অদৃশ্য ইকুয়েশন
আজাদ মণ্ডল
শেষ পর্যন্ত, তার সাথে আমাকে কথা বলতে হল। অথচ তার সাথে কথা বলা আমার কোন ইচ্ছে ছিলো না।
আমরা বসে ছিলাম ফুটপাতের পাশে যাত্রীছাউনীর বেঞ্চের দুই পাশে। প্রথম দৃষ্টিতে তার থেকে নিজেকে আমি আলাদা করে নিয়েছিলাম। তখন চোখে ছিলো সানগ্লাস আর বৃষ্টিফোঁটা থেকে বাঁচার তাড়াহুরো। কিন্তু, দ্বিতীয়বারে দৃষ্টিতেও আমার মতের কোন পরিবর্তন হল না। এবার বরং সানগ্লাস বিহীন চোখে আমি তার আরো অধিক কিছু দেখেতে পেলাম, তাতে আমার মনোজাগতিক অহংবোধের ধারাল দাঁত খেঁকিয়ে উঠল। আমি দূর থেকেই তার ময়লা শরীরের দুর্গন্ধ টের পেলাম। মার্জিত এবং সুগন্ধী মাখানো পোষাকের কলারে নাক গুজে আমি বৃষ্টিরাণীর কাছে জোড় হাত করে প্রার্থনা করলাম, ‘ এবার ক্ষেমা দে মা, পেট গুলিয়ে যাচ্ছে!’ বৃষ্টিরাণীর ক্ষমা পাওয়া গেল না, তবে রাগ পেলাম! বৃষ্টি আড়াআড়িভাবে পড়ে আমার পাশটা প্রায় ভাসিয়ে দিয়ে চলল।
একান্ত বাধ্য হয়ে বড় করে দম নিয়ে আমাকে তার দিকে সরে আসতে হল। কারণ, তার পাশটায় মাঝারি সাইজের বটগাছের প্রাকৃতিক শেড থাকায় বৃষ্টিজনিত অধিক নিরাপদ ছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে তার খুব কাছে যখন সরে আসতে হল, তখন তাকে নিয়ে আমার প্রাক মনোজাতিক হিসেব-নিকেষের ইকুয়েশন উলট-পালট হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম মস্তবড় ভুল করেছি। অফিস থেকে বের হওয়ার সময়ও কলিগ আমাকে মানুষের মনুষত্ব গুন নিয়ে কথা বলছিল। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে আমি তা ভুলে গিয়ে অসত্য এবং মিথ্যা ধারণায় পোষণ করেছিলাম। কারণ, পেট গুলিয়ে উঠার হেতু সে ছিলো না। ছিলো যাত্রী ছাউনীর পাশে থাকা ডাস্টবিন। তার প্রতি আমার আত্ম-অহমকিার তাছিল্ল্য অপবাদ সময় গড়িয়ে খগড় রূপ ধারণ করল। আমার আত্ম-অংকারে আত্ম-গ্লানির টোকা পড়ল।
এবার, তারদিকে আমি অনুশোচনার নতুন এক চোখে তাকালাম। আমার মনোজগত ভুল শুধরে নেওয়ার তাগাদা অনুভব করল। বটগাছের ঝুলে থাকা শেকড় সদৃশ চুল, পরনের ড্রেসটা নোংরা, হাতে লাগানো মেহেদি আর পায়ের দিকে চোখ বুলাতে বুঝতে পারলাম শরীরের অযতœ খুব বেশি দিনের নয়। গোলপানা ফর্সা সরল মুখের মুগ্ধতায় তাকে আমার পাগল ভাবতে দ্বিধা হল। তবে, আমি তার দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হলাম। কারণ, তার দৃষ্টি ছিলো বাইরে। পীচঢালা রাস্তায় বৃষ্টি ফোঁটায় যে শিউলী ফুলের অবয়ব দেখা যায়, সেই মায়াবী দৃশ্যে সে ছিল একান্ত ধ্যানী। সোজাসুজি, আড়াআড়ি তালবেতাল বৃষ্টি পতনের কমবেশি শব্দ তাকে হয়তো মোহিত করেছিল। তার মুখের বিভিন্ন এক্সপ্রেশনে আমি সংক্রমিত হলাম। আমার হৃদয়গত অনুশোনার সাথে যোগ হলো কৌতূহল। অনুশোচনা আর কৌতূহলের সংমিশ্রণ আমাকে টেনে নিয়ে চলল বাইরের ঝুমঝুম বৃষ্টির তালে। আমি কল্পনা করলাম তাকে জনশুন্য যানবাহনহীন বৃষ্টিরত এক মায়াবী রাস্তায়। রাস্তার মাঝখানে সে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে মৌ মৌ করছে শিউলী ফুলের গন্ধ। শরীরের ক্লান্তি ধুয়ে স্পষ্ট হচ্ছে হাতের মেহেদী রঙ। সেই রঙে রঙিন হয়ে উঠছে পরন্ত বিকেলের চারপাশ। বটপাতা চিকচিক করছে আলোকিত হয়ে। জটা চুল গড়ানো পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে সমস্ত রাস্তার ময়লাদাগ। সে কখনো মুখে কখনো বুকে হাত লেপটে ঘুরে ঘুরে চোখ বুজে আলিঙ্গন করছে প্রকৃতির শুদ্ধতা।
তারপর আমার মোহ ভঙ্গ হল। রাজপথের জমে থাকা পানির কৃত্রিম ঝরনা উড়িয়ে চলে গেল দূরপাল্লার বাস। আমার মন আকুল হল। মোহ ভঙ্গের আকুল। তাই বলে প্রকৃতি তো শুন্য স্থান অপূর্ণ রাখে না। আবিষ্কার করলাম তার মিয়¤্রান দুটি চোখ আমার দিকে। আমি কেঁপে উঠলাম। মিয়¤্রান হলেও তার চোখে ছিল সমুদ্রের গভীরতা। অনেকটা সময় ধরে আমি আপন মনে নিমগ্ন ছিলাম তাকে নিয়ে। তবে, তার এক ধিয়ানি সাপের ফণার মতো চাহনীতে আমি বিচলিত হলাম। মনে হল তার চোখ কথা বলছে। প্রকৃতিস্ত হতে আমার কিছুটা সময় লাগল। তারপর মুচকি হাসি হাসলাম। বুঝাতে চাইলাম বৃষ্টি থামলেই চলে যাবো। তারপর আমি বিস্মৃত হলাম, সে কথা বলল-
তোর কী ক্ষতি করছিলাম বল ?
আমি ঘোরের মধ্য পড়ে গেলাম। নিজের মনোগত কাল্পনিক জগৎ থেকে আমাকে দ্রুত বাস্তবিক জগতে ফিরে আসতে হল। অধিক দুরত্ব না হওয়ায় অফিস শেষ করে সাধারণত হেঁটেই বাসাই যাই। আজও যেতে ছিলাম, মাঝপথে বৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এই যাত্রী ছাউনীতে আশ্রয় নেওয়া। এমন পরিস্থিতিতে যে কেউ আশ্রয় নিতে পারে সে হোক ছাগল অথবা পাগল। আবার বৃষ্টিজনিত অলস সময়ে পরিচিত কারো সাথে কথাও বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এই মেয়েকে তো আমি চিনি না। সে এভাবে লাভ ক্ষতি হিসেবের গরমিলের উত্তর আমার কাছে চাচ্ছে কেন? আমার দ্বিধা কেটে গেল। বুঝতে পারলাম মেয়েটা সত্যিই পাগল না হলেও কাছাকাছি। তারপরও মানবিকবোধে আমি আবার মুচকি হাসি দিলাম। এবার বুঝাতে চাইলাম আমি তার পরিচিতজন নই। তার কোন ক্ষতির হেতু আমি না।
হাসছিস কেন? উত্তর দে, আমারে কেন আনছিলি এই দোযখের শহরে?
দোযখের শহর? বিস্ময় হওয়ার একটা সীমা থাকে। মনে হয় আমি তা অতিক্রম করলাম। আচ্ছা, আমি কী স্বপ্ন দেখছি? বাইরে তুমুল বৃষ্টি আর যাত্রীছাউনীর নিচে কেবলমাত্র আমরা দুজন। জনপূর্ণ আর যন্ত্রিক এ শহরে মানুষ গাড়ির এমন আকাল পড়বে কেন? আবার এমন অগোছাল পাগলের মতো একটি মেয়ে যাকে কোনদিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সে কিনা স্পষ্ট কথা বলছে জবাবদেহিতার স্বরে! আশ্চর্য বিষয় বটে। আমি কেন এই পাগলকে এই শহরে আনতে যাব? নিজের শরীরে চিমটি কাটলাম। ব্যাথা, তারমানে জেগে আছি। অনুশোচনা আর অধিক কৌতুহলের দোলাচালে ফাঁক গলে আমি এ কোন প্রশ্নজালে আটকা পড়লাম? যে তাকে এই শহরে এনেছে তার হয়ে কিভাবে আমি এমন ক্ষোভ মিশ্রিত প্রশ্নের উত্তর দিব? বাইরের কালো আকাশের ঘনঘটা আমার মনের আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। তার জবাব চাওয়ার উত্তর সহজ নয়। প্রতারিত মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়েও থাকা যায় না। তবুও তার অভিযোগের ব্যক্তি যে আমি নই। সেটা তো বলতেই হবে,
আমি হেসেছি কারণ তুমি ভুল দরজায় কড়া নেড়েছ, আমি তোমার সে নই।
এবার সে নিশ্চুপ। আগের মতোই বাইরের বৃষ্টিতে ধ্যানী। সে আমার উত্তর হয়তো শুনেনি কিংবা শোনতে চায়ও নি। আমিও আবারও তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কথা বললাম-
আচ্ছা, যে তোমাকে এই শহরে এনেছে সে কী তোমার প্রেমিক?
কোন উত্তর নাই। তবে, প্রশ্নটি মন হল তাকে আন্দোলিত করল। এবার, সে যে চোখে আমার দিকে তাকাল তা ¤্রয়িমান নয়। তাতে ছিল আগুন। তারপর সে যা করল তাতে আমার মনে হলো সত্যি আমি জেগে নয় স্বপ্ন দেখছি। হঠাৎ-ই সে গায়ের কামিজ উপরে তুলে বুক দেখিয়ে বলল, ‘দেখ, শুয়োরের বাচ্চা ,ওরা আমাকে কিভাবে কামড়িয়ে ছিঁড়ে খেয়েছে, তুই কার হাতে তুলে দিয়েছিলি আমারে? তুই আমারে বাড়ি দিয়া আয়।’ এই বলেই সে দৌড়ে গিয়ে ডাষ্টবীনের ময়লা আবর্জনা ঘাটতে লাগল।
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, আকাশের বিদুৎ চমক আমার সারা শরীরে তরঙ্গায়িত হল। আমার সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। মনে হল তপ্ত উনুনে আমি বসে আছি। তার দিকে তাকাতে আমার ভয় হল। কী নিদারুণ ট্র্যাজেডি! আসলে মেয়েটি কে? কোথায় তার বাড়ি? কোন পাষাণ তাকে এই বয়সে এই মর্মস্পর্শী বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে? উত্তর মিলাতে পারলাম না। মেয়েটি এলোমেলো পা ফেলে বৃষ্টির মধ্য অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমিও রাস্তায় নেমে পড়লাম। আমার কলিগের কথা মনে পড়ল, ‘রাস্তা-ঘাটে অসংখ্য মানুষ হরেক বেশে চলাচল করে। প্রত্যেক মানুষই জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। ঠিকমতো ঘাঁটাঘাটি করলে প্রত্যেকজনের কাছ থেকে রহস্যের গুপ্তখনি পাওয়া যেতে পারে। যে রহস্যের বেশিরভাগ ইকুয়েশনের শেষ উত্তর শত চিন্তা-ভাবনা করেও মেলানো যাবেনা।’ পাগল সদৃশ মেয়েটির জীবনাবৃত্তের রহস্যের ইকুয়েশন মাথায় নিয়ে আমি অগনিত মানুষের মাঝে হারিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু আমার শেষ রক্ষা হল না। মনে হল আরো অসংখ্য অদৃশ্য ইকুয়েশন আমার মাথায় ক্রমাগত যোগ হয়ে চলছে...