হেম এখন গ্রহপথে লিখিয়েছে নাম
উদয় শংকর দুর্জয়
বনপত্রালীর হলুদ ছায়া হেমকালের স্তুপাকৃত শিশিরকে ভুলতে বসেছে, বেখায়ালি অনাদরে। ও ঠোঁটের হ্রদে পিং স্ট্রবেরি জানিয়ে দিত পেট্রোলিয়াম জেলির অপ্রতুলতা। আবেদনের সবক’টি গ্রহচ্যুত তারকা বিবর্ণতা মেখে আরেকটি আকাশ টানিয়ে দিত মাথার উপর।
এখন আবিরহীন হেমাংগিনী ভোর চৌকাঠের অদূরে, যেখানে শিশিরকণা পুড়ে যাচ্ছে, যেখানে জোনাকি-পাহাড় পাহারা দিত, সেখানে পাথর বাকল ঝরে পড়ে আছে।
সংগিহীন লোকসমুদ্র মনে রাখে না, কি রেখে গিয়েছিল বিগত ঢেউ। কোন ঊষা ভেঙে কোন জলাশয়ে দাঁড়িয়ে গ্যাছে স্কাইস্ক্রাপার, তার খবর শুধু যে মেঘপারাবত জানে।
কাল এখন অকালের নামে লিখিয়েছে অদৃষ্ট, এক গৃহ মন্দিরের নৈবেদ্য রেখে খাবলে নিয়েছে বেলান্তের ধুলোভস্ম। একটি হেমকালের জন্য একটি আলোকবর্ষ, অপেক্ষার গ্রীলে ঠেকিয়ে রাখুক আঙ্গুল।
নোনাজল
নুশরাত রুমু
হেমন্তের আকাশ নিয়ে নামলো অমাবস্যার রাত,
এলোমেলো হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে কান্না হতে চায় সহযাত্রী।
ঝিঁ-ঝির ডাকে মিলিয়ে যায় বেসুরো গলার গান।
শিমুল তুলোর মত উড়ে যায় অন্তরীণ স্বপ্নগুলো।
জীবনের না পাওয়াগুলো পাল তুলে এগিয়ে আসে
মনের সমুদ্রপথে..
ঝুল বারান্দার শক্ত মুঠিতে সুপ্ত বাসনারা গুমরে কাঁদে।
জোনাকির ক্ষীণ আলোয় হাহাকার মুচড়ে ওঠে।
হারিয়ে গেছে হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া এক মুঠো খুশি।
চুপিচুপি মন বারান্দায় যে এসেছিল শীতের রোদ্দুর হয়ে,
যেখানে দাঁড়িয়ে ক্লান্তির সীমানা পার হওয়া যেত,
সে কখন নোনাজলের ঢেউয়ে মিশে গেলো- টের পাইনি !
ভুল ফাগুন
ফখরুল হাসান
বিরহের পারমাণবিক বোমায়,
হিরোশিমার মতো বিধ্বস্ত,
জীবন মানচিত্রের
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু
দুরারোগ্যে ব্যাধিতে আক্রান্ত
জীবন দেয়ালের প্রতিটি ইট।
ভুল ফাগুনে কৃষ্ণচূঁড়ার রঙ হয়
একাত্তরের বুলেটের অদ্ভুত শব্দ...
হেমন্ত আজ নিঃস্ব
আমিনুল ইসলাম হুসাইনী
হিম কুয়াশার পালকি চড়ে হেমন্ত ফের এলো
কিন্তু একি হেমন্ত কই? সব যে এলোমেলো।
কার্তিক যে যাওয়ার পথে ব্যস্ততা কই চাষির
কোথায় যেন হারিয়ে গেছে স্বপ্ন রেখা হাসির।
কোথায় আমন ধানের ঘ্রাণে প্রাণকাড়া সেই দৃশ্য
রূপ হারিয়ে সুমঙ্গলা হেমন্ত আজ নিঃস্ব।
হেমন্ত আজ বইয়ের পাতায়, সমাজ খাতায় মেকি
তাই তো এখন নবান্ন গান গায় না পাড়ায় ঢেঁকি।
ঢেঁকি এখন জাদুঘরে রোদন করে রোজ
প্রযুক্তির এই জোয়ার নদে কে রাখে তার খোঁজ?
হৈমন্তিক মাঠ
অচিন্ত্য রায়
আমার বুকেতে যে ক্ষত এঁকেছো
তাঁর নাম দিও হেমন্তের মাঠ
শানিত কাস্তের বাঁকে সূর্য ডুবে ,
উঠুক চাঁদ
কাটা ধানের একঘর মৃত্যুর মতো
যন্ত্রণাময়, শিশির আমার হোক
কেঁচমাটি মাখা কুর্চি শামুকের বাঁশিতে
বাজুক শৈশব
অতঃপর ধানের জাঙ্গি-পালুই-মড়াই
সমস্বরে বলুক আমরা কৃষকদের
তিরকি চড়ুই, বিষণœ শামুকখোল,
খিদের উপন্যাস তৈরী করতে থাক
লিকের ধুলো মগ্নতায়, একচামচ ঘাম ও রক্তে
ভাঁটফুল
নাসির ফরহাদ
ভাঁটফুল কেমন আছো ?
কথা হয় না বহুবছর!
আমায় কি ভুলে গেলে!
ভুলিনি তোমায়,
তোমার রাঙা যৌবনে আমায়
উদাস করে।
শীতল করে প্রাণ-
আমি তোমার কাছেই ছিলাম
একযুগ আগে!
ছেলে বেলায় খেলতে গিয়ে তোমায়
কতোবার স্পর্শ করেছি! বাঁধা দাওনি।
ভাঁটফুল এখন তোমায়
সময় দিতে পারিনা।
তবু আমায় ঘৃণা করো না!
ঐ যে তোমার মাঝে কালো কুচকুচে
দ্বীপ্তমান বীজ হয়ে রয়েছি।
বন্দী আছি-
তোমার সাবলীল যুগলে;
বুঝে নিও তুমি বুঝে নিও।
হৈমন্তিক
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
নাছোড় ভাস্কর্য যত
ফিরিয়েছো শহরের বুকে
কে বলে পাঁজরহীন
কে বলে আহত নিশী তার
সময়ের আবডালে
কখনো সুবাস আসে
কখনো দরজা ঠেলে
হিসাব মেলেনি সত্ত্বার
এখন জমিয়ে রাখো
নিয়মে ঝলসানো চিঠি
ঝরে গেলে বিষাদ স্মারক
গাছেতে জেগেছে কোষ
হেমন্ত নির্ঘোষ
যেকোনো উচ্ছ্বাস থেকে
জন্মায় বার্তাবাহক-
মাটিরা স্বাধীন নয়
হৈমন্তিক রীতি
স্বাধীনতা অক্ষরের কোল
সেসব প্রকাশকালে
হেমন্ত দর্পন
নাছোড় প্রতিফলনে
ঢেকে নাও বিপন্ন আঁচল।
হেমন্তে
ইয়াসির আরাফাত
একদিন সবুজ মাঠের ভেতর দিয়ে
আবার ফিরে যাব গ্রামে
আম কাঁঠাল অশ্বথের বনে বনে
ধানের মাতাল গন্ধে খুঁজে নেব নষ্টালজিক বিকেল;
বাবার হাত ধরে হেঁটে যাওয়া সোনাধান জমি
কাদামাটি ঘ্রাণ,
চোখের কোণে উড়ে যাওয়া বক
কি করে হারায় দিগন্তে লালে
আবার একদিন হেমন্তে
ফিরে যাব গ্রামে কাঁচা ধানে খুঁজে নেব
মায়ের গায়ের ঘ্রাণ-বাবার হাসিতে
আমার শৈশব সত্তার উপাদান।
হেমন্তের প্রত্যাবর্তন
মিশকাত উজ্জ্বল
এই হেমন্তে নববিবাহিত দম্পতিদের মতো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
গ্রহণ করেনি ফসলী জমিগুলো।
মৃত্তিকার সফল প্রজননে ব্যাপক গর্ভবতী হয়ে উঠবে ধানগাছ-
ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শী কৃষকগণ প্রস্তুত থাকবে দড়ি কাস্তে সমেত।
ধান কাটা সারা হলে মঙ্গাক্রান্তরা মেতে উঠবে ঈদোত্তর মহোৎসবে
সেমাই পোলাও, নতুন জামা খোয়াবোপম;
অন্ন নিংড়ানো জল এবং লজ্জাচ্ছদটুকু জোটেনি যাদের গত ঈদে
তাদের মুখে উঠবে নবান্ন-ব্যঞ্জন, পরিধেয়।
গ্রাম্যবধূ ও বালিকারা- যারা শহরে গিয়েছিল কাজের খোঁজে-
স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করবে পাক-সাফ হয়ে।
সুন্নতি আলখাল্লা পরিহিতরা দুধের মাছির মতো ছড়িয়ে পড়বে;
আবার যথারীতি গ্রাম-গঞ্জে; ওয়াজ-নসিহতে।
শব্দ কুড়ানো
হাফেজ আহমেদ রাশেদ
আজ দিগন্তে গোধূলি শেষে
সবুজ সমারোহে হারিয়ে ছিলাম,
শব্দ কুড়ানোর শখে।
মনে হল সব
হাঁপাতে হাঁপাতে শ্বাসরোদ্ধ আবেশে,
এক পেয়ালা শব্দ কুড়ে ফিরলাম অবশেষে।
প্রকম্পিত কাঁচা হাত শব্দ প্রয়োগে,
শব্দের গাঁথুনিতে ছন্দপতন,
তবুও যদি এলোমেলো নির্মাণে,
শব্দের ঝংকারে রূপ নেয় কাব্যরত-
পরিতৃপ্ত হবে মনন।
যে কবিতা বলবে সজীবতার কথা,
জীবন্ত মাঠ ও মাটির লুকায়িত বেদনা,
স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ফুটাবে শ্যামলের হাসি।
যে কবিতা কৃষকের গ্লানি,
আনন্দ বেদনার প্রতিচ্ছবি,
গৌরবান্বিত বাংলা মায়ের
সবুজ আঁচলে ঝলমলে প্রতিমা,
দূরদূরান্তের রংতুলি এঁকে দেয়
এক এক শব্দের প্রয়োগে।
তবে আমি সার্থক,
সার্থক আমার দিগন্তে সমারোহে শব্দ কুড়ানো।