দুঃখী বাবা




দুঃখী বাবা
আহমদ মেহেদী

১. হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি। রোগীদের পাশে তাদের কত আপনজন! আমার মা নেই। বাবাই আমার একমাত্র আপনজন। মা গত বছর মে মাসে মারা গেছেন। আজ বাবা ও আসতে পারেনি। তিনি ঢাকা গেছেন আমার ছোট ভাইয়ের বিদেশের ব্যপারে মেডিকেল করাতে। ফিরতে রাত হবে বলে গেছে। কী জানি কখন আসে বাবা। হাসপাতালের ভিতরে কেমন জানি অস্বস্তিকর গন্ধে মাথা ধরে যাবার মত অবস্থা। চিৎকার, চেচামেচি আর হট্টগোল হাসপাতালের পরিবেশকে আরো ভারী করে তুলছে। সকালে বাবাকে বলাতে আমার জন্য একটি পত্রিকা এনে রেখে গিয়েছিলেন। আপাতত পত্রিকা পড়া ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না। আজ দুপুরের খাবার আসবে ফাতেমা আপার বাসা থেকে। ফাতেমা আপা আমার বন্ধু সুজনের বড় বোন। তাদের বাসা হাসপাতাল থেকে কিছুটা দূরে। তার ননদের আজ বিয়ে হবার কথা ছিল। কী জানি বিয়ে বাড়ীতে এত ব্যস্ততার মাঝে আমার খাবারের কথা কি মনে নাই সুজনের? সুজন বলেছিল কাজের ছেলেটিকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবে।

২. বাবার ফিরতে রাত হল। তার চোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। বাবা বলেন কীরে দুপুরে খাবার পাঠিয়েছিল? হ্যাঁ বাবা। তা বলেই বাবা হাসপাতালের ওয়াশ রুমে গেলেন। বাবাকে মিথ্যা বললাম। তাঁকে দেখে সত্যি মনের ভিতর কেমন জানি করে উঠে। মা মারা যাবার পর বাবা আর বিয়ে করেনি। তাঁর ধারনা যাকে নিয়ে দীর্ঘ ২২ বছর সংসার করেছি তার মৃত্যুর পর বিবাহ সে করে কীভাবে? আমি বাবাকে একবার বলেই ফেলেছিলাম বিয়েটা করেই ফেল। আমার দু’ভাই দূরে দূরে থাকি। জীবনের প্রয়োজনে মানুষকে অজানাতে ছুটতে হয়। প্রুতিনিয়ত জীবনকে বাঁচাতে মানুষের নান পথ কখনো বা গন্তব্য ছোঁয়ার স্বপ্নকে লালন করে পথ হারাই- পথ খুঁজে পাই। কিন্তু মা হারালাম- মা আর পেলাম না। একজন বড় বোন থাকলেও চলত। কিন্তু সেটা ও নেই। বাবা দিনের পর দিন কেমন জানি রোগা হয়ে যাচ্ছে। আমার অসুস্থ্যতার কারণে তাকে আরও বেশি চিন্তিত মনে হচ্ছে। এদিকে ছোট ভাইয়ের বিদেশ যাওয়ার টাকার জন্য বাবা নানান মানুষের কাছে ছুটাছুটি করছেন- হাত পাতছেন। হাত পাতা মানুষকে দেখলে সবাই কেমন করে জানি তাকায়! দেখলে সত্যিই খুব অবাক লাগে। অতি আপনজনরা সেই অসয়হায়ত্বের নমুনা দেখে বড় বেশি তৃপ্তি হাসি হসে। অথচ রক্তের টান নিয়ে কত টানা- হ্যাচড়া।

বাবাকে বলেছিলাম খোকন চাচার সাথে দেখা করার জন্য। আমাকে একটা চাকুরি বলেছিল। সেই এস.এস.সি পাশের পর াকাক বলেছিল-তোকে ঢাকা নিয়ে যাব। ভাল একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিব। কই এইচ.এস.পির পর ও তো কাকার কথার মর্মটা বুঝতে পারলাম না। হয়তো ভুলে গেছেন তার ভাতিজাকে দেওয়া কথাটা। ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। আমরা জন্ম ভুলে যাই; মৃত্যু ভুলে যাই। ভুলে যাওয়াটা এখনকার সমাজের নিত্য ব্যাপার।

৩. দুপুরে একটু ঘুমিয়ে ছিলাম। সুজন এসে আমার ঘুম ভাঙ্গালো। সুজন বলল-চা খাবি? আমি নিচের দোকান থেকে রং-চা নিয়ে আসি। আমি বলালম- চা খাব না। সুজন বলল- জয়নাল রাগ করিসনা। ঐদিন কাজের ছেলেটি বিয়ে বাড়ি থেকে আপার মোবাইলটা চুরি করে পালিয়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম সে তোকে খাবার দিয়ে গেছে। পরে আপা লজ্জায় আমাকে কথাটি বলতে পারেনি। আমি বলালম- সুজন, তুইতো আমার সেই হাই স্কুল থেকে বন্ধু। এ সামান্য ব্যপারে মন খারাপ করিসনা। তুইতো খাবারের ব্যবস্থা করেছিলি! ওই যে দেখ পাশের বেডে শুয়ে আছে তাঁর থেকেই দুপুরে খেয়েছি। আমার কেউ আসেনি দেখে মেয়েটির মা তাদের থেকে আমাকে হাফ দিয়েছেন। ও তোরেতো আরেকটি কথা বলাই হয়নি-তামান্না এসেছিল দেখতে আমায়। সুজন চুপ করে বসেছিল। যদি পারিস আনারসটা কেটে দে। তামান্না এনেছে। আনারস আমার খুব পছন্দের কিন্তু আজ খেতে মন চাচ্ছে না। খেতে তো হবেই তা না হলে সে রাগ করবে। আর শুন পাশের বেডের মেয়ে ও মাকে দুই পিছ দে।

সুজন বলল-মামুনের বিদেশ গমণের টাকা জোগার হয়েছে? আমি বলালম- হ্যাঁ, কিছুটা বাকি আছে। বাবা আর নোয়াখালি গেছে। সেখানে আশিষ নামের তার ব্যবসা- জীবনের এক বন্ধুর বাড়ি। তার কাছ থেকে হয়তো কিছু টাকা পাওয়া যেতে পারে।

৪. হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেলাম গতকাল মামুন বিদেশ চলে গেছে। শুনেছি ঠিক মত কাজ পায়টি। এদিকে বাবা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আমাদের দু ভাইয়ের দিকে চেয়ে প্রতিক্ষার দিন কাটান হাসপাতালের যাবতীয় খরচ তামান্না দিয়েছিল বলেই বাবা তার সম্পর্কে জেনে ফেলেন। আর আমাকে বললেন- এমন বন্ধু পাওয়া এই সংসারে বিরল। এতো বিপদে সে এগিয়ে এসেছে। তাকে একদিন আসতে বলবি আমাদের বাড়িতে। তাই বলেই বাবা ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

এর মধ্যে একটা এনজিও’র চাকুরি পেয়ে গেলাম। বিষন্ন বাবার মুখে একটু খানি হাসি ফুটাতে চেষ্টা করছি। আর বাবা বলে- আমাকে কিছুই দিতে হবে না; তোর নিজের চলা তুই চল। দেয়ালে পিঠ ঠেকানো থেকে কিছুটা মুক্তির স্বপ্নে আামর দিন কেটে যায়। বরবরই সংসার-উদাসিন ছেলেছি যখন আজ সংসারের হাল টুকু ধরতে চেষ্ট করেন তখন আমার বাবা মুগ্ধ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকনে। মা মারা যাবার পর থেকে ছোট চাচি আমাদের দু’বেলা রান্না-বান্না করেন। এমন করেতো আর চলতে পারেনা। অন্তত রান্নাবান্নার জন্য হলেও তো একজন লোক দরকার। এবার মনে হয় সত্যিই সংসারি হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। বাবা তার সংসার জীবনে যে লাঞ্ছনা (আত্মীয় দ্বারা) দুঃখ পেয়েছিলেন তা উপলব্ধি করার জন্য একটি ছোট্ট সংসার পাতা মনে হয় খুব খারাপ হবে না।

হাসপাতালের জানালা দিয়ে দেখলাম আকাশে মেঘ জমেছে। আর আমি ভাবছি কেমন জানি হয় আমার আগামী দিন গুলো। বাবার দিকে তাকালেই দু’চোখ ভিজে উঠে।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
২৬ নভেম্বর, ২০২১ এ ৩:৪৫ AM

FloKoin online shopping BD is an ultimate savings destination that makes life easier by providing discounts, coupons, cashbacks and deals on a wide varieties of categories of products at best price in Bangladesh.

Online shopping store in Bangladesh

Reply
avatar