নাফের নিঃশ্বাস
মুনিম রাব্বি
আজও ফজর একটুও রাগল না। ওর বাম গালে হাসানমাঝির ডান হাতের পাঁচটি আঙ্গুলের দাগ লকলক করছে। তুই আমার নৌকারতন লাফ দিয়া মর । কোন কামডা পারো তুমি হ্যা ? তিন বেলা মাগনা খায়োন ছুডাইতাছি দ্বারা। অভিসপ্ত গলায় খ্যাচ খ্যাচ করে বলে গেল হাসানমাঝি । মধ্য বর্ষার অবিরাম বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়া নাফ নদীর মতন ফজরের দুই চোখও তলিয়ে যায় । ফজরের চোখে রাগ জন্মেনি এখোনোও । সাধারন চেহাড়ার ফজরের খানিক ছোট ছোট চোখ দুটো লাল হয়, লজ্জায়, অপমানে আর অনাদরে ।সুযোগ পেলেই হাত পা ফুস ফাস করে হাসানমাঝির । সুযোগ না পেলেও অকারন চরথাপ্পর না দিলে মাঝি বুঝি শান্তি পাননা । ফজর বছর পনেরোর এক রাখাইন কিশোর । সাম্পানে চড়ে রাত বিরাতে এভাবে ভাসেনি কখোনোও । কিন্তু জীবন সাগরের যে উন্মাতাল দহে সে ভাসছে তা এই যৌবনা নাফ নদীর চেয়ে দৈর্ঘে প্রস্থে গভীরতায় অনেক গুন ।
ফজরের শক্তিতে কুলায় না ।এত ভারি জাল টেনে টেনে উঠানো তাঁর সামর্থের বাইরে । যেন নদীর দেহ থেকে সমস্ত নদীর অন্তশ্বার টেনে তোলা । তবুও করতে হচ্ছে । শীরদ্বাড়া যেন ডেউরে ওঠে । অল্প বয়সী নবীন মাংসপেশী গুলো যেন প্যাঁচানো দড়ির মত ভেসে ওঠে । আনন্দে চোখ ভেজে , দুঃখ পেলেতো ভেজেই । কিন্তু ফজর জানত না শরীরের উপর বেশী জোর করলে তখনও চোখ ভিজে উঠতে পারে ।
ওস্তাদ, ও ওস্তাদ । একটু ধরেন না । পারতাছি না । ম্যালা ভার । এতো ভার জাল এহলা উডান যায় ?
হাসানমাঝি পানের পিচকানি ফেলে । উঠে দাঁড়ায় । এই পাইনসা জালডাও টানবার ক্ষেমতা নাই ? হাসানমাঝির হাতে কোচ ফেলার বাঁশ । সেই কোচ ধরে ফজরের পেটে খোঁচা দেয় কয়েকবার । জালের ভার ধরে আছে ফজর । পেটের মাংশপেশীর বিভক্ত রেখা গুলো ফুটে উঠেছিল । চোঁকতা বাশের খোচায় তাঁর পেটে রক্তের দাগ পড়ে গেল ।
সকাল থেকেই আকাশ ঢেকে আছে পড়ত পড়ত মেঘে । হালাকা বাতাস থেকে থেকেই ভাড়ি হচ্ছে । ফজর খবর পেয়েছে । আজ আকাশ ভাল না , সাগর ও বেজায় চটে আছে । বিক্ষুব্ধ সাগরে আজ কেউ নাও ভাসাবে না । তবুও সে ঘাটমালিকের ঘাটে যায় । দূর থেকেই হাসান মাঝির চোখ দেখা যাচ্ছে । সাগরের চেয়েও ক্ষেপে আছে যেন । ফজর দর দর গলায় আগেই বলে ওঠে ,
চাচা আইজতো আকাশ ভালা না , তাই ভাবছি নাও ভাইসবো না ।
হাসান মাঝি দাঁত কামড়ায় । বাঁশের কোচে ভর দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ,
চান্দু , তোমারে ছুটি দিছে কোন বাপে ?
ফজর মাফ চায় । ওর চোখে মুখে ক্ষমা চাওয়ার তীব্র আকুতি । শ্যমল মুখের ছোট্ট রেখায় ভয়ের তীব্র সংকোচন । অবনত ধরে চোখ থেকে পল পল জল নিংড়ে অন্তত একবার প্রথমবার হাসানমাঝির কাছে মাফ চায় । কিন্তু না , ততক্ষণে নাফনদীর পানি শুকনো ধুলোর উষ্ণদুকূল ভিজিয়ে দিলেও হাসানমাঝির মন ভেজে না । লুঙ্গি খিচিয়ে ধেয়ে আসে । কাঁচা কঞ্চির ডাল দিয়ে ফজরের ধূসর পীঠের ছোট্ট অঞ্চলে একবার দুইবার কয়েকবার সজোড়ে আঘাত করে । ফজরের কান্না থেমে যায় । চোখ মুছতে মুছতে কাঁপা পায়ে এগিয়ে যায় সাম্পানের দিকে ।
আজও যেন ভোর ভোরেই আটকে আছে । পাহাড়ের খুব কাছে এসে মেঘগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে । দমকা বাতাসে ক্যম্প জুড়ে ফত ফত আওয়াজ শোনা যায় । চোখের সামনে অগনিত প্লাস্টিকের ত্রিপলের ছাউনি পাহারের গায়ে ক্ষতের মত দেখা যায় । লেদা ক্যাম্পের সি ব্লকের ছোট্ট কুড়েঘরে থাকে ফজর । কাদামাটিতে লেপ্টে থাকা এই ঘরের দেয়ালের কোন জানালা নাই । ত্রিপলের ছাউনিতে মৃদু বৃষ্টির ছন্দ উঠেছে । সেই ছাউনীর একফাঁক দিয়ে বিস্তীর্ন আকাশ দেখা যায় । এই আকাশ দেখা , ছাউনীতে বৃষ্টির অনিন্দ ছন্দ শোনা শুধু বেঁচে থাকার আক্ষেপ বাড়ায় । এই আকাশ দেখার চোখ নেই ফজরের। চোখ মেললেও সেই চোখের যে কোন জানালা নাই ।
পৌষের মাঝামাঝি । অনেক দিন ধরেই মাছের তেমন বাজার নেই । তবে এতে হাসানমাঝির খুব একটা যায় আসে না । হাসানমাঝির আরো ব্যবসা আছে । অনেকদিন পর বড় এক কারবারির সন্ধান পাওয়া গেছে । অনেক টাকার ব্যাপার । নাফের ওপার থেকে এপার আনতে পারলেই সিন্দুক ভরে ফুলে উঠবে হাসানমাঝির । দশ হাজার পিস ইয়াবা । শুধু নাফ নদী পার করে হাত বদল করতে পারলেই পিস প্রতি বিশ টাকা পাওয়া যাবে । কিছুদিন আগেও পিস প্রতি পাঁচটাকা পাওয়া যেত । ইদানিং পুলিশের আনাগোনা বেড়ে গেছে এই অঞ্চলে । আইন খুব কড়াকড়ি হওয়ায় এসব কারবারি করার রিস্ক সবাই নিচ্ছেনা । কিন্তু হাসানমাঝি এসব রিস্কের ধার ধারে না । সে এই সব কাজ ফজর কে দিয়েই করায় । উপায় হীন দাসের মত ফজরকে এসব করতে হয় বাধ্য হয়ে । এর আগে অল্প সল্প চোরাচালান সফল ভাবে করলেও এবারের ব্যাপারটা ভিন্ন ।
কুয়াশায় দিগন্ত ঢেকে গেছে । ফ্যাকাশে আবছায়ার অতলে কাঁদা মাখা নাফ নদীর কুল ধরে হেটে এগিয়ে যাচ্ছে ফজর । তখনো আলো ফোটেনি । আঁধার আর কুয়াসায় পাঁচ কদম দূরের মূর্তিও দেখা যায় না । গুনে গুনে দশ হাজার পিস ইয়াবা ফজরের সমস্ত দেহের খাঁজে খাঁজে আটকানো । জোয়ার আর ভাটার বাদান্যতায় ফজরের দিক ভ্রম হয়েছিল । ঠিকঠাক সময় মত ফজর এসে পৌছতে পারেনি । সকালের আলো ফুটে গেছে । ভটভট করে দুখানা ট্রলার এগিয় আসছে ভাটির বীপরিতে । ট্রলার ভরা পাঁচ থেকে ছয় জন অ¯্র সজ্জিত পুলিশ । ফজর জানেনা যে সে অপরাধি । জঘন্য অপরাধের অকুন্ঠ প্রামান তাঁর গায়ে জড়িয়ে আছে । ফজর এসবের কিছুই জানে না।
ফজর তাদের কে চেনেনা । সে শুধু জানে কিছু দিন আগে এই অস্ত্র সজ্জিত মানুষেরাই তাঁর বাবা এবং আত্বিয়দের হত্যা করেছিল । ঘড়বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল । ধাড়ালো ছোড়ার মাথা দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে অত্যাচার করেছিল । ফজর আবার পুরোনো আতঙ্কে ভীত হয়ে উঠল । তবে কি সে পথ ভুল করে রাখাইনেই ফিরে এসেছে ? আসে পাশে লুকানোর জায়গা নেই । দৌড় দিলে ধরা পরে যাবে । তাঁর গায়ের কাপরের রং ঝলসে গেছে । ঝলসানো কাপরের রং মাটির রঙের কাছাকাছি পৌছে গেছে । ফজর তৎখনাত মাটিতে উবু হয়ে শুয়ে পরল । এমন ভাবে শুয়ে পড়ল যেন তাকে দূর থেকে ভেসে আসা কলাগাছ কিংবা গাছের গুড়ির মত দেখায় । তাই হয়ত দেখাল । দুটো ট্রলার ভর্তি এত গুলো মানুষের এত গুলো চোখ ফজর কে আবিষ্কার করতে পারল না ।
পুলিশবাহী ট্রলার চলে যাবার পর ফজর মুখ তুলে তাকাল । তাঁর সমস্ত শরীরে লেপ্টে থাকা বস্তুর কোন ক্ষতি হয়নি । ফজর চারদিক ভাল করে তাকিয়ে দেখল । এবার ভাটির টান ধরে হাটতে লাগল । খানিক এগোতেই একটু দূরে একটি ঘাট দেখতে পেল । বাঁশের খুঁটিতে নৌকা বাঁধা । আর তাঁর উপর পা ঠেকিয়ে পেঁচার মত চোখ সাটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাঝি । শুকনো বড়ই এর মত মুখ শুকিয়ে গেছে তাঁর । ফজর ক্লান্ত তবুও তাঁর হাটার গতি বাড়িয়ে দিল । আজকের মত এমন বীরত্ব আর বুদ্ধিদীপ্ত কাজ এর আগে সে করেনি । ক্যম্পের আর কোন ছোকড়া কিংবা হারপাকা সাহসী ছেলে পেলেও এমন কাজ করেনী । আজ হাসান মাঝি তাকে নিশ্চই বুকে জড়াবে ।
কিন্তু তা হল না । ঘাটের কাছে যেতেই ফজর এর দিকে তেড়ে এগিয়ে আসল হাসান মাঝি ।
জানোয়ারে বাচ্চা , খানকির পুত , আমার মাল কোই ? মাল দে ? নইলে তোরে আজ গাঙ্গে ভাসায়া দিমু !!
এতক্ষন ফজরের ছোট বুকে ভালবাসা পাবার যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আশার কনিকা দানা বেঁধেছিল , সমস্ত ক্লান্তি ভেদ করে চোখেমুখে যে বীরত্ব আর বুদ্ধিমত্বার উচ্ছাসা প্রস্ফুটিত হচ্ছিল তাতে আঁকষ্মাৎ অকাল ভাটা পড়ল । ফজরের গায়ের পোষাকটি খুলে গেল । কাঁদামাখা শ্যমল উলঙ্গদেহখানি অসহায় অদৃষ্টের পানে চেয়ে আছে যেন । শরীরের বাঁকে বাঁকে জড়ানো ইয়্বাার বিশেষ প্যাকেট । তার ঘষায়ঘষায় কোথাও কোথাও কেটে ছিলে রক্ত বেড় হয়ে গেছে । সেই রক্ত কাদার সাথে শুকিয়েও গেছে । বিশেষ পদ্ধতিতে এই প্যাকেট গুলো শরীর থেকে ছাড়াতে হয় । শক্ত আঠাদিয়ে লাগানো প্যাকেট গুলো টান দিতেই ফজর যন্ত্রনায় ক্যাঁত করে উঠল । হাসান মাঝির তাতে কিচ্ছু আসে যায় না । প্যাকেট গুলো ছাড়ানোর পর ফজরের দেহের দিকে তাকানো যায় না । জোকের গায়ে লবন ছিটালে যেমন হয় ,ফজরের অবস্থা তেমন ।
তাঁর পর বেশকিছুদিন ফজর কে ভুগতে হয়েছে । পুলিশের ভয়ে বেশ কিছু দিন ক্যাম্পে যেতে পারেনি সে । পেটের নিচের অংশের এখনও জ্বালাপোড়া করে । ব্যাথার বিশে রাতে রাতে জ্বর আসে ফজরের ।ওষুধ নেই ,পেটে খাবার নেই । আবার ক্যাম্পে ফিরতে হয় । ধরা পড়লে পড়বে ।
কিন্তু তেমন কিছুই হলোনা । গত কয়েকদিনে ফজরের শরীর শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে । তাই হয়ত ওর দিকে পুলিশ তাকায়নি । কিন্তু এভাবেওতো নাখেয়ে বেঁচে থাকা যায় না । ফজর খুব ভাল মাছ ধরতে জানে । ভাল জাল বাঁধা , জাল ছড়ানো ,জালে আটকে পড়া তাজা তাজা মাছ নিপুন হাতে ছাড়াতে পারে । খুব ভাল কোঁচ ও মারতে পারে সে । ওর গ্রামে কোচ দিয়ে সে অনেক মাছ ধরেছে । ওকে একটা কাজ খুজতে হবে । হাসানমাঝির কাছে সে আর যাবেনা । ওখানে গেলে ওকে নিশ্চিত মরতে হবে । হাসানমাঝিই ওকে মেরে ফেলবে , নয়ত পুলিশ গুলি করে মারবে । সে মাছ ধরার অন্য জেলেদের দল খুঁজতে থাকে । মাতব্বরের আড়তে যায়, টিপুদের ঘাটে যায় । কিন্তু কেউ তাকে কাজ দেয় না । ফজরের শরীর এতটাই খারাপ যে ওকে দিয়ে হালকা কাজও করানো কঠিন । ফিরে আসতে পথে দেখা হয় হাসানমাঝির সাথে । হাসানমাঝি ফজর কে ডাক দেয় । ফজর হাসানমাঝির দিকে এগিয়ে যায় ।
কিরে ফজড়া শরীর ভালা হোইছে নি ? ভালা ভালাইত লাগে । তো , কামে আবি না ?
ফজর মাথা নিচু করে জবাব দেয় । আইচ্ছা চাচা । কাইলকারতন আমুনে ।
হাসান মাঝির জন্যে ফজরের ভাল স্বাস্থ্য কিংবা অন্যকিছুর দরকার নেই । সেবার প্রতি পিস ইয়াবা বাবদ বিশটাকা পাওয়ার কথা থাকলেও সে লাভ পেয়েছিল চল্লিশ টাকা করে । শুধুমাত্র ফজরই মাল ঠিকঠাক আনতে পেরেছিল । অন্যরা ধরা পরেছিল পুলিশের হাতে , কেউ আবার পালিয়ে গিয়েছিল । মুন্তাকে তো গুলি করে মেরেই ফেলল পুলিশ । তাই ফজরের এই কৃতিত্ব মুখফুটে না দিলেও হাসানমাঝি জানে ফজরের গুরুত্ব কতখানি । অন্তত একারনেই তাকে দু এক পয়সা দিলে হাসান মাঝির ক্ষতি কি ?
তাঁরপর বেশ কিছুদিন কেটেগেল । আজ সকাল থেকেই শামলাপুর ঘাটে বেকার বসে আছে ফজর । সাগরের বেতাল অবস্থায় মুখ ভার করে বসে আছে হাসানমাঝি । আজ মাঝির সাহস হবেনা । আজকের সাগরের সাথে পাগল ও পাল্লা দেবে না। কিন্তু সন্ধ্যার পর মাঝি ব্যাকুল হয়ে গেল । সারাদিন মাচালে বসে বসে ঢক ঢক করে কি যেন অশ্বাদ গিলেছে সে । আর তাতেই মাথার চারিধারে যেন গ্রহনক্ষত্র ঘুরছে আবিরাম।
ওই ফজরা টানা জাল আর কোঁচগুলান নে ? আর নুরারে নাও ভাসাইতে ক?
চাচা আকাশত ভাল ঠেহে না । আর নুরাওত ভাগছে । নুরা তো নাই ।
যেইডা কইসি হেইডা কর । নুরা ফুরা লাগব না । মোহনায় যামু । ভাটির টানে মাছ বেশি পাওন যায় । এই সোযোগ পাওয়া যায় না ।
কি আর করার । বাঁচবার তীব্র ইচ্ছা বা মরে যাবার অজানা ভয় কোনটাই ফজরের নাই । ঘাট থেকে নাও ছাড়ে মাঝি । শামলাপুর ঘাটমালিক জহুর আলম একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে । ঘাটমালিক চেঁচিয়ে বলে ওঠে , আরে ওই হাসান , আইজ আর যাওনের কাম নাই । কাইল যাইস । এই আন্ধার কুন্দারে যাইস না । মাঝি নির্বিকার । এই অসময়ে আলাপ করার কোন ইচ্ছা নাই তাঁর । মাঝির উত্তর দেয় ফজর , দাদা ভয় পায়ো না । যামু আর আমু ।
কালো আঁধারের কলঙ্ক সরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা । এখানে নাফের হালকা ঢেউয়ে নৌকা হাতির পীঠের মত দুলছে । এমন ফুলে ফেঁপে ওঠা নাফের বুক কোন দিন দেখেনি ফজর । নদীর ওপারে ঘুমধুম সীমান্ত । তার ওপারে পাহাড়ের কালো ছায়া পড়ে আছে । চরম নিশ্তব্ধতা জমে আছে চারিধারে । স্বদর্পে জেগে আছে শুধু নাফনদী , কালো মেঘের দূরন্ত আকাশ আর দূর থেকে ভেসে আসা হুঁশিয়ারের ধ্বনি ।
ভাসতে ভাসতে মোহনায় চলে আসে ওরা । নৌকা থেকে নিখুঁত নিশানায় খুঁটি গারে ফজর । এই কাজে তাঁর জুড়ি মেলা ভার । আর সেই খুটিতে কোন মতে জাল পাতে হাসানমাঝি । আর কিছু পড়েই শুরু হবে ভাটার টান । সে সময় জাল তুলে ধরলেই ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ আটকে যাবে জালে । আর সেই মাছের ভাল দাম পাবে কাল । অনেক দাম !
ভাটার টান শূরু হয়ে গেছে । নাফের উঁচু বুক যেন শ্বাস ছেড়ে দিচ্ছে । দুকূল খালি করে দিয়ে সব পানি যেন গিলে খাচ্চে ক্ষুদার্ত সাগর । এবার জাল টেনে ধরবার পালা ।জালে টান দিতেই চোখ জূড়িয়ে গেল হাসানমাঝির । ঝাঁক ঝাঁক চিংড়ি , ওলিয়া আর কোয়া মাছ । মাছে টৈটুম্বুর অবস্থা নৌকার । মাছ সামলাতে গিয়ে যে কত গুলো বিপদদ্ধনি বেখেয়ালে হাড়িয়ে গেছে তা কেউ জানে না ।
চাচা আর আটত না নৌকায় । চলেন যাই । অবস্থা ভাল লাগতেছে না । ফজরের কথায় মাঝি আজ আর রাগলো না । ঢুলু ঢুলু চোখে শুধু সম্মতি জানাল । আজ মনে মনে ভিন্ন হিসাব কষেছে মাঝি । এই বিপদ সঙ্কুল দুর্যোগ দুর্মর পথে ফজরই তাঁর পাশে ছিল । চরম বাধ্য থেকেও কেউ এমন মৃত্যু ঝুঁকি নেয় না । চল , আইজ যাইগা ...।
উন্মাতাল নাফ নদীর দহে ঢেউ এর কোন ব্যাকরন নেই । বেশামাল তড়ঙ্গে নৌকার দিক সামলানো কঠিন । আবারও হুঁশিয়ারি বেজে উঠল । এই বিপদধ্বনী সব সময় বাজে না । এর আগে হাসান মাঝি এই শব্দ একবার শুনেছিল । কয়েক বছর আগে । তুফানের কি যেন একটা নাম ? হ্যা সিডর ! তাঁর বেশ মনে আছে । খুব ভাল ভবেই মনে আছে । ফজরের চেয়ে বছর চারেক বড় হবে । হাসানমাঝির জোর করে মাছধরতে পাঠিয়েছিল সেদিন । সাবরাং ঘাটে ওই যে হাড়িয়ে গেল , তাঁর আজও কোন হদিস পাওয়া যায় নাই । মাঝি ঘামে । ভয়ে তাঁর হৃদপিন্ডের ব্যস্ততা বেড়ে যায় ।
মাঝি দ্রুত নৌকা চালায় । তার সমস্ত শক্তি নৌকাকে দাপিয়ে দিতে পারে অন্য যেকোন সময় । কিন্তু আজ কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না । মাঝির মুখে কালো আঁধারের ছাপ পড়েছে । হঠাৎ ভট ভট আওয়াজ তুলে নৌকার কল থেমে গেল । মাঝি আবার স্টার্ট দেয় । কিন্তু না , স্ব শব্দে আবারও থেমে যায় ।
নৌকা এতিমের মত ভাসছে । চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার । অবারিত বৃক্ষরাজিরা দুর্মর তুফানে চরমর করে ভেঙে যাচ্ছে । একটা পাখিরও মৃত্যু আর্তনাদ শোনা যায় না । মেঘেদের চঞ্চলতার প্রতিচ্ছবিতে ভেঙে যাচ্ছে নাফের ফেনীল জলরাশি । মাঝি আবারও মেশিন স্টার্ট দেয় । বিকট শব্দে বার বার যেন চিৎকার করে ওঠে । নিষ্ঠুর সমুদ্রের ভয়াল অশুর যেন সেই শব্দ শুনতে পায় । ধেয়ে আসে আরো বিদ্ধংসী হিংসায় । নাফের ঢেঊ আছড়ে পড়ছে নৌকার উপর । নৌকার পাটাতন ধরে কোন রকমে টিকে আছে দুই জন । হাসান মাঝির নিখুঁত দৃষ্টি ফজর পর্যন্ত পৌছায় না । ফজর শুধু থেমে থেমে চিৎকার করে । নৌকা যে ঘুরছে , পাক খেয়ে ঘুড়ছে । চাচা ডড় লাগতাছে চাচা । আইজ মনেকয় বাচুম না ।
মাঝির কোন আওয়াজ নাই । নৌকায় দ্বিতীয় কোন মানুষের ছায়াও নেই । নৌকা থেকে খানিক দূরেই একটা বিকট চিৎকার শোনা গেল । হাসান মাঝি ভাসবার বাঁচবার চেষ্টায় হাত পা নাড়ছে । ফজর দেখতে পায় । তাঁর নৌকা হালকা হয়ে গেছে । সেই ঘূর্নি থেমে গেছে যেন । ফজর হাত বাড়ালে মাঝিকে পাবে না , বাঁশের কোঁচ এগিয়ে দিলে মাঝির নাগাল পাবে । ফজর দাঁড়িয়ে গেল । তাঁর মাথা ঘুড়ছে । প্রতিশোধের দূরন্ত নেশা তাঁর চোখ জুড়ে ভেসে উঠেছে । হ্যা , ফজরের ও রাগ আছে । মন আছে ,ব্যথা আছে । যে নিষ্ঠুর মানুষের ভয়ার্ত রাক্ষুসে মুখ সে এত দিন দেখে এসেছে তাঁর কাছে আজকের এই স্বার্থপড়তা কিছুই না । হাসান মাঝির মত ভয়ানক স্বার্থপর দালাল দের মরে যাওয়াই উচিৎ । বাঁশের কোঁচটি চোখ বুজে ফেলে দিল ফজর । অনেক দূরে , তাঁর পাকা হাতের নিখুঁত নিশানায় । এই কাজে তাঁর জুড়িমেলা ভার ।