পিতাকে নিয়ে সন্তানের শূন্যতা বোধ
বাসার তাসাউফ
ফজলুল কবিরী
এই বইয়ের লেখক বাসার তাসাউফের পিতা মাজু উদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিল। আর দশটা সন্তানের মতো তিনি পিতার মৃত্যু সহজে মেনে নিতে পারেননি। ভীষণ মর্মাহত হয়েছেন, ভেঙ্গে পড়েছেন, ছোট্ট শিশুর মতো চিৎকার করে কেঁদেছেন; তবু বুকের ভেতরের হাহাকার দমাতে পারেন নি। মনে হয়েছে, বুকের ভেতরে যেন দীর্ঘ একটা শ্বাস বাঁইকুড়ালি বাতাসের মতো ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে। সেই শূন্যতা আর হাহাকারের দীর্ঘশ^াসটি বুকের ভেতর থেকে বের করে বাতাসে উড়িয়ে দিতেই তিনি ‘পিতৃশোক ও দীর্ঘশ^াসের গল্প’ গল্পগ্রন্থটি লিখেন।
তিনি লিখেছেন, ‘আমার পিতা ছিলেন একজন কৃষক, একজন শ্রমিক, একজন জেলে এবং আরও বিচিত্র ধরনের কাজ তিনি করেছেন। গল্প-কবিতা বুঝতেন না; কিন্তু আমি চর্চা করি বলে ভালোবাসতেন। প্রতিবছর বইমেলায় প্রকাশিত আমার নতুন বইটি তাঁর হাতে তুলে দিতাম, তিনি নেড়েচেড়ে দেখতেন, খুশি হতেন। এই কারণে লেখালেখির প্রতি আমার ঝোঁক আরও বেড়ে গিয়েছিল। আমি পড়ালেখায় তেমন ভালো ছিলাম না। স্কুলে গণিত, ইংরেজি, ইতিহাস কোনো বিষয়ই ভালো লাগত না। তবে বাংলা বিষয়ের প্রতি বিশেষ টান ছিল। আবেগ ও ভালোবাসাও ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ঘিরে। আমি কখনও সিগারেট খাইনি, পানও মুখে তুলিনি কোনোদিন। কোনো কিছুর প্রতি আমার আসক্তি ছিল না; কিন্তু বই পড়া আর ডায়েরিতে রোজনামচা লেখার অভ্যেস ছিল। এই অভ্যেসটাই আমার জীবন বদলে দিয়েছে।
পিতার মৃত্যুর পর আমি অপ্রকৃতস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম, গভীর বিষাদে ডুবে যাচ্ছিলাম অহর্নিশি, অসীম শূন্যতা ঘিরে ধরেছিল আমাকে। সেই শূন্যতা এতই প্রকট আকার ধারণ করেছিল যে আমার কোনো কিছু ভাবতে, এমনকি নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হত। কারও পিতা চিরতরে হারিয়ে গেলে সন্তানের মনে কী রকম কষ্ট হয়Ñ আমি তা বুঝেছি। একই সঙ্গে আমি এ-ও বুঝেছি, জীবন যখন কাউকে নিচের দিকে টানতে থাকে, সে অবস্থায়ও সব ভেঙেচুরে ওঠে আসা ভীষণ কষ্টকর, বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়াও যেন যায় না। আমি বুঝেছি, জেনেছি, শিখেছিÑ জীবন একটা সমুদ্রতীরের বালুচর মাত্র। এ ছাড়া পিতার মৃত্যু আমাকে আরও অনেক কিছুই শিখিয়েছে। আমি যখন প্রবল আবেগে ভেঙ্গে পড়েছিÑ তখন নিজেকে বারবার বোঝাতে চেষ্টা করেছি; কিন্তু বোঝাতে পারিনি। তবে আমি কারও সাথে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলিনি। নীরবে সয়েছি। হঠাৎ একদিন আমার মাথায় আসে পিতৃশোক ভাগ করার যেহেতু কেউ নেই আর যেহেতু আমার লেখালেখির অভ্যাস আছে; পিতাকে নিয়ে একটি গল্প লেখা যাক। এভাবেই ‘পিতৃশোক ও দীর্ঘশ^াসের গল্প’ লেখা হয়েছে।
বাসার তাসাউফ ছোটগল্পের যে জমিনে পায়চারী করেন, তাতে আমাদের চেনা-জানা গ্রাম ও সংস্কৃতি তীব্রভাবে উঠে আসে। গল্পের চরিত্রে এসে ধরা দেয় জগামাঝির মতো সরল ও দরিদ্রপীড়িত অথচ প্রকৃতির মহৎ সন্তান। আবার কখনও দেখা যায় হাওয়াই মিঠাই বিক্রেতাই গল্পের মূল চরিত্র। তার সরল ও নির্মেদ ভাষাশৈলীতে কখনও বাবা, কখনও দাদি কিংবা কখনও বৃদ্ধাশ্রমে জীবনের শেষসময়ের গ্লানিময় দিনগুলো পার করতে থাকা মানুষের অন্তর্বয়ানে উঠে আসে আমাদের যাপিত জীবনের সুখ ও শোকগাথা। গল্পের নিরন্তর প্রবাহকে ধরে রাখতে পারার ক্ষমতা সব লেখকের থাকে না। এটা শেষপর্যন্ত একটা সংগ্রাম। লেখক গল্পের নিরন্তর সংগ্রামে সর্বদা ব্যাপৃত থাকুক এই প্রত্যাশা পাঠকের থাকবে। বাসার তাসাউফের ‘পিতৃশোক ও দীর্ঘশ^াসের গল্প’ বইয়ের গল্পগুলো সেই দাবী করে। বইটি অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশ করেছে শুদ্ধপ্রকাশ।
বইয়ের নাম: পিতৃশোক ও দীর্ঘশ্বাসের গল্প
লেখক: বাসার তাসাউফ
ধরন: ছোটগল্প
প্রকাশক: শুদ্ধ প্রকাশ
প্রচ্ছদ: চারু পিন্টু
দাম: ১৬০ টাকা