মা ও মমতা
আনোয়ার রশীদ সাগর
এখনো সন্ধ্য নেমে আসেনি। খেয়াঘাটের উপর দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশবাগানে পাখিগুলো ফিরছে। এ বরষায় বাগানটি বন্যায় ভেসে যাবে অথবা নতুন আয়ু পাবে।
বাগানের পাশে বেড়ায় ঘেরা বাড়িটিতে “এ্যাঁ-ম্যাঁ-এ” শব্দ করে গরুর বাছুরটি ডাকছে। জরিনার বিরহ মনে বার বার বলছে, আহা বাছুরটি মা-মা বলে ডাকছে। বাছুরটির মা কয়েকদিন আগে, রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে, সেই রাতদুপুরে ঘুম থেকে উঠে, বিছানা ছেড়ে দৌড়ে এসে, রামদা দিয়ে গলাটা কেটে ফেলে, গা’র চামড়া ছুলে ধম-ধম করে মাংসগুলো টুকরো টুকরো করে কেটে, সকালে বিক্রি করে দেয় রুনু মন্ডল। জরিনার স্বামী রুনু মন্ডল, খুব খামখেয়ালি। মাথায় যখন যা আসে, তখন তাই করে ফেলে, আগে-পিছে ভাবে না। বাছুরটার ডাক শুনে জরিনার মনটা পুড়ে যায়, কাঁদে সে, গরম কড়ায় তেলের উপর ঝাল দিয়ে ভাজার মত ছ্যাৎ-ছ্যাৎ করে মনের মধ্যে । গোপনেই আঁচলে চোখ মোছে, রুনু মন্ডলের চোখের সামনে চোখ মুছলে বিপদ, বলে ফেলে কুনকার ফ্যাতকাইন্দি শালিরে বিয়ি কইরি নিয়ি আনু, মাগীর মায়া দেকলি শরীরডা জ্বইলি যায়।
জরিনা তখন বলে, মিন্সির ময়া-দয়া কিছু নাই, পাষানডা যিন্ মিন্সির হৃদয়।
রুনু মন্ডল জরিনার কথা শুনে চেঁচিয়ে ওঠে, ইসরে-গরুডা মইরি গেলি, ট্যাকাগুণ তোর বাপে দিবিন, শর্-শর্ হারামী মাগী, আমারে ধ্বংস করতি আইয়িস।
জরিনা নীরব হয়ে, দূরে সরে যায়।
বাপের বাড়ি বলতে তো কিছু নেই, যার বাপ-মা নেই, তার দুনিয়া হাহাকার, জলশূন্য পদ্মারচর।
বাড়ি দুটো সৎ ভাই রয়েছে। যাকে বৈমাত্রিক ভাই বলে। তাদের জমিবাড়ি ঘর পদ্মার ভাঙনে ভেসে গেছে। এখন রেললাইনের উঁচু ঢালে ছোট ঝুপড়ি ঘর করে থাকে। তাদের দেখলেও জরিনার পরাণডা হুঁ-হুঁ করে কেঁদে ওঠে।
মা মারা গেলে, মায়ের ছোট বোনটার সাথে বাপজান আবার বিয়ে করেছিল, প্যান্ট ছিড়ে গেলে, যে রকম করে তালি দেয়, সে রকম করে বাপজান, সংসারে খালাকে এনে, তালি দিয়েছিল। খালা খুব ভালো বাসতো জরিনাকে, মা’র মতই আদর-যতœ নিয়ে, খোঁজ-খবর রেখে, বড় করে তোলে। জরিনার বয়স যখন ১২ বছর তখন ভাই দুটো খালার পেটে ছিল। সেই সময় জরিনার বিয়ের কথা হচ্ছিল। ছেলে ব্যবসা করে করিমপুর বাজারে। বিয়ের দিন ঠিক হবে, মঙ্গলবার রাতে। দূর্ভাগ্য জরিনার।
আগের দিন, সোমবার রাতে, খালার প্রসাব বেদনা ওঠে। ওরে বাবারে-মারে বলে, খালা চিৎকার করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পাড়া-প্রতিবেশীরা চিৎকার শুনে এগিয়ে আসে, সেই গভীর রাতে। মুরুব্বীগোছের দু’জন মহিলাও ছিল। তারা নাকি প্রসব বেদনা উঠলে, সন্তান হতে সাহ্য্যা করে, টাকাও নেই। ওদের এলাকার মানুষ ‘দায়’ বলে জানে।
প্রায় ভোর হয়ে আসছিল, তবুও খালার জ্ঞান ফেরে না। শেষ-মেষ সেই “দায়” মহিলাদের পরামর্শে খালাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সাথে জরিনা ও তার বাপজান যায়। বাপ-বেটি গালে হাত দিয়ে ঘরের বাইরে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে ছিল। পূর্বদিকে রাঙা হয়ে আসছিল। সূর্য উঠবো উঠবো মুহূর্তে দুটি শিশু ট্যা-ট্যা করে একসাথে চিৎকার করে উঠলে, জরিনার বাপ হাত তুলে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করতে থাকে, আল্লাহ তুমি আমার রক্ষাকবজ, তুমি দয়াময়।
এর কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার বেরিয়ে এসে বলে, স্যাড-ভেরি স্যাড; জুমকা ছেলে হয়েছে, কিন্তু বাচ্চা দুটোর মাকে বাঁচানো যায়নি। জরিনা কিছু বুঝে উঠার আগেই, গলা ফুঁপড়ে কেঁদে ওঠে বাপজান, আমার কি হইলুরে মা! আমার সংসারডা আবার ভাইসি গেলো। আহা-হাহা, আমি একুন কী কইরবুরে, কি কইরবু?
জরিনাও বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাও-মাও করে কাঁদতে থাকে।
জরিনা বাড়ি এসে ছোট গ্যাঁদ-গ্যাঁদি মাংসপিণ্ড সর্বোস্ব ভাই দুটোকে নিয়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। কি করবে সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। শেষ-মেষ পাড়া-প্রতিবেশি ও মুরুব্বীদের সহযোগিতা ও পরামর্শে, ছোট ভাই দুটিকে যতœ করতে থাকে, যেন মা হয়ে যায় জরিনা।
বাবা গা থেকে গরুর দুধ কিনে নিয়ে আসে, সে দুধ গরম করে, আবার হালকা ঠান্ডা করে খাওয়াতে থাকে। পাতাড়ে পড়া জীবন, গলাই দড়ি বাধা ছাগলের মত ছুটাছুটি করলেও খুঁটির সাথেই থাকতেই হয়। ঘানিগাছের গরুর মত একই দিকে ঘুরে ঘুরে একই জায়গায় থাকা,তেল বের হলো কী, দুফোঁটা পড়লো, তা দেখার সুযোগ থাকে না, চোখে ঠুসি দেওয়া গরুর মত জীবন চলতে থাকে। এভাবে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে দশটি বছর কেটে যায় জরিনার। বিয়ের কথা ভুলে গিয়ে, বন্যার ভয়াবহ ¯্রােত দেখে, নৌকায় উঠে, কোনোক্রমে আশ্রয় নেওয়ার মত সংসারের আটপৌড়ে কোণায় বসে থাকে জরিনা। তখন ভাই দুটি বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। মাঠে-ঘাটেও যায়-আবার সকালে স্কুলেও যায়। জরিনায় ভাই দুটিকে আলাল ও দুলাল বলে ডাকে। ডাকতে ডাকতে আলাল ও দুলাল নাম দুটিই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এরও কিছুদিন পর রুনু মন্ডল এক দূরন্তপনা স্বভাবের যুবক, বাবার চাচাতো বোনের ছেলে পরিচয় দিয়ে এ বাড়িতে এসে থাকা শুরু করে। হেলে পড়া গাছের সাথে ররুনু মন্ডল যেন, বিদ্যুতের খুঁটি হয়ে দাঁড়ায়। এ খুঁটির সাথে ঠ্যাস দিয়ে আলাল-দুলাল ও জরিনা মাজা সোজা করে, খাঁড়া হয়ে, চলতে থাকে। জরিনা বুঝে উঠতেই পারেনি, রুনু মন্ডল তার অর্ধাংগ হয়ে গেছে। হাব-ভাব বুঝে, জরিনার বাবা গ্রামের মৌলভী ডেকে ও দু-দশজন প্রতিবেশীকে দাওয়াত দিয়ে, রুনু মন্ডলের হাতে জরিনাকে তুলে দেয়। জরিনা লাল শাড়ি প’রে ঘুম্টা দিয়ে, ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে রুনু মন্ডলের বাপের বাড়ি ওঠে।
শশুর বাড়ি যাওয়ার আগে ভাই দুটিকে জড়িয়ে ধরে হুঁহুঁ-উহুঁউহুঁ স্বরে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিল।
মাত্র দু’মাসের মাথায় পদ্মার ধার ভাঙতে ভাঙতে এসে, জরিনার বাপের জায়গা-জমি ও বাগান-বাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। জরিনা রুনু মন্ডলকে সঙ্গে করে দেখতে এসে, সর্বনাশা পদ্মার ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া ¯্রােতের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিল, মানুষের জীবন কিছু না-এই আছে এই নেই!
অভাব অনটনে চারদিকে বড় হাহাকার শুরু হয়ে যায়। জরিনা রুনু মন্ডলের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুর বাড়ি ফিরে আসে। আসার সময়, আলাল আর দুলাল জরিনার পিছু পিছু অনেক পথ হেটে এসেছিল। এক সময় হাটতে হাটতে রুনু মন্ডল ঘাড় উঁচু করে ধমক দেয়, এই শালারা কন্ যায়ছি, বাড়ি যা!
রুনু মন্ডলের খেকানো গলার চানকা ধমক শুনে, আলাল আর দুলাল বাপের কাছে চলে আসে এবং রেললাইনের ধারে, উঁচু ধার কেটে কেটে কাশবনের বেড়া দিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে। রুনু মন্ডলের এ রকম ধমক আর নির্দয় ব্যবহারের মধ্যেও জরিনা সংসার করছে, যাওয়ার যে কোনো পথই নেই?
বিয়ের আগেই জরিনার পেটে যে ভ্রুণ এসে রুনু মন্ডল আর জরিনার সংসার করার ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিল, সে ভ্রুণ ধীরে ধীরে বড় হতে ছিল। জরিনার ভালোই দিন কাটছিল। তবে দুঃখ যে চিরসাথী, সে কথা বুঝলো, যখন মাঠ থেকে এসে, রুনু মন্ডল হাতের কাছে খাওয়া পানি না পেয়ে, জরিনাকে
কিল-ঘুসি মারা শুরু করে। মার খেতে খেতে জরিনা কাইত হয়ে পড়ে গেলে, রুনু মন্ডল জরিনার পেটে ফুটবলে লাথি মারার মত একটা লাথি মারে। জরিনা ককিয়ে ওঠে, ও বাবাগো-মাগো।
রক্তে ভেসে যায় ঘরের মেঝে।
বহুকষ্টে গ্রাম্য ডাক্তারের চিকিৎসায় বেঁচে যায় জরিনা। সেই থেকে চৈত্রমাসে দূরে মাঠে বাবলা গাছে ঘুঘু পাখি, ঘুঘু সুর করে ডাকলে জরিনার মনটা পুড়ে যায়, কান্নার সুর ভেসে আসে তার কানে। সে জানে না, কেন মনটা কাঁদে।
বাছুরটা হাম্বা-হাম্বা ডাকছে। অথচ জরিনার কানে ভেসে আসছে, ম্যায়ে-ম্যায়ে শব্দ, আহারে মা’হারা বাছুরডা...