নুশরাত রুমু’র গল্পগ্রন্থ
‘আঁধারে জোনাকি’
মানবিকতার অন্য এক প্রতিচ্ছবি
রেজাউল রেজা
সাহিত্য হলো সমাজের দর্পণস্বরূপ।
“আঁধারের জোনাকি” বইটির লেখিকা নুশরাত রুমু তাঁর দক্ষ হাতে দর্পণের মতই সুচারুরূপে বর্তমান সমাজের নানা ধরণের অসংগতির কথা চিত্রিত করেছেন।
শুধু চিত্রিত করেই থেমে থাকেননি বরং এসব অসংগতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ বাতলে দিয়েছেন গল্পে গল্পে।
বইটিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো-এখানে স্থান পাওয়া ছয়টি গল্পের মধ্যে দুটি গল্পই আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক।
বইটি পড়ে পাঠকমহল যেমন সমাজের নানা সমস্যা ও অসংগতির কথা জানতে পারবে তেমনই জানতে পারবে ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন খণ্ডচিত্র সম্পর্কে।
কে না সুখ পেতে চায়! মহাবিশ্বের সকল প্রাণীই সুখ বিলাসী। কিন্তু সবাই কি সুখ পায়? পায় না। যারা পায় তাদের মধ্যে কেউ বৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন করে সুখী হয় আবার কেউ সুখ নামক মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে অবশেষে অবৈধ পন্থা বেছে নেয়।
কিন্তু অবৈধ পথে অর্জিত সুখ কখনই স্থায়ী হয় না, তাতে তৃপ্তি থাকে না, মনে প্রশান্তি আসে না। অবৈধ পথে কেনা সুখের শেষ পরিণাম হয় ভয়াবহ।
বিজ্ঞ গল্পকার তাঁর ‘সুখের খোঁজে’ গল্পে এমনই একটি চমৎকার দৃশ্য অংকন করেছেন।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র জামাল অবৈধ পথে টাকা রোজগার করে যখন ভালো খাওয়া-চলা শুরু করল তখন প্রতিবেশীদের মনে কৌতুহল জন্ম নিল। জামালের স্ত্রী রাহেলাকে নানা ধরণের প্রশ্ন করতে লাগল। তাতে বিব্রতবোধ করে জামালের স্ত্রী রাহেলা তাকে জিজ্ঞেস করে:
এত টিয়া কোনাই হাও? রিশকা চলাই আর কত রুজি অয়।
তোর এত কতা জাননের কি দরকার।
তোরে আনি দিমু, রান্ধি বাড়ি খাবাবি, হোলা মাইয়া হাইলবি....
কথা টেনে নিয়ে রাহেলা বলে--
কা, বউ অইচি দেই হচি গেছি নি!
কোন কতা জাইনতাম হাইরতান্নো? মাইনসে কত কিছু জি¹ায়!
নিজ জেলা নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এই গল্পটিতে নানা ঘটনায় ফুটে উঠেছে বর্তমান সমাজের মহামারী রোগ মাদকের কুফল।
ভিন্ন মানুষ মাত্রই ভিন্নরূপ।
কারো সাথে কারো মিল নেই। একই পরিবারের একেক জনের একেক রকম বৈশিষ্ট্য। লেখিকা তাঁর ‘টক-ঝাল-মিষ্টি’ গল্পে মানুষের এই বিচিত্ররূপ সুনিপুণ হস্তে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস চালিয়েছেন।
বইটিতে স্থান পাওয়া ‘রুবাই’ গল্পটি পাঠকের হৃদয়ে নাড়া দেবে বলে আমি মনে করি।
একজন সাহিত্যিকের কাছে নিজের সাহিত্যকর্ম সন্তানতুল্য।
সর্বস্ব হারানো রিক্ত জীবনেও সাহিত্যিক তার সাহিত্যকর্মকে আগলে ধরে কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে তারই প্রতিচিত্র অংকন করেছেন লেখিকা তাঁর এই গল্পে।
দীর্ঘদিন নিঃসন্তান থেকে নানা জনের নানা কথা হজম করে অবশেষে সন্তান এলো ঐশীর গর্ভে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম খেলায় হেরে গেল সে। জন্মের আগেই সেই জীবনের প্রদীপ নিভে গেল। আরও জানতে পারল জরায়ুর একপাশে ঐশীর টিউমার হয়েছে যা অপারেশন করতে হবে।
যদি অপারেশন করা হয় তাহলে পরবর্তীতে সে আর মা হতে পারবে না। এমন খবরে ভেঙে পড়ল ঐশী।
ধীরে ধীরে শোক কাটিয়ে উঠতে লাগল, সেইসাথে তার পুরোনো অভ্যাস লেখালেখির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলো........
লেখিকা গল্পটির শেষপ্রান্তে এসে এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ঐশী সম্পর্কে লিখেছেন-
গর্ভজাত সন্তান পৃথিবীতে না আসতে পারলেও মস্তিষ্কজাত অনেক সন্তানের মা হয়েছে সে। কবিতারাই তার ‘রুবাই’ নামের সন্তান। তাদের লালন করেই মা হিসাবে বেঁচে থাকতে চায় ঐশী।
ভাগ্য কিভাবে মানুষের স্বপ্নগুলোকে চুরমার করে টেনে হিঁচড়ে তাকে নিচে নামাতে পারে, কিভাবে একজন মানুষকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও অসৎ কাজের দিকে পা বাড়াতে হয় তারই প্রতিচ্ছবি অংকিত হয়েছে ‘চম্পট’ গল্পে।
“ফেরার পথে নজরে পড়ল সেই দোকান যেখানে গফুর সাহেব তাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল।
সেই সরল হাসি আজ কপটতার আড়ালে চাপা পড়েছে। গাড়িতে হেলান দিয়ে মনে হলো
হায় টাকা! সবই তোমার মহিমা”।
বইটিতে স্থান পাওয়া ‘টাকার মহিমা’ গল্পের শেষ অংশ এটি।
লোভ মানুষের সবচেয়ে বড় একটি কুপ্রবৃত্তি।
লোভের বশবর্তী হয়ে মুহুর্তের মধ্যে একজন ভালো মানুষ খারাপ মানুষে পরিণত হতে পারে।
আর সেটা যদি হয় টাকার লোভ তাহলে তো কোন কথাই নেই।
সেটাকে সামলানো বড় কঠিন!
বর্তমানে সময়ে সবচেয়ে বড় নেশা টাকার নেশা। টাকার জন্য মানুষ সবকিছুই করতে পারে। পিতা-মাতার পবিত্র ভালোবাসাকেও তুচ্ছ করে তুলতে পারে এই নেশা। কিন্তু শেষ বেলায় এসে যখন মানুষ বুঝতে পারে টাকাই সবকিছু নয়, তখন আপসোসে বুক ভাসানো ছাড়া উপায় থাকে না।
এমন এক চমকপ্রদ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে ‘টাকার মহিমা’ গল্পে।
বইটির ৫৬ নং পৃষ্ঠায় ‘কালো জন্ম’ নামক গল্পের একটি বাক্য “নারী-পুরুষের প্রেম-মাধুরী জানার আগেই দংশিত হয়েছে তার নারীত্ব”
তার কয়েক লাইন পরেই লিখেছেন- “ক্যাম্পের পাশবিক নির্যাতনের ফসল বেড়ে উঠছে মনোয়ারার গর্ভে” এমন চমৎকার কিছু বাক্যচয়ন দাগ কাটবে পাঠক হৃদয়ে।
যার ফলে পাঠকদের মনে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান বেড়ে যাবে।
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এক বীরাঙ্গনা নারীর জীবনের করুণ কাহিনী এবং তার যুদ্ধ সন্তানের কথা গল্পের মাধ্যমে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন বইটির লেখিকা নুশরাত রুমু।
একদিকে সংসারের দায়ভার আর একদিকে দেশে মুক্তিযুদ্ধ। সময়বয়সী অনেকেই যুদ্ধে যাচ্ছে। কিন্তু তরুণ স্কুল শিক্ষক আন্তু যেতে পারছে না। কারণ তার পুরো পরিবার নির্ভর করছে তার আয়ের উপর।
যুদ্ধে যেতে না পারার অনুতাপে জ¦লে-পুড়ে মরছে। কিন্তু সে নিরুপায়। সে যুদ্ধে গেলে তার বাবা-মা, ছোট ছোট ভাই-বোনেরা অনাহারে মরবে। এসব ভেবে যুদ্ধে যাওয়া হয়ে ওঠেনি দেশপ্রেমিক আন্তুর।
যুদ্ধ শেষে যখন দেশ স্বাধীন হলো তখন আন্তু ভাবতে লাগল তাকে সারাজীবন সবার কাছে ছোট হয়ে থাকতে হবে যখন কেউ জানতে চাইবে তুমি যুদ্ধ করতে গিয়েছিলে কিনা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মনে মনে বলল--হে মাতৃভূমি তোমার বিপদে কোন কাজে লাগতে পারিনি কিন্তু দেশের সাথে বেইমানি করিনি এটুকুই সান্ত¡না....
এভাবেই এক অসহায় দেশপ্রেমিকের দেশপ্রেমের নমুনা তুলে ধরেছেন বইটির লেখিকা।
সব মিলিয়ে এটা বলা আবশ্যক যে, ‘আঁধারে জোনাকি’ অসাধারণ একটি গল্পগ্রন্থ।
এটি যেকোন বয়সের পাঠকের মন জয় করতে সক্ষম।
বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।