ্বাস, সঙ্গে চাপ চাপ রক্ত। ক্ষীণদৃষ্টি
সৃষ্টি দেখতে গিয়ে দেখে চিতার আগুনের লেলিহান শিখা। স্মৃতিটা ঝাপসা হয়, সব চেনা
সরে সরে যায়। তবুও সাদাপাথরে সূর্য বা চাঁদের
কলঙ্করেখা পড়ে না। বৈভবের গরিমা তবু সমুজ্জ্বল। একফোঁটা চোখের জল কেউ জমিয়ে
 রাখেনি ওদের তরে।ওরা মরে প্রতিদিন মরে।



কিছুটা এলোমেলো
পারভেজ মল্লিক

আমার জানালা থেকে শহরটা দেখা যায়। এলোমেলো। বাসি।
মুহূর্তরা কুয়াশায় দিক হারায়। চাহনিতে সাবেকি জলছাপ।
রেডিও ষ্টেশনে ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম ঘেঁটে বেড়াই। কিনে নিয়ে আসি
প্রবন্ধের ভুল বানান। আর সম্পর্কের জটিল বারগ্রাফ।

অভিনবত্ব আসবে একদিন। কফি পেয়ালায় শুকনো ঠোঁটের দাগ।
ফুটপাতে পিকাসোর তুলির টান। হাতে হাতে ঘোরে। সস্তা বিকোয়।
মাসমাইনের কাবার হওয়ার তাড়া। অবসরে প্রিয় নাস্তিক বিভাগ।
খালি পেটে জমে জল্পনা; শব্দ আসে। লিখতে পারিনা। কবি নই।

ট্রাম রাস্তার ভিড়ে একটু তফাৎ খুঁজে পাওয়ার আবদার। নিয়মিত চেষ্টা।
খুঁজে পেলে ফিরে এসো। ওরা দেখুক। ট্রাজেডি নয়। কমেডি হবে শেষটা।



শরতের গল্প
নাসরিন জাহান মাধুরী

যদি আগামী শরতেও বেঁচে থাকি  তবে এই শরতের গল্পটা শেষ করবো-
অনেক কথা বলার আছে এই শরতের।
গেলো শরতে যেমন গল্প করেছি এর আগের শরতের।
এমনি চাঁদভাসি রাত, এমনি টিপটিপ বৃষ্টি-
তবে আজকের গল্পটা আগামী শরতের জন্যই তোলা রইলো।
আমরা ভালোবাসি বিগত দিনের গল্প শুনতে আর বলতে-
এই শরতে যদিও আমার মন ভালো নেই তবুও সেকথা বলবোনা।
বলবোনা শ্বেতশুভ্র মেঘগুলো নীল পাহাড়ে কেমন করে মিশে যাচ্ছিলো।
কেমন করে মেঘের ছায়া হাওড়ের জলে পড়ে মায়াবী অপরূপ দৃশ্য করেছিলো।
কেমন করে নৌকায় ঢেউয়ের তালে দুলে দুলে জীবনের গান গেয়েছিলাম।
ফিরে এসে বন্ধুর না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার খবর ঠিক কতটুকু কষ্ট দেয়-
সেটাও জমা রইলো আগামী শরতে বলার জন্য-
জানি অনেক কিছু বলার থাকে, বলবো বলবো করেও বলিনা-
বলা হয়ে ওঠেনা,
তারপর চলে যাই অমোঘের আহ্বানে অনেক অনেক দূরে-
এই শরতের গল্পগুলোও আগামী শরতের জন্যই রইলো
বেঁচে থাকার শর্ত সাপেক্ষে;
কারণ আমরা ভালোবাসি বিগত দিনের গল্প শুনতে আর বলতে।
বর্তমানে থেকেও অতীতে বসবাস আমাদের খুব পছন্দ।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট