জাফলংয়ের পথের বাঁকে




সংগ্রামপুঞ্জি
জাফলংয়ের পথের বাঁকে

আহাদ আদনান

অনিক দাশের ব্যাটারি চালিত গাড়িটা বেশ ঝকঝকে। পথে নেমেছে দুই মাসও হয়নি। সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত গাড়িটা চালায় অনিক। ওর অবশ্য স্কুল আছে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে ছেলেটা। তবে স্কুলে যেতে হলে নৌকা করে পিয়াইন নদী পার হয়ে যেতে হয় গুচ্ছগ্রাম। সেটাও জাফলঙেই, কিন্ত সম্পূর্ণ অন্য একটা পরিবেশে। শরৎচন্দ্রের ‘বিলাসী’ গল্পের মত এত কষ্ট করে বিদ্যার দেবীর আরাধনা করতে কোনই চাপ নেই অনিকের পরিবারের। সংগ্রামপুঞ্জিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে মোটে দুইটি। প্রাথমিকেই তাই এই গ্রামের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের পড়ালেখা শেষ হয়ে যায়।

এই এলাকার ইতিহাসটি বেশ চমকপ্রদ। গোয়াইনঘাট একসময় ছিল জৈন্তাপুর রাজ্যের অধীনে। স্বাধীন সার্বভৌম এই রাজ্যের রানীর বিভিন্ন নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি তামাবিল মহাসড়কের এখানে সেখানে। পলাশীর যুদ্ধের প্রায় আশি বছর পর, ১৮৩৫ সালে জৈন্তাপুর ব্রিটিশদের কব্জায় আসে। তখনথেকে মুসলমানরা এখানে স্থায়ী বসবাস শুরু করে। দক্ষিন এশিয়ার একমাত্র চুনাপাথরের খনি, সমতল ভূমির চা-বাগান, খাসিয়া পল্লীর নিজস্ব জগত এই পর্যটনকেন্দ্রের বিশেষ আকর্ষণ।


জাফলঙ পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় একটি স্পট। সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাট। এখানে আছে পাঁচটি ‘পরগনা’। ধরগ্রাম, আড়াইখা, পিয়াইনগুল, পাঁচভাগ আর জাফলং। পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ থাকে জাফলং জিরো পয়েন্ট, সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা (মায়াবী ঝর্ণা) এবং কাছাকাছি আরও কিছু ঝর্নার দিকে। এই সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্নার ঠিক দক্ষিণদিকেই একই নামের গ্রাম। অনিক দাশের অটোগাড়িতে চেপে আমরা চলে যাই গ্রামের ভিতরে।

খুব ছোট, ছিমছাম আর পরিচ্ছন্ন একটা গ্রাম। ছোট ছোট টিনের চালওয়ালা একতলা-দোতলা বাড়ি। তিনতলা পর্যন্ত মাথা উঁচু করার সাহস পায়নি কোন ছাদ। এটাই এখানকার ঐতিহ্য। বাড়িগুলোর নকশাতে বাঙালিয়ানার চেয়ে ভারতের মেঘালয়ের ছাপ বেশি। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে সুপারি আর পানের চাষ হয়। সবচেয়ে বড় সুপারিবাগান এখানকার জমিদারের।


জমিদার কিন্তু মহিলা। আসলে এখানকার অধিবাসী মূলত খাসিয়া। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী এই আদিবাসি ছাড়াও কিছু হিন্দু আর বৌদ্ধ অধিবাসী আছে গ্রামে। মোট সংখ্যা চার অঙ্ক এখনও স্পর্শ করেনি। খাসিয়ারা মাতৃ-কেন্দ্রিক পরিবার চর্চা করে। অর্থাৎ উপার্জন, তদারকি, সম্পদ বণ্টন, শাসনের ব্যাপারগুলো মেয়েরা দেখে। আর পুরুষেরা গৃহস্থালি কাজকর্ম, রান্নাবান্না, সন্তানপালনের কাজ করে। তবে ব্যাপারটা বাস্তবে খুবই অদল-বদলপ্রবণ মনে হল।

অনিকের ভাষায় এই গ্রামের মুল আকর্ষণ জমিদারবাড়ি। দুইতলা সাদার মাঝে নীলের কাজ করা বাড়িটা গ্রামের কেন্দ্রে। মোটামুটি হকি খেলার মাঠের অর্ধেক আয়তনের বাড়ির দোতলার বারান্দায় একজন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন। অনিক জানালো তিনিই জমিদার। বাড়ির ভিতরে যাওয়া নিষেধ। বিনাঅনুমতিতে ছবি তোলার প্রশ্নই আসেনা। জমিদারকে দেখে মোটেও মনে হলনা তিনি ছবি তোলার অনুমতি দিবেন। আমার সাথে ছিল সহকর্মী ডাঃ মাসুদ, ডাঃ রাশেদ আর তাদের একজন করে বাচ্চাসহ সহধর্মিণী। রাশেদ বলল, ভাই ছবি তোলা বাদ দেন।

গ্রামের শেষ মাথায় চা বাগান। কয়েক বর্গমাইল এলাকা জুড়ে সমভূমির এই চা বাগানটাও জমিদারের অধীনে। তবে এখানকার চা-পাতার মান পাহাড়ি পাতার মত এত ভালো নয়। সবুজ কার্পেটের মত বাগানটা দেখলে মনে হয় গা এলিয়ে দিই। কিন্তু মাসুদ বলল, আমরা কোনভাবেই গাছের কোন ক্ষতি করবনা। বাগানের পাশেই কিছু দোকানি (পুরুষ) চা-পাতা, সুপারি, পাথরের গয়না নিয়ে বসে আছে। আমাদের মত পর্যটকরাই এদের একমাত্র উদ্দেশ্য। তবে অনিক আগেই বলে দিয়েছে, এখান থেকে কিনলে খুব ঠকবেন।


অধিকাংশ অধিবাসী বাসায় গরু, ছাগল, মুরগি পালন করে। এরা জমিদারকে নিয়মিত খাজনা দেয়। ভারত থেকে ব্যাবসায়িরা বিভিন্ন পন্য গাড়িতে করে নিয়মিত বিক্রি করে যায় এখানে। দুইটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথাতো আগেই বলেছি। এখানে বাংলা ছাড়াও নিজেদের মাতৃভাষায় পড়ালেখা শিক্ষা দেওয়া হয়। প্রতিদিন সকালে সবাই মিলে গায় ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এছাড়া আছে গির্জা, খ্রিষ্টান কবরস্থান, একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। গ্রামের বাইরের দিকের পুরাতন সংগ্রামপুঞ্জি ভবনটি ছেড়ে নতুন গ্রামের ভবনটি ভিতরে চলে এসেছে। 


জাফলঙের বিষদ বর্ণনা, যাওয়ার উপায় অন্তর্জালে ছড়িয়ে ছিয়িয়ে আছে। তবে আমার লেখার উদ্দেশ্য অপরিচিত এই গ্রামটির কিছুটা পরিচয় তুলে ধরা। জাফলঙে আসলে একটিবার সংগ্রামপুঞ্জি ঘুরে যাওয়া উচিত। ডাঃ পলি রাশেদ আর তানজিয়া মাসুদ আপনাদের জন্য নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু টিপস দিয়েছেন। আশা করি কাজে কাগবে।

১। শীতকালে জাফলং, বাছাকান্দি না আসাই ভালো। এগুলোর আসল মজা বর্ষায়।
২। ভাড়া করা গাড়ির চালকের সাথে নির্লজ্জের মত দামাদামি করে নিবেন।
৩। নদী পার হয়ে জিরো পয়েন্টে যাওয়ার জন্য ট্রলারগুলো সিন্ডিকেট করে গলাকাটা দাম হাঁকাবে। আবহাওয়া ভালো থাকলে নৌকায় করে ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন স্পটে যাওয়ার চিন্তা করতে পারেন।
৪। পুরো পরিবারসহ রোমাঞ্চ উপভোগ করতে চাইলে সাথে বাচ্চা না আনাই ভালো।
৫। ঝর্ণার জন্য পাথর বেয়ে উপরে ওঠা খুবই বিপদজনক। বিশেষ করে প্রতিদিনই অনেকের মুঠোফোনের সলিল সমাধি ঘটে থাকে। পিচ্ছিল পাথরে পিছলে পড়ে অনেকের মৃত্যুও হতে পারে।
৬। ঝর্ণার পানিতে ভিজতে চাইলে শুকনো কাপড় সহ প্রস্তুতি নিয়ে আসবেন।

ঝর্ণা দেখতে প্রতিদিনই অসংখ্য পর্যটক আসে জাফলঙে। সংগ্রামপুঞ্জি গ্রামটাও অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন আপনার দর্শনীয় স্থানে।





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট