ক্ষমা করো
আতিক এ রহিম
আমাকে ক্ষমা কর। আমি পারিনি তোমাকে কথা দিয়ে কথা রাখতে। আমি সকল বীর যুদ্ধাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী। কেন ক্ষমা চাচ্ছি তা খুলে না বললে হয়তো কেউ বুঝবেন না। আমার লেখায তার কোন উপকার হতো কি না আমি জানি না? তার পরও কথা দিয়ে ছিলাম আমি তার কথাগুলো পত্রিকায় লেখব। আমি একজন ক্ষুদ্র রিপোর্টার। জেলার একটি পত্রিকায় কাজ করি। সেদিন গিয়েছিলাম নিউজ সংগ্রহ করার জন্য। এটি একটি সাংস্কৃতিক সাহিত্য সভা হলে কি হবে এখানে বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হয়েছেন যারা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। মঞ্চ ভর্তি লোকজন।আমি দাঁড়িয়ে আছি মঞ্চের সামনে । অতিথিদের বরণ করা হচ্ছে। আমি অতিথিদের ছবি নেওয়ার জন্য আমার দাঁড়িয়ে থাকা। এর মধ্যে একজন বয়স্ক লোক বারবার মঞ্চে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। প্রধান অতিথি এবং আরেকজন বিশেষ অতিথির সাথে কথা বলার জন্য।সে কিন্তু তাদের ধারে কাছে যেতে পারছে না। তার হাতে একটি ফাইল । ফাইলের মধ্যে কিছু পত্র দেখা যাচ্ছে। লোকটি যত বার যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে তত বারই বাধার সম্মুখিন হচ্ছেন। লোকটি দেখে আমার খুব খারাপ লাগল। এমনিতেই লোকটি বয়সের ভারে ন্যুহ হয়ে গেছে।আমি কাছে গেলাম ভাই আপনার কি সমস্যা? আমি মনে মনে ভাবছিলাম কোন মামলা মোকদ্দমা বা মেয়ের বিয়ের জন্য কোন সাহায্য সহযোগিতার জন্য এসেছেন। সে আমার সাথে একটু সরে এল আমরা দুজন মঞ্চের কাছ থেকে সরে লোকজন যেখানে চেয়ারে বসেছে আমরা দুজন পাশাপাশি বসলাম। লোকটি বলতে লাগল আমার নাম দেলোয়ার হেসেন। বাড়ি কুড়িগাওঁ। আমার মনে হলে তিনি কথা বলছেন তার দম ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে। তিনি বললেন আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এ ফাইলে আমার সব কাগজ পত্র আছে। কিন্তু আমি এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তালিকাভুক্ত হতে পারিনি।আমি বললাম কেন আপনি হতে পারেননি ? সে বলল জানি না আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় কাগজ পত্র জমা দিয়েছি কিন্তু আজো কোন কাজ হয়নি।আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করে তাকে বিরক্ত করতে মন চাইল না। আমি লোকটির কথা ভেবে কষ্টপেতে লাগলাম যে লোকটি জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যুদ্ধ করেছেন সে আজ একটি স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য দেশের নেতৃবৃন্দদের কাছে এক জন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের কাছে দৌড়াচ্ছেন। জানি না সে সরাসরি যুদ্ধ করতে পেরেছেন কী না আমার জানা নাই তবুও সে দেশের মানুষের জন্য দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যৌবনে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে দেশ থেকে শত্রু তাড়ানোর এগিয়ে এসেছিলেন। আমি মুক্তযুদ্ধ দেখিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে শুনেছি বইপুস্তকে পড়ে জেনেছি,বড়দের মুখে শুনেছি সে সময়ের পরিবেশ পরিস্থিতির কথা। তখন স্বাভাবিক ভাবে বেচেঁ থাকাটা ছিল খুব রিস্কি। আর যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তারা তাদের পরিবার পশ্চিম পাকিস্তানি আর রাজাকারদের চোখে কেমন ছিলেন তা সে সময় যারা বড় ছিলেন তারাই বলতে পারবেন।আমি তার সাথে কথা বলছি আর তার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছি।সে আমাকে বলেন,আমার কোন জমি জমা নেই বড় কোন ছেলেমেয়ে নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু একটা ঘর তোলার জায়গা।আমার প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ায় আমার দ্বিতীয় বিয়ে করতে হয়েছে সে ঘরে ছোট ছোট দুটি মেয়ে । ওদের লেখা পড়া চালানো আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর আমি ওদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারলাম না । আমি লক্ষ্য করে দেখলাম তিান যে জাম কাপড় পড়ে আসছে সে কষ্টে দিন যাপন করছে।তার মনের যত আকুতি মিনুতি আমাকে বলতে লাগলেন।আমি বুঝতে পারলাম তার মনের কথাগুলো হয়তো কেউ শুনেনি আজ পযর্ন্ত । তিনি আমার পরিচয় জানতে চান। আমি বলি আমি একটি পত্রিকায় নিউজ করি তিনি পত্রিকার কথা শুনে তার কথাগুলো লেখে পত্রিকায় দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।আমি মনে মনে ভাবি আমি সামান্য একজন একটি জেলার পত্রিকায় নিউজ করি আমার লেখা দ্বারা তার কোন উপকার হবে না ? আজ এখানে আপনার কথাগুলো শোনা সম্ভব না কারণ সাউন্ড বক্সের শব্দ তাছাড়া আজকের নিউজ কভারেজ করতে হবে। তাই তাকে বলি আপনার মোবাইল নাম্বার দেন আমি আপনার সাথে দেখা করব। তিনি আমাকে তার নাম্বার দিলেন।
আমি আমার কাজে চাপে ভুলে যাই তার কথা। এর মধ্যে সে আমাকে ২ দিন মোবাইল করে ছিলেন। আমি তার ফোন পেয়ে আশ্বাস দেই আমি আসব তবে যে কোন শুক্র বার। তিনি খুশি হলেন এবং বলেন, আমি যেন তার বাড়িতে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করি। আমি বলি,না ভাই সেরকম ঝামেলা করবেন না কারন আমি আসলে সকাল সকাল আসব। আমি কিন্তু কাজের চাপে যেতে পারিনি তাকে কথা দেওয়ার পরও। এর মধ্যে এক সন্ধ্যায় তার কথা মনে পড়ে।লোকটিকে কথা দিলাম এখনো যাওয়া হলো না।দেখি আগামি সপ্তাহে যাওয়া যায় কিনা? তাই তাকে মোবাইল করলাম। তখন রাত আটটা সাড়ে আটটা হবে। একবার দুইবার রিং বাজছে কেউ রিসিভ করে না। ভাবলাম আরেক বার দিয়ে দেখি এবার ধরলেন একজন মহিলার কন্ঠ।
সে বলেন,কে?
আমার পরিচয় দিলাম এবং বললাম আমি দেলোয়ার সাহেবের সাথে কথা বলতে চাই।
আমি জানতে চাই আপনি তার কি হন ?
তিনি বললেন, আমি তার গৃহিনী।
আমি বললাম সে বাড়ি নেই?
মহিলা যেন একটু ধাক্কা খেলেন মনে হয় এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। মহিলাটি বললেন, সে মারা গেছেন ৩ মাস হলো।
আমি থমকে যাই,বলেন কী ?
মহিলা বলেন,হ্যাঁ
আমি বলি, তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল কিছু দিন আগে। তার একটি সাক্ষাত নেওয়ার কথাছিল ।
মহিলা বলেন,হ্যাঁ সে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য কত লোকের কাছে গেছেন। কেউ এগিয়ে আসেননি। সে মনের মধ্যে একটি বড় কষ্ট নিয়ে মারা গেলেন। তিনি বলতেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি কিন্তু কী পেলাম ? আমি তার কথার কোন উত্তর দিতে পারিনি। বড় অপরাধীর মত লাগছে নিজেকে। আমি মনে মনে বলি ক্ষমা কর হে যোদ্ধা, ক্ষমা কর মোরে।