(গত সংখ্যার পর)
০৪.
আরও দু’তিন দিন বিছানায় শুয়ে কাটিয়ে দিলো। বেবী আপা ডাকেননি। নিঃসঙ্গ বাসায় কোনো একাকিত্ব উর্মিলাকে স্পর্শ করেনি। বরং সম্পূর্ণ নতুন এক জগতের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাহসী, স্বস্তির বোধ হয়। উর্মিলার মনে হয়, না এখন আর পেছানোর সুযোগ নেই। সহস্র প্রতিকূলতায় জীবনকে বয়ে বেড়াতে হয়। উর্মিলা উচ্চস্বরে বলে, আমি প্রস্তুত।’ কী প্রস্তুত, কেন প্রস্তুত! প্রতিপক্ষকে? উর্মিলা কিছুই জানে না। শুধু মন এবং চিন্তার জগতে যুদ্ধংদেহী মনোভাব তেড়ে আসে। যা তাকে খুচরো ভাবনা থেকে মুক্ত রাখে। প্রতি সন্ধ্যাবেলা নিত্যনতুন সংবাদ নিয়ে ফেরে রুবী। তার অনেকগুলো মুখরোচক।
‘জানো, কোনার ডেক্সে যে মেয়েটি বসে ওর নাম মিতালী সিকদার। চাঁদপুরের মেয়ে। বিএ পাস। নায়িকাদের মতো সাজতে পছন্দ করে। ওর বোধহয় বয়ফ্রেন্ড আছে।’
‘কাল টোকন ভাই, কামরাঙ্গীরচর যাচ্ছে তিন দিনের জন্য। সার্ভে আছে। এ তিন দিন টোকন ভাই অফিসে আসবে না।’
‘আমার কিন্তু দীপু ভাইকে দারুণ লাগে। নিরহঙ্কার। হেসে হেসে কথা বলে। কথা বলার সময় চোখের মণি অবাক মনে হয়।’
‘তোমার জাকির সাহেবের সঙ্গে কাজ পড়ে কি না কে জানে?’ রুবীর কথা বলার ঢঙ্গে খুব অবাক হয়। রুবী এভাবে কথা বলে কেন? ক্যামন ইঁচড়েপাকা। উর্মিলা লজ্জা পায়। কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
বেশ সময় পর রুবী জিজ্ঞেস করে, ‘আমার কথা তোমার ভালো লাগেনি আমি জানি।’
‘রুবী আমি এসব কিছুই ভাবি না।’ উর্মিলা ধীর কণ্ঠে বলে।
‘আমি তাও বুঝি।’
‘আসলে আমি কী চাই তাও জানি না। কেন শুভপুরের সহজ জীবন ছেড়ে নগরে এসেছি। রুবী আমি কি ভুল করেছি?’
‘না।’
উর্মিলার আরও একটি নিস্তরঙ্গ রাত কেটে যায়। আটটার ভেতরে তড়িঘড়ি করে রুবী অফিসে চলে যাওয়ার পর পরিপাটি হয়ে রাস্তার গলির মোড়ের স্টুডিওতে গিয়ে পাসপোর্ট সাইজ ছবি তোলে। কলেজে ভর্তির সময় লাগবে। হেঁটে হেঁটে এটা-সেটা কেনাকাটা করে। প্রচ- গরমে একরকম ঘেমে রুমে ফেরে। আর তখনি মনে পড়ে জাকির সাহেব রুবীর বুকে হাত দিয়েছিল। এই ধরনের নীরব কষ্ট ওকে পীড়া দিতে থাকে। রুবী প্রতিবাদ করেনি? বেবী আপাকে জানাইনি কেন? রুবীকে খুব অসহায় মনে হয়। রুবীর মধ্যে গ্রাম্য-সরলতা আছে। ওর মধ্যে কি রুবীর মতো সারল্যে আছে...। নিজের কাছে প্রশ্ন করে উর্মিলা। শুভপুরে ছিল। ঘাসফড়িংয়ের পেছনে উৎফুল্ল কিশোরীর মধ্যে ছিল। ঝুম বৃষ্টিতে পিসিমার কাছে রূপকথার গল্প শোনার সময় ছিল। স্কুলে যাবার পথে ছিল। শুভপুরের ব্রিজ নাকি বংশাই-র জলে ডুব-সাঁতরে যে জীবন তার অবাধ চলাফেরায় যে আকাশ দেখেছিল তার পরতে পরতে নীলের সমারোহ। মুগ্ধতায় ভরা সময়ের বৈতরণী অতিক্রম করে উর্মিলা এখন নগরে এসেছে। সমুদ্রগামী নাবিকের মতো বাতিঘর খুঁজছে। এই রেখায় ওর জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি। গাঙচিলের মতো ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে সুদূর শুভপুর থেকে নগরে উঠে এসেছে।
এরও দুু’দিন পর বেবী আপা ডেকে পাঠাল উর্মিলাকে। নিউমার্কেট থেকে কেনা থ্রি-পিস সালোয়ার কামিজের সঙ্গে কিশোর বেনুনি ফুলিয়ে রুবীর সঙ্গে অফিসে যায় উর্মিলা। বুকটা দুরুদুরু করে। হিমশীতল রুমের ভেতরেও ঘামের স্বেদবিন্দু স্পষ্ট হয়। রুবীর টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে থাকে। পিয়ন দু’কাপ লেবু চা দিয়ে যায়। চায়ে চুম্বুক দিতেই দরজা ঠেলে দীপু ভাই ঢোকে। সুঠাম শরীর। টি-শার্টের সঙ্গে জিনস প্যান্ট, রিবকের কেড্স, উজ্জ¦ল হলুদাভ শরীরের রঙ। সব মিলিয়ে সিনেমার নায়কদের মতো। রুবীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আজ তোমাকে কিন্তু ক্ষমা করব না। নোটের কপি চাই।’
দীপু ভাই রুবীর টেবিলের সামনে দাঁড়ায়।
রুবী গদ গদ কণ্ঠে বলে, ‘কালই রেডি হয়ে গেছে। এখন শুধু ফাইনাল চোখ বোলাব।’
‘গুড। তাইলে একটু পর আমার টেবিলে পাঠিয়ে দিও।’
‘দীপু ভাই, ও উর্মিলা। আমাদের সঙ্গে কাজ করবে।’ দীপু ভাই উর্মিলার দিকে তাকায়। দু’হাত তুলে নমস্কার জানায়।
‘আপা বলেছিল। আপনার প্রতি আপার পক্ষপাত আছে। বোঝা যায়।’
‘না না। আপনারা যা ভাবছেন তা না। গ্রাম থেকে এসেছি। হয়তো নিজেই খাপ খাওয়াতে পারব না। তখন হয়তো এ পক্ষপাত থাকবে না।’ উর্মিলা খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে।
দীপু ভাই হাসতে থাকে।
‘রুবী, মেম কিন্তু বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে। এটাও একটা যোগ্যতা।’
উর্মিলা আশান্বিত হয়। বিস্ময় নিয়ে দীপু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘ঠিক আছে। ওয়েল কাম। রুবী নোটের কপি দিয়ে আমাকে রক্ষা করো।’ অসম্ভব সুন্দর হাসি উপহার দিয়ে দীপু ভাই পাশের রুমে চলে যায়।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উর্মিলার দিকে তাকিয়ে রুবী বলে, ‘উর্মিলা, দীপু ভাই ভালো না।’ উর্মিলা চোখের পাপড়ি নাচিয়ে সম্মতি জানায়।
রুবী তড়িঘরি করে দীপু ভাইয়ের নোটের ফাইল বের করে চোখ বোলাতে থাকে। উর্মিলা পাশে বসে সারা অফিসের দিকে চোখ, কান উৎকীর্ণ রাখে। প্রতিটি জিনিস থেকে পিয়নদের চলাফেরা লক্ষ করে।
তারও আধা ঘণ্টা পর বেবী আপা এলো। পরনে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। কাঁধে ঝোলানো শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। আধাপাকা চুল। পুরো লেন্সের চশমায় যেন আলাদা ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে।
উর্মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাহ! তোমাকে দেখে মনে হয় না তুমি ক’দিন আগে শুভপুর থেকে এসেছ!’
‘আপা, আমি তো শুভপুর থেকে এসেছি।’ উর্মিলা অকপটে বলে।
‘তা ঠিক, তা ঠিক। আমিও নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে এসেছি।’
উর্মিলা কথা বলে না। বেবী আপার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘অস্থির হওয়ার কিছু নেই উর্মিলা। আমি জাকিরকে বলে দিয়েছি। রুবী এবং অন্যরা তোমার প্রতি দৃষ্টি রাখবে। কাজ তো আর কেউ জন্ম থেকে শিখে আসে না। আস্তে আস্তে পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে হয়। তুমি পারবে।’
‘আপনি আশীর্বাদ করবেন।’
‘আমি জাকিরকে বলে দিয়েছি। কেরানীগঞ্জের সার্ভে মিশনে তোমাকে রাখার জন্য। এসব কাজ রুটস লেবেল থেকে শিখতে হয়। অনেকটা মমতা নিয়ে শিখতে হয়। তোমাকে মনে রাখতে হবে, তুমি মানুষ নিয়ে কাজ করছ। দুঃখী মানুষ। যাদের হাসি কান্না-সুখ-দুঃখ-চাওয়া-পাওয়ার ভাষা তোমাকে পথ দেখাবে।’
উর্মিলার চোখে জল এল। বেবী আপার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেকে আর অসহায় মনে হলো না।
শুধু বলল, ‘আপা, আমি কি পারব?’
‘শোন উর্মিলা, এ পৃথিবীর সৃষ্টিশীল কাজ সব মানুষ করে। আবার ধ্বংসযজ্ঞের নায়কও এরা। আর তুমি তো সৃষ্টির পক্ষে।’ উর্মিলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। বেবী আপা চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে উর্মিলাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘নারী হিসেবে নিজেকে রক্ষা করার যোগ্যতা জরুরি।’
বেবী আপার রুম থেকে বেরিয়ে রুবীর পাশে বসা পর্যন্ত ইতিউতি অসংখ্য ভাবনার নাগরদোলায় দুলতে দুলতে উর্মিলার মনে হলো, উর্মিলা তুই এখন নগরে থাকিস। নগর আর গ্রাম এক না। যে গ্রামে জন্ম, তার মানুষ, প্রকৃতি, বৃক্ষলতা তোকে রক্ষা করেছে। নগর তোকে গ্রাস করার জন্য ফাঁদ পেতে বসে থাকে। কারণ ছাড়াই অন্ধকার তোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। লুণ্ঠন করতে পারে তোর সম্ভ্রম এবং জীবন। তারপরও এই নগর থেকে তোকে শুরু করতে হবে। বার্তা পৌঁছাতে হবে প্রতি গ্রামে, মানুষের কাছে। চিৎকার করে বলতে হবে। এ পৃথিবীতে প্রতিটি পিপীলিকারও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। পৃথিবী নামক গ্রহের বাসিন্দারা তোমরা শোনো, আমি মাতামেরী, মা আমেনা, জননী যশোদা। অগনিত সন্তান জন্ম দিতে দিতে সর্বংসহা মানবিক প্রজাতি। গ্রহণ করো। জন্ম, জননী, জন্মভূমির দায়ভিক্ষা নিয়ে হাজির। তার কি কাঙালপনা মানায়!
ইত্যাকার অসম, অপরিমত ভাবনাগুলোয় আচ্ছন্ন উর্মিলা। না এতকিছু ভাবার বয়স ওর হয়নি। অতোটা শিক্ষাও অর্জিত হয়নি। তারপরও কেন এ ভাবনাগুলো ক্রমাগত মস্তিষ্কের কোষে কোষে তোলপাড় করে ওঠে। একবার মনে হয় ও কি ভেবেছে, কীভাবে প্রকৃতি, পরিবেশ, ধীরে ধীরে তাকে তৈরি করবে, উর্মিলা কি অপেক্ষা করবে?
রুবীর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায়।
‘কি রে এত বিষণœ কেন? দীপু ভাইকে নোটের কপি দিয়েছি। তোকে দেখে খুব অবাক হয়েছে।’
উর্মিলা কথা বলে না।
খুব হাস্যকর ভাবে বলে, ‘ও মেয়ে পিপলস রিলেশন রাখবে কীভাবে? ওর তো সিনেমার নায়িকা হওয়া উচিত। খুব সরল না।’
‘দীপু ভাইকে বলে দিস, আমি নায়িকা হওয়ার জন্য আসিনি।’ উর্মিলার গম্ভীর কণ্ঠ।